জন্ম তারিখ: ১ জুলাই, ১৯৯০
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: সিলেট
পেশা : সাংবাদিক, স্টাফ রিপোর্টার জালালাবাদ, ব্যুরো চিফ দৈনিক নয়াদিগন্ত, শাহাদাতের স্থান : কোর্ট পয়েন্ট, সিলেট।
“সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে ফেরার সুযোগ পেলনা তুরাব” শহীদ এটিএম তুরাব ১ জুলাই ১৯৯০ সালে সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার ফতেহপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম (মৃত) মো: আব্দুর রহিম, মাতার নাম মমতাজ বেগম। তিনি মোটামুটি একটি স্বচ্ছল পরিবারেই জন্ম গ্রহণ করেন। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন। সবসময় সবার চোখের মণি হয়ে থাকতেন। বড় ভাই-বোনের আদরেই শৈশব ও কৈশোর কেটেছে তুরাবের। ছোটবেলা থেকে হাস্যোজ্জ্বল প্রাঞ্জল একজন শিক্ষার্থী ছিল তুরাব। বড় আপার সাথে খুনসুটি, ভাইদের সাথে মারামারি আবার পরক্ষণেই গলাধরে খেলার মাঠে যাওয়া সবই ছিল তার জীবনের স্মৃতিপটে। ধীরে- ধীরে হাটি- হাটি, পা-পা করে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ, কলেজের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি জমায় সে। এর মধ্যে তার বড় আপা ফাতেহা বেগম চলে যায় এবং কিছুদিনের মধ্যে বড় ভাইও ফ্রান্সে চলে যায়। তার বুকের একপাশ খালি হয়ে যায়। কিন্তু করার কিছু নেই। জীবনে সবকিছুই মেনে নিতে হয়, এই ভেবে সেও সবকিছু মেনে নিতে শুরু করে। তখন সে তার মা এবং সমবয়সী ভাই আবুল আহসানের সাথে থাকে। বিবাহিত জীবন মাত্র দুই মাস আগে বিয়ে হয়েছিল সাংবাদিক এটিএম তুরাবের। বিয়ের কিছুদিন পর দেশ ছেড়ে চলে যান তার যুক্তরাজ্য প্রবাসী স্ত্রী তানিয়া ইসলাম। তুরাবের মৃত্যুর দিন তার স্ত্রী খবর পেয়েও টিকিটের জোগাড় করতে না পারায় আসতে পারেনি। একমাত্র মাধ্যম ছিল তুরাবকে অনলাইনে শেষ দেখাটা দেখে নেয়া। কিন্তু স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের অন্যতম কেনা গোলাম জুনায়েদ পলক বাংলাদেশের মানুষকে বেখবর রাখার জন্য ১৭ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ইন্টারনেট বন্ধ রাখে। যার ফলে তুরাবের নতুন স্ত্রী তানিয়া তাকে শেষ দেখাটাও দেখতে পারেননি। এতে তুরাবের স্ত্রী তানিয়া পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। কিন্তু প্রবাসে তার স্ত্রীকে স্বান্তনা দেয়ার মত কেউ ছিলনা। একজন নববধূর কান্নায় প্রকম্পিত হয় যুক্তরাজ্যের আকাশ পাতাল। বুকফাটা কান্না করে হৃদয়ের দুঃখ মেটানো ছাড়া কোনো উপায় তার হাতে ছিলনা। কথা ছিল, তুরাবকেও সেখানে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করবেন তানিয়া, কিন্তু তা আর তুরাবের ভাগ্যে হলো না। আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের কোটা বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। এরপর তা একনাগারে চলতে থাকে এবং দিন যেতে থাকে আর মিছিল, মিটিং সমাবেশ এক পা দু পা করে কঠোর হতে থাকে। কিন্তু ১৫ তারিখে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের গুন্ডা ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর চড়াও হয়। এতে বিক্ষুব্ধ হয় সাধারণ ছাত্র-জনতা। এক সময় তারাও হাতে লাঠি, স্ট্যাম্প, বাঁশ যে যা পারে তাই তুলে নেয়। এরই মধ্যে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা বলেন,' “মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিদের চাকরি দিবনা তো কি রাজাকারের নাতি-পুতিদের চাকরি দিব?' যা ছিল আগুনে পানি ঢালার বদলে ইচ্ছাকৃতভাবে ঘি ঢালার মতো অবস্থা। এতে শিক্ষার্থীদের গরম রক্ত বারুদে রূপান্তরিত হতে থাকে।” এই বিপ্লবে অংশ নেয়নি এমন কোনো শ্রেনি পেশার লোক নেই। বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রী, রিক্সাওয়ালা, সিএনজি