জন্ম তারিখ: ১ জুন, ২০০৯
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা : ছাত্র, শাহাদাতের স্থান : মিরপুর ১০, ঢাকা।
শহীদ রুস্তম, জুলাই আন্দোলনের এক অমর বীর, যাঁর জীবন থমকে গিয়েছিল এক নির্মম ঘটনার সাক্ষী হয়ে। ২০০৯ সালে মায়ের কোল জুড়ে যেন চাঁদ নেমে আসে রুস্তমের জন্মের মাধ্যমে। নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে সবুজ ঘাসের গালিচা আর মেঠোপথের বুক চিরে যে শিশুটি একদিন খেলা করত। সেই রুস্তমের জীবনের গল্প আজ ইতিহাসের পাতায় লেখা। মাটির গন্ধে মিশে থাকা তাঁর শৈশব ছিল নিস্তব্ধ প্রকৃতির মাঝে এক প্রাণবন্ত গান। সরলতা, চঞ্চলতা আর সদা হাস্যমুখের রুস্তম যেন গ্রামবাংলার সেই চিরায়ত ছেলেটি। যার হাসিতে ভরে উঠত সবার হৃদয়। রুস্তমের বাবা মাইনুদ্দিন ছিলেন টেইলারিং দোকানের এক শ্রমিক। অর্থের টানাপোড়েনের মাঝেও ছেলেকে মানুষ করার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। মির্জাপুরের ছোট্ট ঘর থেকে রাজধানীর মিরপুরের ন্যাশনাল বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীতে পড়াশোনা করা রুস্তম জীবিকার তাগিদে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন। শহরের কোলাহলে মিশে গেলেও তাঁর হৃদয়ে ছিল গ্রামের সবুজ প্রান্তর আর মেঠোপথের স্মৃতি। শহীদ পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা: শহীদ রুস্তমের পরিবার যেন অভাব-অনটনের এক নির্মম প্রতিচ্ছবি। নরসিংদীর মির্জাপুর গ্রামের মাটির ঘরে বাস করা এই পরিবারটি প্রতিদিন সংগ্রামের নতুন অধ্যায় লেখে। বাবা মাইনুদ্দিন জীবিকার তাগিদে ঢাকায় দর্জির কাজ করেন। দিনের পর দিন সেলাই মেশিনের চাকার সঙ্গে লড়াই করে পরিবারের মুখে আহার তুলে দেন। মা গার্মেন্টসে চাকরি করে, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘাম ঝরিয়ে যে আয় করেন, তা দিয়েও সংসারের অভাব মেটে না। তিনটি সন্তানের এই সংসারে প্রতিটি দিনই যেন এক যুদ্ধ। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর বাস্তবতা তাঁদের প্রতিটি শ্বাসে জড়িয়ে আছে। একদিকে বাবা-মার নিরন্তর পরিশ্রম, অন্যদিকে সন্তানদের প্রতি দায়িত্ব পালনের চেষ্টায় ক্লান্ত এই পরিবার। তাঁদের দিন শুরু হয় সংগ্রামের কথা ভেবে, রাত ফুরোয় নতুন সংকটের শঙ্কায়। শহীদের বোনের অনূভূতি ‘ছবির ছেলেটা আমার ভাই, আমার আদরের ছোট ভাই। আমরা তাকে কী পরিমাণ ভালোবাসি এটা হয়তো কখনো আর তাকে বলা হবে না, সুযোগই নেই? যেদিন প্রথম ও এসেছিল, সেদিন আমাদের থেকে খুশি আর কেউ ছিল না। ১১ই নভেম্বর এ আমার ছোট ভাইটার ১৬ বছর হওয়ার কথা ছিল। কত হাসিখুশি ছিলাম আমরা। এখন বুকে শুধু হাহাকার, কী যেন নাই, নাই, তো নাই!!!!!!!! যেভাবে শাহাদাত বরণ করেন- ২০২৪ সালের ১৯ জুন, শুক্রবার। ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বর রোড বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল সারাদিন। অন্যায় আর শোষণের বিরুদ্ধে তরুণদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর সেই দিন নতুন এক ইতিহাস লিখেছিল। আর সেই ইতিহাসের অংশ হয়ে চিরতরে মিশে গিয়েছিল শহীদ রুস্তম। রুস্তম ছিলো প্রতিবাদের এক জ্বলন্ত প্রতীক। গ্রামের সবুজ প্রান্তর থেকে শহরের কোলাহলে এসে সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস জুগিয়েছিল। বৈষম্যের বিরুদ্ধে তার হৃদয়ে ছিল এক অগ্নিশিখা। পরিবারের অভাব-অনটন আর প্রতিদিনের সংগ্রামের মাঝেও রুস্তমের চোখে ছিলো পরিবর্তনের স্বপ্ন। কিন্তু আন্দোলনে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি সহজ ছিল না। রুস্তমের মা-বাবা তাকে বারবার বাধা দিয়েছিলেন। মা গার্মেন্টসে কাজ শেষে ক্লান্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, “বাবা, তুই এসবের মধ্যে যাস না। তোর তো পড়াশোনা আছে। তোর জন্য আমাদের কত স্বপ্ন!” বাবা মাইনুদ্দিন কড়া গলায় বলেছিলেন, “পরিবারের অবস্থাটা তো দেখছিস! আন্দোলন করে কী হবে?” কিন্তু রুস্তম থেমে থাকেনি। তার হৃদয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল। বাকবিতণ্ডা আর অশ্রুতে ভেজা পরিবারের মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে সেদিন সে চলে গিয়েছিল আন্দোলনের মিছিলে। মিরপুর ১০ এর রাস্তায় হাজারো তরুণের সঙ্গে রুস্তমও সেদিন শ্লোগানে মুখরিত করেছিল চারপাশ। “বৈষম্যের অবসান চাই, ন্যায়ের সমাজ চাই!”—এই শ্লোগান ছিল তার কণ্ঠে। কিন্তু সেই দিনটি এক নির্মম পরিণতির সাক্ষী হয়ে থাকবে। পুলিশের গুলিতে যখন আন্দোলনকারীদের রক্তে রঙিন হয়ে উঠল পথ, তখন রুস্তমও মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। বুক চিরে বেরিয়ে এলো তাজা রক্ত। রুস্তমের হাসি থেমে গেল চিরতরে, আর তার স্বপ্নগুলো মিশে গেল শহরের উত্তপ্ত বাতাসে। তার শাহাদাতের খবর গ্রামে পৌঁছালে রুস্তমের মা-বাবার বুক ভেঙে গেল। মায়ের কান্নায় ভারী হয়ে উঠল আকাশ-বাতাস। বাবা শুধু চুপ করে বসে ছিলেন, যেন সব কিছুই স্তব্ধ হয়ে গেছে। পরিবারের সেই ছোট্ট আশার প্রদীপটি নিভে গেল এক নির্মমভাবে। শহীদ রুস্তম আজ নেই, কিন্তু তার প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর থেমে যায়নি। তার আত্মত্যাগ নতুন প্রজন্মকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে। রুস্তম শুধু একটি নাম নয়, সে এক আদর্শ, এক সংগ্রাম, এক অমর স্মৃতি। ব্যক্তিগত প্রোফাইল নাম : মো: রুস্তম পেশা : ছাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : মিরপুরের ন্যাশনাল বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়। শ্রেণী: নবম জন্ম : ২০০৯ পিতা : মাইনুদ্দিন, পেশা: টেইলর দোকানের কর্মচারী মাতা : সোফিয়া বেগম জন্মস্থান : মির্জাপুর, রায়পুর , নরসিংদী পরিবারের সদস্য : বর্তমানে ৪ জন। এক ভাই, এক বোন শাহাদাতের তারিখ : ১৯ জুলাই ২০২৪ শাহাদাতের স্থান : মিরপুর ১০, ঢাকা কবর : গ্রামের পারিবারিক গোরস্থানে প্রস্তাবনা- ১. মাসিক আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করা ২. বাকী দুই সন্তানের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা ৩. হত্যাকারীদের বিচার দ্রুত নিশ্চত করা।