জন্ম তারিখ: ২০ অক্টোবর, ১৯৯৩
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৪ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা : দিন মজুর, শহীদ হওয়ার স্থান : পিটিআই মোড় মুন্সিগঞ্জ সদর।
১৯৯৩ সালের ২০ অক্টোবর এক আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মুন্সিগঞ্জ জেলার উত্তর ইসলামপুর গ্রামে জনাব মোহাম্মদ আলী আকবর মোল্লা ও মৃত সাহিদা বেগমের ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয় বীর মুক্তিকামী তেজস্বী মো: সজল। বাল্যকাল থেকে অভাবের আচ্ছাদন থাকায় লেখাপড়া হয়নি শহীদের। কিশোর বয়সে পরিবারের দায়িত্ব এসে বর্তায় তাঁর উপর। দিনমজুরি কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে উপার্জন শুরু করেন। এরপর কেটে যায় অনেকগুলো বছর। নিজেকে ধীরেধীরে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যায় মহাবীর সজল। শহীদ সহোদরদ্বয় পেশায় দিনমজুর। সজল বাবার বয়স ৭২ বছর হয়েছে। বয়সের ভারে চলাফেরা করতে অক্ষম তিনি। শহীদ তাঁর উপার্জন দিয়েই অসুস্থ পিতাকে নিয়ে বসবাস করতেন। বিপত্নীক বৃদ্ধ আকবর মোল্লার সজলই ছিলেন একমাত্র ভরসাস্থল। আন্দোলনের দিনগুলো (৫ জুন থেকে ৫ আগস্ট ২০২৪) ৫ জুন : মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল অবৈধ ঘোষণা করে রায় প্রদান করে হাইকোর্ট। ৬ জুন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। ৯ জুন : কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রতিবাদে আবারও বিক্ষোভ সমাবেশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দাবি মানতে সরকারকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন তারা। বিক্ষোভ শেষে আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিদল সুপ্রিম কোর্টে অ্যাটর্নি জেনারেল বরাবর স্মারকলিপি দেয়। কোটা বাতিল সংক্রান্ত হাইকোর্টের দেয়া রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য ৪ জুলাই দিন নির্ধারণ করা হয়। ১ জুলাই : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোটা বাতিলের দাবিতে ছাত্রসমাবেশ ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় ঢাবিসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ৪ জুলাইয়ের মধ্যে দাবির বিষয়ে চূড়ান্ত সুরাহার আহবান জানানো হয়। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে তিন দিনের কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হয়। ২ জুলাই : ঢাবির ছাত্ররা মিছিল নিয়ে এক ঘন্টা শাহবাগ অবরোধ করে রাখে। জাবির ছাত্ররাও ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ২০ মিনিটের জন্য অবরোধ করে। ৩ জুলাই : ঢাবির ছাত্ররা শাহবাগ মোড় দেড় ঘণ্টার মতো অবরোধ করে রাখে। ময়মনসিংহে রেললাইনে ট্রেন অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক অবরোধ করে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার মোড়ে সড়ক অবরোধ করে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ৪ জুলাই : প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ 'নট টুডে' বলে আদেশ দেন। পরের সপ্তাহে এ বিষয়ে শুনানি হতে পারে বলে ওই দিন অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় থেকে জানানো হয়। ছাত্ররা ঢাকার শাহবাগ মোড় অবরোধ করে রাখে ৫ ঘণ্টা। ৫ জুলাই : এই দিন শুক্রবারেও চট্টগ্রাম, খুলনা ও গোপালগঞ্জে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করে আন্দোলনকারী ছাত্ররা। ৬ জুলাই : দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আগের দিনের মতোই বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়। আন্দোলনকারীরা সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন, ধর্মঘট এবং সারা দেশে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধের ডাক দেন। নাম দেয়া হয় ‘বাংলা ব্লকেড’। ৭ জুলাই : বাংলা ব্লকেডে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেয় শিক্ষার্থীরা। ৮ জুলাই : ঢাকার ১১টি স্থানে অবরোধ, ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ, ৩টি স্থানে রেলপথ অবরোধ এবং ৬টি মহাসড়ক অবরোধ করে রাখা হয়। সারাদেশের ছাত্রদের নিয়ে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে ৬৫ সদস্যের সমন্বয়ক টিম গঠন করা হয়। ৯ জুলাই : হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে দুই শিক্ষার্থী আবেদন করে। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৪ ঘন্টা অবরোধ কর্মসূচি ‘বাংলা ব্লকেড’ পালন করা হয়। পরদিন সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা ‘বাংলা ব্লকেড’-এর ঘোষণা দেয়া হয়। ১০ জুলাই : কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ আপিল বিভাগের। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ এ আদেশ দেন। শুনানির জন্য আগামী ৭ আগস্ট দিন রাখা হয়। ছাত্ররা ভুল করেছে মর্মে বক্তব্য রাখেন প্রধান বিচারপতি। তিনি আরো বলেন, রাস্তায় স্লোগান দিয়ে রায় পরিবর্তন করা যায় না। এটি সঠিক পদক্ষেপ না। ১১ জুলাই : পুলিশের বাঁধার মুখেই দেশের বিভিন্ন স্থানে অবরোধ পালন করেন আন্দোলনকারীরা। তৎকালীন সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করছেন। এটি অনভিপ্রেত ও সম্পূর্ণ বেআইনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, শিক্ষার্থীরা 'লিমিট ক্রস' করে যাচ্ছে। ১২ জুলাই : শুক্রবার ছুটির দিনেও দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল শেষে শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। রেলপথ অবরোধ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ১৩ জুলাই : আরাফাত বলেন, বিচারাধীন বিষয়ে সরকারের এখন কিছু করার নেই। ১৪ জুলাই : রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দিয়ে আন্দোলনকারীরা সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেয়। শেখ হাসিনা চীন সফর শেষে সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে আন্দোলনকারী ছাত্রদের রাজাকারের নাতি-পুতি বলে ঘোষণা করেন। এর প্রতিবাদে রাত নয়টার দিকে ঢাবির বিভিন্ন হলে শ্লোগান ওঠে, তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার! এই শ্লোগান এতোই জনপ্রিয় হয় যে, মুহূর্তেই দেশের সকল পাবলিক ভার্সিটিতে পৌঁছে যায়। সকল ভার্সিটিতেই এই শ্লোগান চলে রাতভর। রাতে চবিতে ছাত্রদের মিছিলে ঘাতক ছাত্রলীগ হামলা চালায়। ১৫ জুলাই : ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলে, আন্দোলনকারীদের 'রাজাকার' স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে। ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম মন্তব্য করে, যাঁরা ‘আমি রাজাকার’ স্লোগান দিচ্ছেন, তাঁদের শেষ দেখিয়ে ছাড়বো। কাদের ও সাদ্দামের মন্তব্যের পর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী হানাদার বাহিনী ঢাবির আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ করে। ছাত্রদের ওপর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা গুলি চালায়। ভয়াবহ আক্রমণে ২৯৭ জন ছাত্র আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নেয়। হামলার প্রতিবাদে আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগ উভয়ে সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়। ১৬ জুলাই : পুলিশের গুলিতে রংপুরে আবু সাঈদ, চট্টগ্রামে ওয়াসিম, শান্ত, ফারুক ও ঢাকায় সবুজ আলী ও শাহজাহান শাহদাতবরণ করেন। সাদ্দাম আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে বলে, আমরা দেখে নেব, কত ধানে কত চাল। ১৭ জুলাই : ঢাবিসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিতাড়িত করে 'রাজনীতিমুক্ত' ঘোষণা করে সাধারণ ছাত্ররা। পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কফিন মিছিল পণ্ড হয়ে যায়। সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছাত্র বিক্ষোভ, সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, গায়েবানা জানাজা, কফিন মিছিল এবং দফায় দফায় সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। রাত সাড়ে সাতটায় জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ। ছয়জন নিহত হওয়ার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হল বন্ধের ঘোষণা ও পুলিশের তৎপরতার মুখে অনেক শিক্ষার্থী সন্ধ্যা নাগাদ ক্যাম্পাস ছেড়ে যান। তবে হল বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে রাতেও অনেক ছাত্রছাত্রী হল ও ক্যাম্পাসে অবস্থান করছিলেন। মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় সরকার। ১৮ জুলাই : ছাত্রদের ঘোষণা অনুসারে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি শুরু হয়। সারাদেশের প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ মিছিলে হানাদার আওয়ামী পুলিশ বাহিনীর হামলা। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা এদিন আন্দোলনের মূল হাল ধরে। মুগ্ধসহ মোট ৪০ জন শাহদাতবরণ করেন। সংঘর্ষ বেশি হয় ঢাকায়। সারাদেশে বিজিবি মোতায়েন করে স্বৈরাচার সরকার। ১৯ জুলাই : শিক্ষার্থীদের 'কমপ্লিট শাটডাউন' বা সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, গুলি, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। দেশের বিভিন্ন জেলাতেও ব্যাপক বিক্ষোভ, সংঘর্ষ ও সহিংসতা হয়। পুলিশ ও বিজিবির নৃশংস গুলিতে ১১৯ জন শাহদাতবরণ করেন। এদিন আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নেয়। এদিন রাস্তায় ছাত্রদের চাইতেও বেশি ছিল নানান শ্রেণি পেশার মানুষ। বলাবাহুল্য সারাদেশের চেয়ে রাজধানী ঢাকা ছিল বেশি অগ্নিগর্ভ। ঢাকার যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, রামপুরা-বাড্ডা, সায়েন্সল্যাব, মিরপুর ১ ও ১০, মহাখালী, মোহাম্মদপুর, সাভার ছিল আন্দোলনের মূল হটস্পট। রাতে সারা দেশে কারফিউ জারি, সেনাবাহিনী মোতায়েন। সকল ইন্টারনেট সেবা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তথ্য অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় সারাদেশ। ২০ জুলাই : দেশজুড়ে কারফিউ, সেনা মোতায়েন। সাধারণ ছুটি ঘোষণা। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ, ধাওয়া ও গুলি। উল্লেখযোগ্য স্থান হচ্ছে, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, বাড্ডা, মিরপুর ও মোহাম্মদপুর। পুলিশ ও বিজিবির গুলিতে মোট ৭১ জন শাহদাতবরণ করেন। প্রধান সমন্বয়ক নাহিদকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক তিন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আট দফা দাবি পেশ। সমন্বয়কদের আরেকটি অংশ ৯ দফা দাবি পেশ করে। ২১ জুলাই : কোটা সংস্কার করে ৭% কোটা রেখে রায় প্রদান করে আদালত। এদিনও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন অব্যাহত থাকে। হানাদার পুলিশ ও বিজিবির নির্মম গুলিতে ৩১ জন