জন্ম তারিখ: ১২ ডিসেম্বর, ২০০১
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৮ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা : শিক্ষার্থী, শাহাদাতের স্থান : ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাকিজা পয়েন্টে।
২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সাভারের প্রথম ও চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী শহীদ শাইখ আস-হা-বুল ইয়ামিন (১২ ডিসেম্বর ২০০১ - ১৮ জুলাই ২০২৪)। শহীদ ঢাকার উত্তরে অবস্থিত সাভার পৌরসভার গেন্ডা গ্রামের ব্যাংক টাউন এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ব্যবসায়ী পিতা মো: মহিউদ্দিন (৫৭) ও গৃহিনী মাতা মোসা: নাছরীন সুলতানার (৫১) একমাত্র পুত্র সন্তান। ইয়ামিন মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৮ জুলাই ২০২৪ দুপুর ৩ টায় পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে শহীদ হন এবং সাঁজায়ো যানেই সড়ক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একপর্যায়ে টেনে ফেলে দেওয়া হয় সড়কে। এই ঘটনা দেশে ও আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ব্যক্তিগত জীবন ছাত্র হিসেবে ইয়ামিন অনেক মেধাবী ছিলেন। ফলে সহজেই তিনি বুয়েটে এবং মেডিকেলে ভর্তির যোগ্যতা অজর্ন করেন। কিন্তু পছন্দের বিষয় হিসেবে ইয়ামিন এমআইএসটির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে ভর্তি হন। ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে তিনি এই বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। দুই ভাইবোনের মধ্যে ইয়ামিন ছোট। বড় বোন শায়েখ আসহাবুল জান্নাত শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। বাবা মো. মহিউদ্দিন সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা বর্তমানে ব্যবসায়ী। ইয়ামিন ২০১৮ সালে সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল থেকে এসএসসি, ২০২০ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে অসাধারণ ফলাফল করে তাক লাগিয়ে দেন। গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ইয়ামিনের ভূমিকা গণ-অভ্যুত্থানের শুরু থেকেই শহীদ ইয়ামিন অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। তার ফেসবুক পোস্ট থেকে জানা যায় ইয়ামিন শুধু কোটা সংস্কার নয়; সমগ্র রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজন তুলে ধরেন। মৃত্যুর ১২ ঘণ্টা আগে একটি পোস্টে তিনি লেখেন: “শুধু কোটা নয়; গোটা দেশটাই সংস্কার প্রয়োজন।” গণ-আন্দোলন যখন তুঙ্গে এবং কর্তৃপক্ষের কৌশল যখন আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করছে তখন ইয়ামিন অন্য আরেকটি পোস্টে লেখেন: “আমি মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি)-তে অধ্যয়নরত একজন শিক্ষার্থী। চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য যদি আমাদের প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে কর্তৃপক্ষ কোনোভাবে হেনস্তা করে, হুমকি দেয় বা বহিষ্কার করে, সেক্ষেত্রে আমরা সম্মিলিতভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য সকল প্রকারের একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করার ঘোষণা দিব। ইতোমধ্যে আমাদের হলে অবস্থানরত ছাত্র-ছাত্রীদের ১৭ জুলাই দিনগত রাতে অন্যায়ভাবে হল থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করেছিল কর্তৃপক্ষ, যা আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বিশাল বড় নিরাপত্তার ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একইসঙ্গে আমরা এখন থেকে এমআইএসটিতে সংঘটিত সব ধরনের অনুষ্ঠান, ক্লাব কার্যক্রম, খেলাধুলা ইত্যাদি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।” ইয়ামিন যেভাবে শহীন হন ২০২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানে সাভারে ছাত্র-জনতা ফুঁসে ওঠে। ইয়ামিন শহীদি