জন্ম তারিখ: ২৫ জানুয়ারি, ২০০৬
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: সিলেট
পেশা : কাঠমিস্ত্রি, শাহাদাতের স্থান : বানিয়াচং থানার সামনে
শহীদ মো: আশরাফুল আলম ২০০৬ সালে হবিগঞ্জের জাতুর্ণপাড়া গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মো: আব্দুর নুর ও মাতা মোসা: মাহমুদা বেগমের তিন মেয়ে ও এক ছেলের পর চাঁদের আলো হয়ে জন্মগ্রহণ করেন আশরাফুল। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হওয়ার পরেও দারিদ্রতা তাকে পিছনে টেনে ধরেছে। পরিবারের মুখে হাসি ফোঁটানোর জন্য তিনি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেই সমাপ্তি টানেন। ছোটবেলা থেকেই একটি কাঠের দোকানে কাজ নেন। খুব মনোযোগের সাথে কাজ করতেন তিনি। কারণ তার চিন্তা ছিল- ভালো করে দ্রুত কাজ শিখে অনেক টাকা উপার্জন করতে হবে; না হয় বোনদের বিয়ে দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে। কাঠের কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাঠে চাষ করতেন এবং মাঝে মাঝে নদীতে মাছ ধরতে যেতেন। গ্রামের সবাই তাকে পরিশ্রমী ছেলে হিসেবে চিনতো। শাহাদাতের ঘটনা সংক্রান্ত বিবরণ ফুল কখনো নিজের জন্য ফোটে না সে নিজেকে অপরের জন্য প্রস্ফুটিত করে। আশরাফুল আলম ফুটে উঠেছিল তার পরিবারের জন্য। কিন্তু আওয়ামী লীগে সন্ত্রাসী সংগঠন ও তার পোষা সরকারি বাহিনী আশরাফুলের মত অনেক ফুলকে সুন্দরভাবে ফোটার আগেই ছিঁড়ে ফেলেছে। ফুল যদি সুরভি ছড়ানোর ঠিক আগ মুহূর্তে ঝরে পড়ে তখন আর কোন কিছু ভাল লাগে না। আর সে ফুল কেউ ইচ্ছা করে নষ্ট করে তাহলে । শহীদ মো: আশরাফুল আলম তেমনি একটি ফুল যিনি সুরভি ছড়ানোর ঠিক আগ মুহূর্তে বাতিলের নির্মম বুলেটের আঘাতে ঝরে পড়েছে। ৫ আগস্ট, আশরাফুল আলম সকালে ঘুম থেকে উঠে তার বাবার সাথে ফজরের নামাজ আদায় করে বিলে মাছ ধরতে বের হন। এমন সময় তার এলাকার বন্ধুরা এসে বলে, "আশরাফুল আজ আমরা সকাল সকাল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনে বানিয়াচং থানার সামনে মিছিল করতে যাব। তুই কি যাবি আমাদের সাথে?" সাথে সাথে আশরাফুল বলে, যাবো না কেন? স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যদি আন্দোলন না করি তাহলে তো আমাদের বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না।জাল রেখে বন্ধুদের সাথে চলে যাওয়ার জন্য বাবা ও মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেয় আশরাফুল। মা-বাবার চোখের পানি উপেক্ষা করে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শামিল হতে আশরাফুল অনেকটা জোর করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় বন্ধুদের সাথে। আশরাফলের আম্মু চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে আল্লাহ যেন তোকে ভালো রাখে আর এই জালিম সরকারকে যেন উচিত শিক্ষা দেয়। কে জানে এটাই ছিল তার শেষ যাওয়া। দিনটি ছিলো ৫ আগস্ট, সোমবার, সকাল ১১ টা। কিশোর আশরাফুল আলম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনে বন্ধুদের সাথে বানিয়াচং থানার সামনে মিছিল করতে যান। কয়েক ঘণ্টা চলে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। সাধারণ ছাত্র-জনতা তাদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের ভারী অস্ত্র ও রাবার বুলেটের সামনে আন্দোলন অব্যাহত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যায়। আশরাফুলের বন্ধুরা যখন পুলিশের গুলি থেকে বাঁচার জন্য পালানোর চেষ্টা করতেছিল তখন আশরাফুল বলল মৃত্যু কপালে থাকলে কেউ বাঁচাতে পারবে না আর যদি মৃত্যু না থাকে তাহলে