Image of মিরাজ হোসেন

নাম: মিরাজ হোসেন

জন্ম তারিখ: ১১ মার্চ, ১৯৯৫

শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪

বিভাগ: ঢাকা_সিটি

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা : চাকরি, কর্মরত প্রতিষ্ঠান: আলো ডোর হাউজ, পদবী: ম্যানেজার শাহাদাতের স্থান : যাত্রাবাড়ী থানা সংলগ্ন

শহীদের জীবনী

মিরাজ ছিল- "আমার সংসারের একমাত্র অবলম্বন" শহীদ পরিচিতি রাজধানী শহরের ব্যস্ততম এলাকা যাত্রাবাড়ীর মধুবাগ। অনেকেই মফস্বল থেকে এই শহরে বসবাস করতে আসেন। তেমনি জনাব মো: আব্দুর রব ও তার স্ত্রী মমতাজ বেগম ডেমরার পাড়াডগাইর সংলগ্ন মধুবাগে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়তে আসেন। জনাব মো: আব্দুর রব নতুন শহরে এসে ভাড়ায় চালিত একটি লেগুনাকেই নিজের কর্মক্ষেত্র বানিয়ে নেন। সারাদিন পরিশ্রম করে স্ত্রীর সাথে ভবিষ্যতের বিষয়ে পরিকল্পনা করেন। কিছুদিন পর ১৯৯৫ সালের ১১ মার্চ তাদের ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয় শহীদ মিরাজ হোসেন। বাবা-মা একত্রে তাদের ছেলেকে আদর সোহাগে বড় করে তোলেন। পরবর্তীতে মিরাজের আরও দুজন ভাই-বোন হয়। যাদের নাম যথাক্রমে আব্দুল্লাহ ও পপি। সন্তানদের বড় হতে দেখে মমতাজ বেগম যেন আশায় বুক বাঁধেন। কিন্তু সে আশা হঠাৎ নিরাশা হয়ে যায়। মিরাজের বাবার ফুসফুসে ইনফেকশন ধরা পড়ে। অসুস্থতার কারণে চলা ফেরা কাজ-কর্ম বন্ধ হয়ে যায়। একপর্যায়ে স্বামীর চিকিৎসা করার জন্য পৈতৃক ভিটে মাটিও বিক্রি করেন তিনি। মিরাজের একমাত্র বোন রুবিনা আক্তার পপি। অনেক স্বপ্ন নিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন বাবা আব্দুর রব। আর্থিক দিক থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত হলেও মেয়ের বিয়ের আয়োজনে কোনো কমতি রাখেননি তিনি। দু-হাত ভরে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে উপহার পাঠিয়েছিলেন আব্দুর রব যাতে মেয়েটি শ্বশুরবাড়িতে ভালো থাকে। বেশ কয়েক বছর সংসার ঠিক মত চলে। পরিবারে নতুন অতিথি জন্ম নেয়। তারপর হঠাৎ একদিন সে সম্পর্ক ভাঁটা পড়ে। একমাত্র আদরের কন্যা আবার আব্দুর রবের সংসারে ফিরে আসে। বিচ্ছেদের বেদনায় বিয়োগান্ত অধ্যায়ের সুচনা ঘটে। মেয়ের এই করুণ পরিণতি নিরবে সহ্য করে নিতে বাধ্য হন আব্দুর রব। পরিস্থিতি মানুষকে বাস্তবতা শেখায় দায়িত্ব যখন নিজের একদিকে আব্দুর রবের অসুস্থতা আবার অন্যদিকে স্বামীর সংসার থেকে বিচ্ছেদপ্রাপ্তা মেয়ে পপির ফিরে আসায় গোটা পরিবারে দীনতা নেমে আসে। সংসার জুড়ে চলে ক্ষুধার তীব্র হাহাকার। দু-মুঠো খাবার অভাবে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় মিরাজ হোসেনের। একটা পর্যায়ে অনেকটা বাধ্য হয়েই পরিবারের সকল দায়দায়িত্ব মাত্র ১৫ বছর বয়সে নিজের কাধে তুলে নেন তিনি। বিভিন্ন দোকান ঘুরে অবশেষে কর্মচারী হিসেবে ‘আলো ডোর হাউজ স্টোরে’ স্বল্প বেতনে চাকরি শুরু করেন। কখনও