প্রেরণায় উজ্জীবিত ছিলেন। গত ১৮ জুলাই সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাকিজা পয়েন্টে আন্দোলনরত নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম, অপস অ্যান্ড ট্রাফিক) আবদুল্লাহিল কাফী, সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহিদুল ইসলাম ও সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ জামানের নির্দেশে ও নেতৃত্বে খুব কাছ থেকে গুলি করা হচ্ছিল সেদিন। বিক্ষোভের প্রতীক হয়ে পুলিশের সাঁজোয়া যানের সামনে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ইয়ামিন। গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয় তার বুক। তারপর আন্দোলনকারীদের ‘শিক্ষা’ দিতে গুলিবিদ্ধ মুমূর্ষু ইয়ামিনকে সাঁজায়ো যানেই সড়ক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একপর্যায়ে টেনে ফেলে দেওয়া হয় সড়কে। এ ঘটনার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও ফলাও করে প্রচারিত হয় ইয়ামিন হত্যাকাণ্ডের এই দৃশ্য। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা জানান, ইয়ামিনকে পুলিশ ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যার পর যে নৃশংসতা দেখিয়েছে, তা বর্বরতাকেও হার মানায়। প্রত্যক্ষদর্শীর সূত্রে জানা যায়, ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার দুপুরে আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অভিমুখে অগ্রসর হলে পাকিজা, রেডিও কলোনিসহ বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ তাদেরকে বাধা দেয়। এ সময় সশস্ত্র ছাত্রলীগও পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয়। বেলা ১১টা পর্যন্ত সাভারের সার্বিক পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিকই ছিল। পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে ১১টার পর থেকে। ১১টার দিকে সর্বপ্রথম এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সাভারের ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাকিজা মোড় এলাকায় অবস্থান নিয়ে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। এরপর বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর সদস্যরা পাকিজা এলাকায় অবস্থান নেন। পুলিশ তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল নিক্ষেপ শুরু করলে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রায় একই সময়ে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যদের পাশাপাশি ঘটনাস্থলে মাথায় হেলমেট পরে সশস্ত্র অবস্থান নেন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সংগঠনের কয়েকশ নেতাকর্মী। তাদের সবার হাতে লোহার রড, বাঁশের লাঠি, রামদা; এমনকি বেশ কয়েকজনের হাতে পিস্তল ও শটগান ছিল। দফায় দফায় সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার বিপরীতে চলতে থাকে পুলিশের রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিপেটা। এই সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন গুলিবিদ্ধসহ আহত হয় দেড় শতাধিক। বেলা পৌনে ৩টার দিকে একে একে গুলিবিদ্ধদের নেওয়া হয় সাভারে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে আহত শিক্ষার্থী, পথচারী ও উৎসুক জনতার ভিড়ে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে দেখা যায় কর্তব্যরত চিকিৎসকদের। খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন ইয়ামিনের পরিবার ও স্বজনরা। এর পরপরই একটি অটোরিকশায় করে গুলিবিদ্ধ গুরুতর আহত ইয়ামিনকে এনাম মেডিকেল হাসপাতালে আনার পর তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। তাঁর পকেটে থাকা এমআইএসটির পরিচয়পত্র পেয়ে তাঁর পরিচয় নিশ্চিত হয়। এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. মিজারুল রেহান পাভেল ও ডা. হাসান মাহবুব ইয়ামিনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘অসংখ্য রাবার বুলেটে ঝাঁঝড়া হয়ে অধিক রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে’। এ-সময় তাদের আর্তনাদে ভারি হয়ে ওঠে সেখানকার বাতাস। ইয়ামিনের মতো মেধাবী শিক্ষার্থীকে এভাবে কোটা সংস্কারের দাবিতে প্রাণ দিতে হবে এটা মেনে নিতে পারছে না অনেকেই। প্লাটফর্ম এক্স স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব সাভার ক্যান্টমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের জেনারেল সেক্রেটারি ব্যাংকার ফাহিম দাদ খান রূপক ফেসবুকে শোক জানিয়ে লিখেছেন, “শাইখ আসাবুল ইয়ামিন মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির সিএসসির শিক্ষার্থী ছিল। আমি জানি না কীভাবে এই মৃত্যুর ভার সইবে তার পরিবার ও স্বজনরা। এভাবে তার মৃত্যু সত্যিই অকল্পনীয়।” শহীদের বাবা ও এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর প্রতিক্রিয়া নিজের সন্তানের ছবি দেখিয়ে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সাভারের প্রথম শহীদ শাইখ আশহাবুল ইয়ামিনের বাবা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন বলেন: ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় আমার সন্তান শাইখ আশহাবুল ইয়ামিনের বুক। দুনিয়া-আখেরাত উভয় বিচারে আমার সন্তান শহীদ। তাকে গোসল করানো হয়নি, কাফন দেওয়া হয়নি। বরং যে কাপড়ে সে শহীদ হয়েছে, সে কাপড়েই জানাজা পড়ে দাফন করেছি আমার কলিজার টুকরাকে।’ শহীদ হওয়ার পর ইয়ামিনের ঘনিষ্ট এক বন্ধু ফেসবুক পোস্টে লেখেন: “ইয়ামিন বুয়েটে চান্স পাইছিলো, মেডিকেলেও পাইছিলো এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো, আমি না পড়লে টেনে নিয়ে যাইতো। সে সুন্নাত পালনের জন্য রোজাও রাখতো ছাত্র অবস্থাতেই। ইয়ামিন সেদিন বৃহস্পতিবার রোজা ছিলো। রোজা অবস্থাতেই সে জোহরের নামায মসজিদে পড়ে ছাত্রদের বাঁচাতে যেয়ে নিজে গুলি খেয়ে শহীদ হয়। ওর আব্বুর পুরা ফ্যামিলি নিয়ে মালয়েশিয়াতে শিফট করার কথা ছিল কিন্তু তারা যায়নি, ইয়ামিনের দেশপ্রেমের জন্য। ওকে ফিউচারের কথা জিজ্ঞেস করলে বলতো খুব সিম্পল লাইফ চায় আজীবন। শুনে অনেক রাগ উঠতো আমার। অনেক পটেনশিয়ালিটি ছিলো ওর মধ্যে। আমাকে সবসময় বলতো, মানুষকে আমার ক্রিয়েটিভিটি দেখানো উচিত। আমি ওকে শেখ ইয়ামিন বলতাম; কারণ আমার জীবনের সব সমস্যার উত্তর ওর কাছে ছিল। আর দেখবো না ইয়ামিনকে মৃদু নিষ্পাপ মিষ্টি হাসি মুখটা নিয়ে সবার শেষে হলের ডায়নিং-এর খাবার খেতে বসতে। আর দেখবো না হাস্যোজ্জ্বল মায়াবী মুখটা সবার সব সমস্যার সহজ বুদ্ধিদীপ্ত সমাধান করে দিচ্ছে নিঃস্বার্থভাবে। তার কাছে গেলে কেমন শান্তি শান্তি লাগতো। নিজে সবচেয়ে বিনয়ী হয়ে যেমন সবার সমস্যার সমাধান দিতো, তেমনভাবেই ছাত্রদেরও! দাফনে বাধা প্রদান শাইখ আশহাবুল ইয়ামিনের বাবা মহিউদ্দিন জানান, ইয়ামিনকে গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায় প্রথমে দাফন করার চেষ্টা করি। সব প্রস্তুতি নেওয়ার পর সেখানকার থানা থেকে জানানো হয়, ময়নাতদন্ত ছাড়া কোনো লাশ সেখানে দাফন করতে দেওয়া হবে না। তারপর সাভারের তালবাগের কবরস্থানে দাফন করার চেষ্টা করলে সেখানেও একই অজুহাতে বাধা দেওয়া হয়। অবশেষে ব্যাংক টাউন কবরস্থানের সভাপতির আন্তরিক প্রচেষ্টায় আমার সন্তানকে সেখানেই চিরনিন্দ্রায় শায়িত করার সুযোগ পাই। ব্যক্তিগত প্রোফাইল নাম : শহীদ শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন পিতা : মো: মহীউদ্দিন মাতা : মোসা: নাছরীন সুলতানা পেশা : শিক্ষার্থী জন্ম তারিখ ও বয়স : ১২ ডিসেম্বর ২০০১, ২৩ বছর আহত ও শহীদ হওয়ার তারিখ : ১৮ জুলাই ২০২৪ শাহাদাৎ বরণের স্থান : ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাকিজা পয়েন্টে দাফনের স্থান : ব্যাংক টাউন কবরস্থান, সাভার পৌরসভা স্থায়ী ঠিকানা : গেন্ডা গ্রাম, ব্যাংক টাউন, সাভার পৌরসভা ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : মধ্যবিত্ত পরিবার