ওয়ালা, সবজি ওয়ালা, মুদি দোকানদার। এদেরকে বলা হয় মাঠ কর্মী। কিন্তু দেশের মানুষ কে যারা সকল বিষয়ে খবর দিতে থাকেন অর্থাৎ সাংবাদিকদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তুলে ধরেন ন্যাপরায়ণ, সৎ, আদর্শবান সাংবাদিক গোষ্ঠী। সেরকমই একজন গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিক তুরাব সিলেটের অবস্থা সকলকে জানানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। কর্মজীবনে তিনি সাংবাদিকতায় যোগদান করেন। তিনি দৈনিক জালালাবাদ এর স্টাফ রিপোর্টার এবং দৈনিক নয়া দিগন্তের ব্যুরো চিফ ছিলেন । যেভাবে শহীদ হলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে ১৯ জুলাই দুপুরে নগরের বন্দরবাজার এলাকা থেকে সিলেটের ছাত্র-জনতা মিছিল বের করলে আচমকাই সেখানে নির্যাতক পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে যায় মিছিলকারীদের। স্বৈরাচার হাসিনার অস্ত্রধারী পুলিশ বাহিনী মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। ঐদিন আরও কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে সেখানে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন তুরাব। আচমকা সংঘর্ষ শুরু হলে তৎক্ষণাৎ নিজেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার সুযোগ পাননি তিনি। পুলিশের ছোঁড়া গুলি হঠাৎ তুরাবের চোখে এবং গায়ে লাগে। সেখানে কাতরাতে থাকে তুরাব কিন্তু এই ভয়ঙ্কর পরিবেশে ঘাতক পুলিশ বাহিনীর এলোপাতাড়ি গুলির মাঝে তৎক্ষণাৎ তার সহকর্মীরা তাকে সরাতে পারেনি। সংঘর্ষ শুরুর কিছুক্ষণ পর সেখানে উপস্থিত সহকর্মীরা দেখেন তুরাব মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পরে তার সহকর্মীরা তাকে সিলেটের ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু সেখানে তুরাবের অবস্থা দেখে তাকে চিকিৎসার জন্য ইবনেসিনা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। পরে সেখান থেকে তাকে নগরের সোবহানীঘাট এলাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে নেয়া হয়। ঐদিন সন্ধ্যায় ইবনে সিনা হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থান তুরাবের মৃত্যু হয়। পরের দিন ২০ জুলাই ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তুরাবের মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ও সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান শামসুল ইসলাম জানান, নিহতের শরীরে ৯৮টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। গুলিতে তার লিভার ও ফুসফুস আঘাতপ্রাপ্ত হয়। মাথায় ঢিলের আঘাতও ছিল। এ কারণেই তার মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে। তার মৃত্যুর ঘটনা সিলেটের আপামর জনসাধারণের কাছে সারা দেশে একটি আলোচিত ঘটনা হয়ে ওঠে, যা স্বৈরাচারী পতনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। শহীদ তুরাবকে সিলেটের বিয়ানীবাজার ফতেহপুরস্থ পারিবারিক কবরস্থানে কবরস্থ করা হয়। এক নজরে শহীদের ব্যাক্তিগত তথ্যাবলি নাম : এটিএম তুরাব জন্ম তারিখ : ১ জুলাই ১৯৯০ পিতার নাম : মো: আব্দুর রহিম (মৃত) মাতার নাম : মমতাজ বেগম পেশা : সাংবাদিক, স্টাফ রিপোর্টার জালালাবাদ, ব্যুরো চিফ দৈনিক নয়াদিগন্ত পারিবারিক সদস্য : ৫ জন স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: ফতেহপুর, ইউনিয়ন: ফতেহপুর, থানা: বিয়ানীবাজার, জেলা: সিলেট বর্তমান ঠিকানা : বাসা/মহল্লা: ১০৫ নবপুষ্প, এলাকা: যতরপুর, থানা: কোতোয়ালী, জেলা: সিলেট ঘটনার স্থান : কোর্ট পয়েন্ট, সিলেট আঘাতকারী : পুলিশ বাহিনী আহত হওয়ার সময় : ১৯ জুলাই, জুমার নামাজ পরে নিহত হাওয়ার সময় : ঐ প্রস্তাবনা : ১. রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদের স্বীকৃতি ও মর্যাদা প্রদান