জন্ম তারিখ: ১২ এপ্রিল, ১৯৭৯
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: সিলেট
পেশা : মাছ বিক্রেতা, শাহাদাতের স্থান : ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে
আজমত আলী হবিগঞ্জ জেলায় হরিপুরে ১৯৭৯ সালের ১২ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতা জনাবা ছকিনা বিবির বয়স ৯৫ বছর। পিতা জনাব ফজর আলী ইন্তেকাল করেছেন অনেক আগেই। আছে একজন ভাই। আজমত আলির নিজের সংসার রয়েছে। স্ত্রী, দুই ছেলে আর একটি মেয়ে নিয়ে তার পরিবার। নদ-নদীতে মাছ ধরে সে মাছ বাজারে বিক্রি করেই চলত তার পরিবারের জীবিকা। সৎ মৎস ব্যবসায়ী হিসেবেই তার পরিচিতি রয়েছে নিজ এলাকায়। ঢাকায় অবস্থান সময়টা ছিলো আগস্ট মাসের শুরুর দিকে। জুলাইয়ের শেষের দিকে ছাত্রদের আন্দোলন দমানোর অভিপ্রায়ে স্বৈরাচার সরকারের থেকে ঘোষণা আসে কারফিউর। সেনাবাহিনীর সড়কে অবস্থানের কারণে জুলাই মাসের প্রথম দিকে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়। ধীরে ধীরে জনজীবনে প্রকাশ পায় স্বাভাবিকতা। যানবাহনগুলো চলতে থাকে আগের মতো। যদিও এরই পিছনে চারিদিকে চলতে থাকে ঘাতক বাহীনির ধরপাকর, গুম-খুন আর গ্রেফতারী অভিযান। এদিকে বাহ্যিক পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে আজমত আলী ঢাকায় যান তার ব্যবসায়ীক কাজে। অবস্থান করেন ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে। জুলাইয়ের শেষে স্তিমিত রূপ নেয়া আন্দোলন মূলত একেবারে নিভে যায়নি। সেটা সুপ্ত ছিলো তুষের আগুনের ন্যায়। যখন কারফিউ শিথিল হতে থাকে, ইন্টারনেট স্বল্প করে হলেও চালু হয়, তখন সারাদেশ জুড়ে একটু একটু করে আবার জনগণ আন্দোলনে নামা শুরু করে। এবারে আন্দোলনের জন্য স্পিরিট ছিলো আগের বারের থেকে বহুগুণ বেশি। আন্দোলন শুরু হয় কোটা সংস্কারের যৌক্তিক দাবী নিয়ে। কিন্তু এ যৌক্তিক আন্দোলোনের উপর স্বৈরাচার হাসিনার নির্দেশে চলে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। তাই কারফিউ শিথিল হওয়ার সাথে সাথে জুলাই মাসের আন্দোলনে যারা শাহাদাত ও পঙ্গুত্ব বরণ করেছিলেন তাদের বন্ধু, ভাই ও আন্দোলনের সাথীরা সুষ্ঠু বিচারের দাবীতে রাজপথে নেমে আসে। এবার ছাত্রদের সাথে ব্যাপকাহারে রাজপথে নামতে থাকে শিক্ষক-অভিভাবক, উকিল, শিল্পী, অভিনেতা থেকে শুরু করে রিকশাচালক, ভ্যানচালক, দিনমজুর সহ সমাজের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ। আজমত আলী বরাবরই ন্যায়ের পক্ষে অটল। তাই আগস্টের দ্বিতীয় দফায় শুরু হওয়া এই আন্দোলনে আজমত আলী সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে থাকে। শহীদ হওয়ার দিন ৪ আগস্ট শহীদ মিনারে জড়ো হয় সকল ছাত্ররা। সাথে থাকে আপামর জনতা। সেদিন শহীদ মিনারের আকশে প্রতিধ্বনিত হয় স্বদেশ প্রেমের সুরে। সেই সাথে ঘোষণা আসে ৬ আগস্ট ১ দফা দাবীতে সারাদেশ থেকে গণ ভবনের উদ্দেশ্যে লং মার্চের। দফা এখন একটাই। স্বৈরাচার সরকারের পদত্যাগ। পরবর্তীতে পরিস্থিতি বিবেচনায় রাতে ঘোষণা আসে ৬ তারিখ নয়, আগামীকাল তথা ৫ আগস্ট লং মার্চ টু ঢাকা। ৫ আগস্ট সকাল থেকে রাজধানীতে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করতে থাকে। সকাল দশটা এগারোটা থেকে আস্তে আস্তে নামতে থাকে এক এক করে সাধারণ মানুষ। ধীরে ধীরে জনসমাগম বাড়ে। শুরু হয় আন্দোলন। আজমত আলী যাত্রাবাড়িতে চলমান আন্দোলনে যুক্ত হন। তাদের মিছিল এক পর্যাযে পৌছায় যাত্রাবাড়ি থানার সামনে। অন্যায়ের প্রতিবাদে অকুতোভয় আজমত আলী অবস্থান করছিলেন মিছিলের একেবারে সামনের সারিতে। তারপর শুরু হয়ে যায় পুলিশ, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের আক্রমণ। চলতে থাকে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। এই পাল্টা ধাওয়ার এক পর্যায়ে দৌড় দিতে গিয়ে রাস্তায় পড়ে যান আজমত আলী। এমন সময় সরকারের সন্ত্রাসীরা এলোমেলোভাবে গুলি চালাতে শুরু করে। হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে আজমত আলীর গলায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়া আজমত আলীর দেহকে উপস্থিত কয়েকজন ভ্যানগাড়ি করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে পৌঁছানোর পর কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘাতকের বুলেটে এভাবেই নিঃশেষ হয়ে যায় আজমত আলীর প্রাণ। যেমন ছিলেন শহীদ আজমত আলী ব্যক্তিগত জীবনে খুবই ধার্মিক একজন মানুষ ছিলেন শহীদ আজমাত আলী। দৈনিক ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। আদরের ছোট ছেলেকে ভর্তি করিয়েছিলেন মাদ্রাসায়। তাই স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায়ীক কাজে সততার পরিচয় রাখতেন শহীদ আজমত আলী। তার ভাতিজা খোরশেদ আলম জানান, "আজমত আলী চাচা অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। আমরা একই সাথে মাছের ব্যবসা করতাম। সহজ সরল নির্ভেজাল একজন মানুষ ছিলেন। আমরা এক সাথে ৩-৪ দিন স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে যোগদিচ্ছিলাম। আমারে নিজের ছেলের মত আদর করতেন। তিনি কোন অসৎ উপায়ে আয় রোজগার করতেন না। যদি কোন মাছ পঁচে যেত তা বিক্রি না করে ফেলে দিতেন। এতে যদি তার লোকশান হয় তবুও কখনোই খরিদ্দারদের পঁচা মাছ দিতেন না।" এমনি ছিলেন শহীদ আজমত আলী। শহীদ পরিবারের বর্তমান অবস্থা শহীদ আজমত আলীর পারিবারিক অবস্থা খুবই দুর্বল। মাছ বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। তার মৃত্যুর পরে তার তিন সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ঘোর দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন তার স্ত্রী। ঘরের জন্য তেমন কিছুই রেখে যেতে পারেননি যা দিয়ে তার স্ত্রী সংসার চালিয়ে নিতে পারবেন। ঘরের ভিটে টুকু ছাড়া কোন আবাদি জমি নেই শহীদ আজমত আলীর। যে ঘরটি রয়েছে তাও অনেক ছোট এবং একটি মাত্র কক্ষ বিশিষ্ট। অপরদিকে ইসলামী ব্যাংক থেকে নেয়া ৯০,০০০ (নব্বই হাজার) টাকার ঋণের বোঝা তাদের উপর রয়ে গেছে। ১৫ বছর বয়সি বড় ছেলে মাহফুজ আলম আগে থেকেই পড়াশোনা ছেড়েছেন। এদিকে ছোট দুই সন্তান ৫ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত নাদিয়া আক্তার ও প্রথম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত মাহিনুর আলম এর পড়াশোনাও অনিশ্চিত। এক নজরে শহীদ আজমত আলী নাম : আজমত আলী জন্ম তারিখ : ১২ এপ্রিল, ১৯৭৯ জন্মস্থান : হরিপুর, হবিগঞ্জ পিতার নাম : মো: ফজর আলী (মৃত) মাতার নাম : ছফিনা বিবি (৯৫) স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা গ্রাম : হরিপুর ইউনিয়ন : নবীগঞ্জ থানা : নবীগঞ্জ জেলা : হবিগঞ্জ সন্তানাদি ছেলে : মাহফুজ আলম (১৫) মেয়ে : নাদিয়া আক্তার (১৩) শ্রেণি: ৫ম রাজাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছেলে : মাহিনুর আলম (১০) শ্রেণি: ১ম জামিয়া ইসলামিয়া চরগাঁও মাদ্রাসা প্রস্তাবনা ১. শহীদের পরিবারকে বড় করে পাকা ঘর নির্মাণ করে দেয়া ২. এককালীন আর্থিক অনুদান ও নিয়মিত মাসিক ভাতা প্রদান ৩. শহীদ পরিবারের সকল খরচ নিশ্চিত করা