বুলেটের আঘাতেও মৃত্যু হবে না। তাই চলো আমরা সামনের দিকেই এগিয়ে যাই। এক সময় মিছিলের উপর বানিয়াচং থানার পুলিশ, সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের কুখ্যাত ক্যাডারেরা নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। একটি গুলি এসে তার বুকের বাম পাশে ঢুকে অপর পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। রাজপথে গুলিবিদ্ধ হয়ে আশরাফুল আলম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। পরিসমাপ্তি হয় পরিবারের একমাত্র অবলম্বন, সাহসী বীর ও একটি ফুটন্ত ফুলের প্রাণ পাখি আশরাফুলের বর্ণালী জীবনের। শহীদের বন্ধুর প্রতিক্রিয়া জীবনে অনেক বন্ধু দেখেছি অনেক বন্ধুর সাথে মিশেছি কিন্তু আশরাফুলের মত এত বিশ্বস্ত বন্ধু আমি আমার জীবনে পাইনি। সে কোন কথা দিলে যে কোন মূল্যে কথা রাখার চেষ্টা করত। তার নিজের চাইতেও বন্ধুদের বেশি ভালোবাসতো। অর্থনৈতিক অবস্থা মো: আশরাফুল আলমের পারিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই দুর্বল। তিনি কাঠ মিস্ত্রির কাজ করতেন। মাঝে মাঝে তিনি খাল-বিলে মাছ ধরে তা বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাতেন। তার বড় ভাইয়ের মাসসিক সমস্যার কারণে কোন কাজ করতে পারেনা। তাই তার একমাত্র আয়ে ৩ বোনের পড়ালেখার খরচ চালাতেন। তার কোন ফসলি জমি-জমা নেই। ঘরের ভিটাটুকুই তাদের একমাত্র সম্বল, তাও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক ছোট। তাদের বসবাসের ঘরটি টিনের জরাজীর্ণ ছাউনি দিয়ে নির্মিত। বৃষ্টি এলে ঘরের মধ্যে টিনের চাল থেকে পানি পড়ে। তার বাবা একজন গরিব কৃষক। তাদের ফসলি জমি না থাকায় অন্যের জমিতে বর্গা চাষ করতে হয়। তার বাবাও বৃদ্ধ। বর্তমানে আশরাফুলের বাবা ও তেমন কাজ-কর্ম করতে পারেন না। তাই তাদের এই বড় সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন শহীদ আশরাফুল আলম। তার মৃত্যুতে পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎসও বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে এই পরিবারটি মানবেতর জীবন যাপন করছেন। আশরাফুল আলমের মেজো বোন রুজমা আক্তারকে বিয়ে দেয়া হয়েছে। টাকার অভাবে উঠিয়ে দিতে পারছেনা তার বাবা। শহীদ আশরাফুলের শখ ১. বড় ভাইকে চিকিৎসা সুস্থ করে তোলা। ২. বোনদের বিয়ে দেওয়া। ৩. নিজস্ব কাঠের ফার্নিচারের দোকান দেওয়া। এক নজরে শহীদ মো: আশরাফুল আলম পূর্ণ নাম : মো: আশরাফুল আলম পিতার নাম : মো: আব্দুন নুর মাতার নাম : মাহমুদা বেগম জন্ম তারিখ : ২৫-০১-২০০৬ জন্মস্থান : জাতুর্ণ পাড়া, বানিয়াচং, হবিগঞ্জ স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা : গ্রাম: জাতুর্ণ পাড়া ইউনিয়ন: যাত্রাপাশা থানা : বানিয়াচং, জেলা হবিগঞ্জ বৈবাহিক অবস্থা : অবিবাহিত শিক্ষাগত যোগ্যতা : পঞ্চম শ্রেণী, পেশা: কাঠমিস্ত্রি পরিবারের সদস্যদের পরিচয় : বাবা: আব্দুর নূর (৬০), মাতা: মাহমুদা বেগম (৪৫) ভাই-বোনদের পরিচয় : ১. রিগ্নু বেগম (২২): বিবাহিতা ২. রেশমা আক্তার (২০): বিবাহিতা ৩. তাইমা আক্তার (১৮): বুন্দাবন ডিগ্রী কলেজ, দ্বাদশ শ্রেণী ৪. আব্দুর রকিব (১৬): মানসিক রোগী ৫. তাইয়্যেবা আক্তার (১৪): একাডেমিক উচ্চ বিদ্যালয় দশম শ্রেণী শাহাদাতের তারিখ ও সময় : ০৫-০৮-২০২৪ দুপুর ১২:৩০ মিনিট শাহাদাতের স্থান : বানিয়াচং থানার সামনে আক্রমণকারী : বানিয়াচং থানার পুলিশ আক্রমণের ধরন : বুকের বাম পাশে একটি গুলি ঢুকে অপর পাশ দিয়ে বের হয়ে যায় জানাজা : জাতুর্ণ পাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠ দাফন : গ্রামের গোরস্থান