শাহদাতবরণ করেন। চার দফা দাবি পূরণের জন্য বৈষম্যবারোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা ৪৮ ঘন্টা সময় বেঁধে দিলেন। চার দফা দাবির মধ্যে রয়েছে, ইন্টারনেট সংযোগ চালু করা, শিক্ষার্থীদের আসার ব্যবস্থা করে দিয়ে হল খুলে দেওয়া, আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং কারফিউ তুলে দেওয়া। এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন চারজন সমন্বয়ক। নাহিদকে ব্যাপক নির্যাতন করে রাস্তায় ফেলে রেখে যায় পুলিশ। ২২ জুলাই : কোটা সংস্কার করে প্রকাশিত রায়ের প্রজ্ঞাপনের প্রস্তুতি চলে। প্রতিদিন মানুষ হত্যার প্রতিবাদে সাধারণ ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। তবে আন্দোলন স্তিমিত হতে থাকে। এদিনও ১০ জন শাহদাতবরণ করেন। এর মধ্যে কয়েকজন ছিলেন আগের আহত হওয়া। ২৩ জুলাই : কোটাপ্রথা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি। সরকার কয়েক হাজার মামলা দিয়ে গণগ্রেপ্তার শুরু করে। ২৪ জুলাই : কোটা আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশীদের খোঁজ পাওয়া গেছে। নিখোঁজ থাকার পাঁচ দিন পর আসিফ ও বাকেরকে চোখ বাঁধা অবস্থায় ফেলে যাওয়া হয়েছে বলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে দুজনই জানিয়েছেন। আর রিফাত আত্মগোপনে আছেন। ব্লক রেইড দিয়ে গণগ্রেপ্তার চলছেই। ২৫ জুলাই : আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও অন্য অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই কোটা সংস্কারের যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে, সেটিকে তাঁরা চূড়ান্ত সমাধান মনে করছেন না। যথাযথ সংলাপের পরিবেশ তৈরি করে নীতিনির্ধারণী জায়গায় সব পক্ষের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে প্রজ্ঞাপন দিতে হবে। ২৬ জুলাই : এলাকা ভাগ করে চলছে 'ব্লক রেইড'। সারা দেশে অভিযান। সারা দেশে অন্তত ৫৫৫টি মামলা। গ্রেপ্তারের সংখ্যা ৬ হাজার ২৬৪। সাদা পোশাকে ডিবি হারুনের সন্ত্রাসীরা হাসপাতাল থেকে ছাত্রনেতাদের তুলে নিয়ে যায়। ২৭ জুলাই : ১১ দিনে গ্রেপ্তার ৯ হাজার ১২১ জন। আতঙ্কে মানুষ ঘরছাড়া। ছাত্রনেতাদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করতে থাকে ডিবি হারুন। ২৮ জুলাই : মোবাইল ইন্টারনেট ১০ দিন পর সচল। কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে হেফাজতে নিয়েছে ডিবি হারুন। ডিবি হারুন জোর করে গান পয়েন্টে ছাত্রনেতাদের দিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের বিবৃতি আদায় করে। আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক মাহিন সরকার, আব্দুল কাদের ও আব্দুল হান্নান মাসুদ অজ্ঞাত স্থান থেকে আগের বিবৃতি প্রত্যাহার ও ৯ দফা দাবী নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। ২৯ জুলাই : ছাত্র আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালনের জন্য খুনী হাসিনার নেতৃত্বে ১৪ দলের মিটিং-এ জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত হয়। একইসাথে ছাত্রআন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে খুনসহ অন্যান্য মামলা দিয়ে কঠোর শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় গণহত্যাকারী ১৪ দল। ডিবি হারুন কর্তৃক জোর করে বিবৃতি আদায়ের ঘটনায় ছাত্ররা আবার বিভিন্ন ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, জাবি ও রাবিতে পুলিশ ছাত্রদের ওপর হামলা করে। অনেক ক্যাম্পাসে ছাত্রদের সাথে শিক্ষকরাও বিক্ষোভ করে ৩০ জুলাই : হত্যার বিচার চেয়ে মুখে লাল কাপড় বেঁধে মিছিল করে ছাত্র ও শিক্ষকরা। জাতিসংঘ মহাসচিবের