অভার টাইম, কখনও বা ছুটির দিন। যেন থামতে জানে না অদম্য এই সৈনিক। ধীরেধীরে মহাজনের বিশ্বস্ততা অর্জন করেন। কর্মচারী থেকে ক্যাশিয়ার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। বাসা ভাড়া, বাবার চিকিৎসা খরচ, সহোদরের লেখাপড়া এবং সংসারের যাবতীয় খরচের দায়দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় তাকে। তারপরও যেন থেমে থাকে না মিরাজ। ভাইয়ের প্রতি আস্থা শহীদ মিরাজের ছোট ভাই আবদুল্লাহ (২৬)। আর্থিক দীনতায় দশম শ্রেণির পর আর পড়াশুনা করতে পারেননি। বর্তমানে দেশের একজন জাতীয় দাবা খেলোয়াড় তিনি। দাবাকে পেশা হিসেবে নিয়ে বিপাকে পড়লেও এর পিছনের গল্প যেন বাস্তবতাকে হার মানায়। প্রাইভেট ক্লাবের ফি, রেজিস্ট্রেশন থেকে শুরু করে আব্দুল্লাহ’র এই পর্যায়ে আসতে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনিই হলেন শহীদ মিরাজ হোসেন। পরিবারের অভাব-অনটন দুর্দিনে তিনি ছিলেন একমাত্র অবলম্বন। যে কারণে নিজে না খেয়ে হলেও ভাইয়ের ক্লাব ফি পরিশোধ করেছেন তিনি। “তুমি পাশে না বসলে আমি খেতে পারি না” মায়ের সাথে সখ্যতা সারদিন পরিশ্রম করে এসে সবার আগে মা’কে খুঁজতেন মিরাজ। তাই গভীর রাত হলেও সন্তানের জন্য জেগে থাকতে হতো মমতাজ বেগমকে। ঘুমিয়ে পড়লেও যেন নিস্তার নেই। বারবার মা-মা ডাকে ঠিকই খুঁজে নিতেন তিনি। মাঝে মাঝে মমতাজ বেগম বিরক্তির সুরে ছেলেকে বলতেন “সব সময় পাশে বসে থাকা যায়, অন্য কাজও তো থাকে।” জবাবে মিরাজ বলত, “তুমি পাশে না বসলে আমি খেতে পারি না” হঠাৎ দেশে আন্দোলন ২০২৪ সালের জুলাই মাস। হঠাৎ দেশে গণ আন্দোলনের জোয়ার ওঠে। যেন বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্র-জনতা। সরকারি চাকরিতে বৈষম্যের কোটাকে মানতে না পেরে হাসিনা সরকারকে ধিক্কার জানায় সাধারণ জনতা। এই আলোকে বিভিন্ন কর্মসূচী দেয় বৈষম্য বিরোধী শিক্ষার্থীরা। একে একে কর্মসূচী বাস্তবায়নে রাজপথে নেমে আসে তারা। আন্দোলনকে প্রশমন করতে উঠে-পড়ে লাগে তৎকালীন স্বৈরাচারী খুনি শেখ হাসিনা ও তার দোসররা। তাদের ইন্ধনে শতশত তাজা প্রাণ গুলি করে হত্যা করে আওয়ামী সন্ত্রাসী ও আইনশৃঙ্খলা বিনষ্টকারী পুলিশ বাহিনী। ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ জনতার বিজয় আন্দোলন ধীরেধীরে তরান্বিত হয়। জুলাই মাস যেন শেষ হয়েও হয় না। ৪ আগস্ট দেশের ৬৪ জেলায় জনতার জাগরণ থেকে হুংকার ওঠে- “দাবী এক দফা এক, খনি হাসিনার পদত্যাগ”। একপর্যায়ে মার্চ টু ঢাকা নামে লং-মার্চ কর্মসূচী ঘোষণা করে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতা। পরদিন ৫ আগস্ট দেশবাসীর একাত্মতায় সারদেশ থেকে লং-মার্চে অংশ নেয় লক্ষ জনতা। অবস্থা বেগতিক দেখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা। জনতার রোষানলে একপর্যায়ে দেশ থেকে পালিয়ে সুদূর ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয় তাকে। -পালাইছে রে পালাইছে শেখ হাসিনা পালাইছে! খুনি হাসিনার পদত্যাগে সারাদেশে বিজয় মিছিল বের হয়। ছোট বড় সকলের মুখে একই কথা শোনা যায়- “পালাইছে রে পালাইছে শেখ হাসিনা পালাইছে”! -ভাইয়া একবার কথা বল’’ বিজয় মিছিল ও শাহাদাত ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার পর ‘বিজয় মিছিলে যোগদান করে মিরাজ হোসেন। যাত্রাবাড়ী থানার সামনে মিছিল চলাকালীন ঘাতক পুলিশ বাহিনী তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ হয়ে মুহূর্তে লুটিয়ে পড়েন মিরাজ। এই অবস্থায় তাকে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে এক প্রাইভেট হাসপাতাল কর্মী। অতঃপর তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতাল কতৃপক্ষ জানায় তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। শাহাদাতের খবর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। লাশ বাড়ীতে এসে পৌঁছায়। শহীদের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন শোঁকের মাতমে ভাসে। ছেলের মুখে শেষ চুম্বন দেয় মমতাজ বেগম। প্রতিবেশীদের ভালোবাসা ও সম্মানে অধিষ্ঠিত হয়ে জাতীয় বীর উপাধি লাভ করেন শহীদ মিরাজ হোসেন। ছোট ভাই মাথার কাছে বসে বারবার ডাকতে থাকে- ভাইয়া, ভাইয়া একবার কথা বল। আদরের ছোট ভাইকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে তার বোন। সন্তানকে রবের সান্নিধ্যে পৌঁছে দিতে নিজের কাঁধে খাটিয়া তুলে নেন জনাব আব্দুর রব। ছলছল চোখে জানাজা প্রাঙ্গণে পোঁছান। শতশত মানুষের উপস্থিতিতে ডগাইর মসজিদের সামনে জানাজা সম্পন্ন হয়। এরপর পিতা আব্দুর রব তার শহীদ সন্তানকে নিজ হাতে ডগাইর কবরস্থানে দাফন করেন। -‘আজ আমি কি নিয়ে বাঁচব।’ শহীদের মা, ভাই ও বোনের প্রতিক্রিয়া শহীদ মিরাজ হোসেন ছিলেন তিন ভাই-বোনের মধ্যে পরিবারের প্রথম পুত্র সন্তান। ছোট থেকে পরিবারের হাল ধরায় সবাই তাকে অত্যন্ত ভালোবাসত। তাই ছেলে হারিয়ে দুখিনী মা ও ভাই-বোন আজ পাগল প্রায়। মা বলেন, সে ছিল আমার সংসারের একমাত্র অবলম্বন” আমার ছেলেকে হারিয়ে আজ আমি কি নিয়ে বাঁচব। আমার সংসার আজ কীভাবে চলবে। কি দোষ ছিল আমার ছেলের। কারা আমার ছেলেকে এভাবে মেরে ফেলল ? বোন বলেন- “মিরাজকে আমি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতাম। এখন আমি কাকে ভাই বলে ডাকব। সে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে এটাই আমার সান্ত্বনা। আল্লাহ তাকে শাহাদাতের মর্যাদা দান করুন।” ছোট ভাই বলেন,“আমি ভাইয়ার সাথে ছোট থেকে একই সঙ্গে ঘুমিয়েছি। আমাদের দুই ভাইয়ের একটাই খাট ছিল। এমন অনেক রাত আছে আমরা গল্প করে কাটিয়েছি। বিছানায় শুয়ে আমার ভাইয়াকে আমি স্মরণ করি। তিনি আমাকে বাবার মত স্নেহ, ভালোবাসা, শাসন করতেন। আমাদের দুজনের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো।” শহীদ পরিবারের বর্তমান পরিস্থিতি শহীদ মিরাজ হোসেনের বাবা এখনও ফুসফুসের ইনফেকশনে ভুগছেন। তার মায়ের