জন্ম তারিখ: ২৫ নভেম্বর, ১৯৯৯
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা : চা-দোকানে কাজ করে, শাহাদাতের স্থান : কাজলা যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।
‘মারা গেলে আমার লাশ ফেলে যাইস না’ শহীদ পারভেজ হাওলাদার নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৯৯ সালের ২৫ নভেম্বর। অতি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণকারী শহীদ পারভেজ হাওলাদার বাল্যকালেই পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে জীবিকার তাগিদে চায়ের দোকানে কাজ নেন। চা দোকানের কর্মচারী শহীদ পারভেজ হাওলাদার সামান্য বেতন দিয়ে বৃদ্ধ মাকে নিয়ে ভাড়া বাসাতে দীনহীনভাবে জীবন যাপন করতেন। ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে বিজয়ের পূর্বমুহূর্তে যুবলীগ, ছাত্রলীগ, পুলিশ ও বিজিবির সম্মিলিত আক্রমণে গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাদত বরণ করেন। শহীদের স্বপ্ন পঁচিশ বছরের টগবগে যুবক পারভেজ হাওলাদার। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট। পরিবারের আদরের ছেলেটির স্বপ্ন ছিল বিদেশ যাবে। তারপর একটা সুন্দর বাড়ি করবে। সেই বাড়িতে মাকে নিয়ে থাকবে। তবে বাড়ি করতে না পারলেও পারভেজের নামে একটি সড়কের নামকরণ করেছে এলাকাবাসী। কারণ বাড়ি করার স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দিয়েছে একটি বুলেট। নিভে গেছে পারভেজের জীবন প্রদীপ। কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেয়া পারভেজ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মাত্র দুই ঘণ্টা আগে মাথায় বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। সকালে ফেসবুকে সে তার আইডি থেকে শেষ স্ট্যাটাস দেয় ‘আল্লাহ তুমি ভালো পরিকল্পনাকারী, আল্লাহ তুমি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের জীবনের খেয়াল রাইখো। দেশের জন্য দশের জন্য যেইটা ভালো হয় তাই কইরো আল্লাহ। আজকে যেন কোনো মায়ের কোল খালি না হয়। আমিন’। আর আন্দোলনের মাঠে বন্ধুদের বলেছিল, ‘আমি মারা গেলে আমার লাশ ফেলে যাইস না, পরিবারের কাছে লাশ পৌঁছে দিস, বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে যেন আমার দাফন না হয়’। শাহাদাতের প্রেক্ষাপট শহীদ পারভেজ হাওলাদারের জন্মস্থান নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে হলেও জীবিকার তাগিদে তিনি ঢাকায় বসবাস করতেন। চায়ের দোকানের একজন সামান্য কর্মচারী হয়েও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগদান করেন। ৫ আগস্ট ছিল স্বৈরাচার খুনি হাসিনার শাসনামলের শেষ দিন। এদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচির ঘোষণা দেন। বাংলাদেশের আর সব মুক্তিকামী জনতার সাথে শহীদ পারভেজও মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার সাথে যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া এলাকায় অবস্থান নেন। সিংহাসন রক্ষায় মরিয়া হাসিনা সরকার এদিন মরণ কামড় দেওয়ার পরিকল্পনা এবং ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর তৎপরতায় সে পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তবুও মাঠে তৎপর ছিল আওয়ামী হায়েনা গোষ্ঠী ও তাদের দোসররা। শেষ পর্যন্ত লেজ গুটিয়ে তাদের রক্ষক ও প্রশ্রয়দাতা ভারতের দিল্লিতে পালিয়ে যায় খুনি হাসিনা। বিজয়ের একেবারে পূর্ব মুহুর্তে দুপুর ১২টা ২৫ মিনিটে যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া এলাকায় যুবলীগ, ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, পুলিশ ও বিজিবি মুক্তিকামী ছাত্র জনতার উপর সশস্ত্র আক্রমণ করে। এদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই শাহাদাত বরণ করেন শহীদ পারভেজ হাওলাদার। সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলি শহীদ পারভেজ হাওলাদারের মুখ দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন অংশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। শহীদ সম্পর্কে মন্তব্য পারভেজের বড় বোন সেলিনা আক্তার বলেন, “আমি আমার বোন রোকসানা ও আমার মেয়ে মাহমুদা আক্তার কোটা সংস্কার আন্দোলনে সাইনবোর্ড এলাকায় কয়েকদিন গিয়েছি।” যখন একের পর নিহত হচ্ছিল ছাত্ররা। তখন পারভেজ বলে, তোমরা বাসায় থাকো। গুলি খেয়ে মরে গেলে তো এক কথা। আর না মরলে পঙ্গু হয়ে গেলে তো তোমার মেয়ের বিয়ে দিতে পারবা না। তার ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যাবে। তখন তাকে বলি ঠিক আছে আমরা যখন আন্দোলনে যাবো না তাহলে তুমিও যেতে পারবে না। সে বলে আচ্ছা কিন্তু সকালে নাস্তা খেতে যাওয়ার কথা বলে বেরিয়ে যায়। সকাল ১০টার দিকে ফোন দিলে বলে ঠিক আছি কোনো চিন্তা করো না। বলি সাবধানে থাকিস। বলে কোনো সমস্যা নাই। আবার ১১টার দিকে ফোন দিলে বলে, ঠিক আছি। সাড়ে ১১টায় বন্ধু মহসিনকে বলে‘ ‘আমি মারা গেলে আমার লাশ ফেলে যাইস না, পরিবারের কাছে লাশ পৌছে দিস, বেওয়ারিশ ভাবে যেন আমার দাফন না হয়’। ১২ টার পর শাকিল ফোন করে বলে পারভেজ মারা গেছে। কান্নাজড়িত কন্ঠে সেলিনা আক্তার বলেন, ‘পারভেজ বলতো আমি ছাত্র ছিলাম। এখন ছাত্রদের আন্দোলনে কি ঘরে বসে থাকা যায়। জীবন দিয়ে হলেও তাদের সঙ্গে আছি। আর্থিক সংকটের কারণে বেশিদূর পড়তে পারেনি সে। এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডারের দোকানে কাজ করে সংসারে কিছুটা সহায়তা করতো। আর বলতো আমাকে বিদেশ পাঠিয়ে দাও। বিদেশ গিয়ে এই নিমাইকাশারীতে একটা বাড়ি করবো। সবাইকে নিয়ে সেই বাড়িতে থাকবো। বলতাম এতো টাকা কই পাবো। ধৈর্য ধরো, টাকা যোগাড় হলে বিদেশ পাঠাবোনে। সে বলতো ‘স্বপ্ন দেখতে সমস্যা নাই। স্বপ্ন পুরন করবো আল্লাহ’। কিন্তু ভাইয়ের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেলো। পারভেজের মা হাসি বেগম বলেন, গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি দিঘীরপাড় এলাকায় নদী ভাঙ্গায় সব শেষ হয়ে গেছে। ৩৫-৪০ বছল আগে গ্রাম থেকে চলে আসি। স্বামী মজিবুর রহমান ঢাকার সদরঘাটে ফেরি করে। কালিগঞ্জের চরে আশ্রয় নেই। এরপর পারভেজের বয়স যখন ৬ বছর তখন নিমাইকাশারী এলাকায় ভাড়া বাসায় উঠি। গ্রামে কিছুই নাই। তাই এখানেই ভোটার হই। ১৪ মাস আগে পারভেজের বাবা মারা যায়। সবার ছোট পারভেজ অনেক আদরের সন্তান ছিল আমার। মাঝে মাঝেই আমার হাতে খেত। ৪ আগস্ট রাতেই নিজ হাতে খাওয়াইছি। আজ আমার বাবা (পারভেজ) নাই। কান্নায় ভেঙে পড়েন হাসি বেগম। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার কিছু চাওয়ার নাই। আমার ছেলেকে যেন মানুষ ভুলে না যায়। সে দেশের মানুষের জন্য শহীদ হয়েছে। সরকার যেন তার নাম শহীদ হিসেবে লিখে রাখে। শহীদ পরিবারের বিশেষ তথ্য শহীদ পারভেজ হাওলাদার জন্মগ্রহণ করেছিলেন একেবারেই নিঃস্ব পরিবারে। বাবা মজিবর হালদার অনেক আগেই মৃত্যুবরণ করেন। ষাটোর্ধ্ব অসুস্থ বৃদ্ধ মাকে নিয়ে ছিল তার সংসার। বাবার ভিটে বাড়ি এবং জমিজমা কিছুই নেই। বড় ভাই ফারুক হাওলাদার (৪৬) বিবাহ করে আলাদা সংসার করছেন। বোন হালিমা বেগম (৪০), সেলিমা বেগম(৩৬) ও রোকসানা আক্তার (২৭) গৃহিণী। তার মা বর্তমানে একাকী নিঃস্ব অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ব্যক্তিগত প্রোফাইল নাম : শহীদ পারভেজ হাওলাদার পিতার নাম : মৃত মোঃ মজিবর হালদার মাতার নাম : হাসি বেগম (৬০) জন্ম তারিখ : ২৫ নভেম্বর, ১৯৯৯ স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম- নিমাইকাশারী, ইউনিয়ন: সিদ্ধিরগঞ্জ, থানা: সিদ্ধিরগঞ্জ, জেলা: সিদ্ধিরগঞ্জ বর্তমান ঠিকানা : নিমাইকাশারী, সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ বৈবাহিক অবস্থা : অবিবাহিত আহত হওয়ার স্থান : কাজলা যাত্রাবাড়ী, ঢাকা আহত হওয়ার সময়কাল : ৫ আগস্ট ২০২৪ শহীদ হওয়ার সময় : দুপুর ১২ঃ২৫ মিনিট যাদের আক্রমনে শহীদ : যুবলীগ, ছাত্রলীগ, পুলিশ এবং বিজিবি প্রস্তাবনা ১. শহীদ পরিবারের জন্য একটি স্থায়ী আবাসন তৈরি করে দেওয়া ২. শহীদের বৃদ্ধ মায়ের জন্য নিয়মিত ভাতার ব্যবস্থা করা ৩. শহীদের বৃদ্ধ মায়ের চিকিৎসার খরচ নির্বাহ করা