বিবৃতি, স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান। ফেসবুকের প্রোফাইল লাল রঙের ফ্রেমে রাঙিয়েছেন সারাদেশের মানুষ। গণহত্যাকারীরা কালো ফ্রেম দিয়েছে। তবে সেটা নিতান্তই নগণ্য। নাটক ও সিনেমা সংশ্লিষ্ট মানুষরা খুনী হাসিনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শণ করেন। ৩১ জুলাই : ছাত্ররা 'রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস' কর্মসূচি পালন করে। ৯ দফার পক্ষে জনমত গঠন করতে থাকে ছাত্ররা। সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের তোপের মুখে পড়েন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ঢাবির শিক্ষকরা সমন্বয়কদের ছাড়াতে ডিবি অফিসে গেলে পুলিশ তাদের হেনস্তা করে। পরিবারের সাথেও দেখা করতে দেওয়া হয়নি। ১ আগষ্ট : ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ভূমিকার জন্য জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। ছয় সমন্বয়ককে ছেড়ে দিয়েছে ডিবি। ২ আগষ্ট : ৯ দফা আদায়ের দাবিতে সারাদেশে গণমিছিল করে ছাত্র জনতা। রাজধানীসহ বিভিন স্থানে পুলিশের সাথে ছাত্র জনতার সংঘর্ষ হয়। পুলিশের গুলিতে ৩ জন শাহদাতবরণ করেন। পরিস্থিতি আবারো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে ১৫ হাজার মানুষ। ৩ আগস্ট : ৯ দফা না মেনে গণগ্রেপ্তার ও গণহত্যা চালু রাখার প্রতিবাদে শহীদ মিনারে বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ করে ছাত্র জনতা। সেনাপ্রধান তার সেনা কমান্ডার নিয়ে মিটিং করেন। সেখানে তিনি এই বার্তা পান যে, সেনাবাহিনী আর গুলি করতে প্রস্তুত নয়। কয়েক লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে নয় দফা বাদ দিয়ে ১ দফার (খুনী হাসিনার পদত্যাগ) ঘোষণা দেয় ছাত্রনেতারা। হাসিনা ছাত্রদের আলোচনা করার প্রস্তাব দেয়। প্রয়োজনে মন্ত্রীদের কয়েকজন পদত্যাগ করার ঘোষণাও দেন। ছাত্ররা সব আলোচনা নাকচ করে দেন। আবারও ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় সরকার। শহীদ আবু সাইদের খুনী দুইজন পুলিশ সদস্যকে বরখাস্ত ও গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ছাত্রজনতাকে রাস্তায় প্রতিহত করতে কড়া নির্দেশ দেয় খুনী হাসিনা। ৪ আগস্ট : রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ছাত্রজনতার বিক্ষোভ মিছিলে হামলা চালায় আওয়ামী সন্ত্রাসী। এদিন পুলিশের সাথে আওয়ামী সন্ত্রাসীরাও ছাত্রদের উপর গুলি করে। কিন্তু হাজার হাজার ছাত্র ইট পাটকেল দিয়ে সন্ত্রাসী ও হানাদার পুলিশ বিজিবিকে প্রতিরোধ করে। কয়েকটি স্থানে সেনাবাহিনীও গুলি করে। সারাদেশে ১৩০ জন খুন হন। পরদিন ঢাকামুখী লং-মার্চের কর্মসূচি দেয় ছাত্র জনতা। অনেক আওয়ামী সন্ত্রাসীদের অফিস ও বাড়িতে আগুন দেয় প্রতিশোধ পরায়ণ ছাত্র-জনতা। ৫ আগস্ট : সকাল থেকেই ব্যাপক মারমুখী অবস্থান নেয় পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী। সারা ঢাকা শহরে খন্ড খন্ড যুদ্ধ শুরু হয় ছাত্র জনতার সাথে। সকাল সাড়ে দশটার পর সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে হাসিনা পালিয়ে যায়। কর্মরত পুলিশরা এই খবর না জানিয়ে তারা জনতার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। অনেক মানুষকে তারা খুন করতে থাকে। সেনাবাহিনীর প্রধান দুপুর দুইটায় ভাষণ দিবেন বলে ঘোষণা দেন। ১২ টায় শাহবাগের পুলিশ ও সেনাবাহিনী রাস্তা ছেড়ে দেয়। ১টায় মানুষ জেনে যায়, হাসিনা পালিয়ে গেছে। সারাদেশের বিশেষভাবে ঢাকার মানুষ সব রাস্তায় নেমে নেচে গেয়ে উদযাপন করতে থাকে। গলিতে গলিতে মিষ্টি বিতরণ ও ঈদ মোবারক বলে কোলাকুলি করতে থাকে মানুষ। রাস্তায় রাস্তায় মানুষ সিজদা দিয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করতে থাকে। দেশে বিভিন্ন মোড়ে থাকা স্বৈরাচার মুজিবের সকল মুর্তি ভেঙ্গে দেয় আন্দোলনকারী ছাত্রজনতা। পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায় ও আত্মগোপন করে। অনেকেই ছাত্রজনতার কোপানলে পড়ে খুন হয়। রাজধানীর মানুষদের একটা বড় অংশ গণভবনে গিয়ে হাসিনার ওপর রাগ ক্ষোভ গণভবনের ওপর ঝাড়ে। ৬ আগস্ট : বাংলাদেশে উদিত হয় নতুন সূর্য। শাহাদাতের প্রেক্ষাপট রাজধানীর অদূরে অবস্থিত মুন্সিগঞ্জ বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রাচীন জনপদ। ঢাকা জেলার নিকটে অবস্থিত হওয়ার কারণেই যেকোনো আন্দোলন সংগ্রামের ঢেউ খুব দ্রুত এই অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এ অঞ্চলবাসী সারাদেশের ছাত্র-জনতার সাথে অংশগ্রহণ করে। অবৈধ স্বৈরাচার খুনি হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ ও আন্দোলন গড়ে তোলে। আন্দোলন দমাতে খুনি হাসিনার পেটুয়া বাহিনীর পাশাপাশি অন্যতম প্রধান শত্রু বিতর্কিত আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা তৎপর ছিল। পুলিশ, বিজিবি, আনসার, র্যাব মারণাস্ত্র হাতে নিরস্ত্র মানুষের ওপর নৃশংস আক্রমণ চালায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সারাদেশে ৪ আগষ্ট ২০২৪ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। উক্ত কর্মসূচিতে শহীদ সজল অংশগ্রহণ করেন। সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে আওয়ামী যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা দেশী-বিদেশী অস্ত্র নিয়ে এলোপাথাড়ি হামলা চালায়। ছাত্র-জনতার উপর গুলি বর্ষণ করে। সেই গুলিতে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তেজস্বী বীর শহীদ সজল। ঘটনাস্থলেই নিঃস্ব দিনমজুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। স্থানীয় লোকজন মুন্সিগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। শহীদের পরিবার সংক্রান্ত বিশেষ তথ্য দেশ মাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গকারী শহীদ সজলের ভিটে-মাটি, কৃষি জমি কিছুই নেই। ৭২ বছরের অসুস্থ বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে শহীদ ও তাঁর ভাই একত্রে সংসার গড়েছিলেন। সহোদরদ্বয় দিনমজুরি করে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করতেন। এই পরিবারের সদস্য সংখ্যা চারজন। বড় ভাই বিয়ে করে স্ত্রী পরিবার নিয়ে আলাদা বসবাস করছেন। উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারিয়ে শহীদ পিতা পাগলপ্রায় হয়ে পড়েছেন। বাকরুদ্ধ বৃদ্ধ বাবা প্রায়ই কান্নাকাটি করছেন। বিয়োগের যাতনায় মাঝে মাঝে জ্ঞানও হারিয়ে ফেলছেন। একনজরে শহীদ পরিচিতি নাম : মো: সজল পিতার নাম : মোহাম্মদ আলী আকবর মোল্লা মাতার নাম : মৃত সাহিদা বেগম জন্ম তারিখ : ২০ অক্টোবর ১৯৯৩ স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: উত্তর ইসলামপুর, ইউনিয়ন: উত্তর ইসলামপুর, থানা: মুন্সিগঞ্জ সদর, জেলা: মুন্সিগঞ্জ বর্তমান ঠিকানা : একই ভাই বোন : দুই ভাই (বিবাহিত) শহীদ হওয়ার স্থান : পিটিআই মোড় মুন্সিগঞ্জ সদর শহীদ হওয়ার সময় : ৪ আগস্ট ২০২৪,সকাল ১০:৩০ মিনিট যাদের আক্রমণে শহীদ : আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী প্রস্তাবনা ১. শহীদের বৃদ্ধ পিতার যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা ২. শহীদ পরিবারের সদস্যদের জন্য একটি স্থায়ী আবাসস্থল তৈরি করে দেয়া ৩. একেবারেই অসচ্ছল এই পরিবারটির জন্য একটি নিয়মিত আয়ের উৎস তৈরি করে দেয়া