মাথায় জটিল অসুস্থতা রয়েছে। প্রতি মাসে পরিবারে ২০০০/- টাকার ঔষধের প্রয়োজন হয়। তাইতো সন্তানকে হারিয়ে বড্ড দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। শহীদের ছোট ভাই দাবা খেলাকে পেশা হিসেবে নিয়ে এক প্রকার বিপাকে পড়েছেন। দাবা ফেডারেশন কর্তৃপক্ষ বর্তমানে ম্যাচ-ফি ছাড়া খেলোয়াড়দেরকে মাসিক বা এককালীন ভাতা দেয়া বন্ধ রেখেছে। যেহেতু পরিবারে এই মুহূর্তে উপার্জনক্ষম কোনো ব্যক্তি নেই। তাই ফেডারেশন থেকে অবসর নিতে চাচ্ছেন তিনি। যেকোন কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করতে চেষ্টা করছেন। ঘর ভাড়া এবং আনুষাঙ্গিক যাবতীয় খরচ শহীদ মেরাজ হোসেনই বহন করতেন। বর্তমানে তার পরিবারে ঔষধ ক্রয় করার মত সামান্য অর্থকড়িও নেই। এখন আর সন্তানের পাশে বসতে হয় না শহীদ জননীর। এখন আর রাত জেগে অপেক্ষা করতে হয় না তাকে! শুধু দয়াময় মহান রবের দ্বারে হাত পেতে থাকেন। যেন সর্বক্ষণ প্রার্থনায় মগ্ন থাকেন তিনি। ফরিয়াদ করেন প্রভুর কাছে “হে আল্লাহ! আপনি আমার সন্তানকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থান দান করুন। শহীদি মৃত্যুর কাতারে শামিল করুন। (আমিন)” ব্যক্তিগত পরিচিতি নাম : মিরাজ হোসেন পেশা : দোকানের ম্যানেজার, আলো ডোর হাউজ জন্ম তারিখ ও বয়স : ১১ মার্চ ১৯৯৫, ২৯ বছর আহত হওয়ার তারিখ : ০৫-০৮-২০২৪, দুপুর: ১২:৪০ মিনিট শাহাদাতের তারিখ : ০৫-০৮-২০২৪, দুপুর: ১২.৪৫ মিনিট স্থান : যাত্রাবাড়ী থানা সংলগ্ন দাফনের স্থান : ডগাইর কবরস্থান, মধুবাগ, যাত্রাবাড়ী স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: মধুবাগ, পাড়াডগাইর, থানা: যাত্রাবাড়ী জেলা: ঢাকা পিতা : মো: আব্দুর রব, অবসর প্রাপ্ত ট্রাক চালক (৫১) মাতা : মমতাজ বেগম, গৃহিণী (৪৬) বাড়ী-ঘর ও সম্পদের অবস্থা : পৈত্রিক কোনো আবাদি/বসতী জমি নেই ভাই-বোনের বিবরণ : ১. আবদুল্লাহ, বয়স: ২৬, পেশা: দাবা খেলোয়াড়, সম্পর্ক: ভাই : ২. মোসা: রুবিনা আকতার পপি, বয়স: ৩৬, (স্বামী পরিত্যাক্তা) সম্পর্ক: বোন প্রস্তাবনা: ১. শহীদ পরিবারের মাসিক সহযোগিতা প্রয়োজন। ২. শহীদের ছোট ভাইকে কর্মসংস্থান করে দেওয়া যেতে পারে। ৩. শহীদের পিতাকে চিকিৎসা ভাতা প্রদান করা জরুরী।

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of মিরাজ হোসেন
Image of মিরাজ হোসেন
Image of মিরাজ হোসেন
Image of মিরাজ হোসেন
Image of মিরাজ হোসেন
Image of মিরাজ হোসেন
Image of মিরাজ হোসেন
Image of মিরাজ হোসেন
Image of মিরাজ হোসেন

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

 মোঃ শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ

মাসুদুর রহমান জনি

মো: আসিফ ইকবাল

মোঃ নুরু বেপারী

মোঃ সাইফুল ইসলাম

জসিম

মো: রায়হান

গঙ্গা চরন রাজবংশী

মো. রফিকুল ইসলাম

লিটন হাসান লালু

ওবায়দুল ইসলাম

মো: ইউসুফ মিয়া

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo