জন্ম তারিখ: ১৮ আগস্ট, ১৯৮৭
শহীদ হওয়ার তারিখ: ২০ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা :ব্যবসায়ী, শাহাদাতের স্থান :বোর্ড বাজার, বেস্ট বাই শোরুম এর সামনে
“বাবা ডাকটি আর কখনো ডাকতে পারবো না।” মো: মোশারফ (আগস্ট ১৯৮৭ - আগস্ট ২০২৪) জুলাই বিপ্লবের অন্যতম একজন শহীদ। তাঁর পিতার নাম জনাব আব্দুর রাজ্জাক হাওলাদার এবং মাতার নাম মোছা: রাজিয়া বেগম। আওয়ামী নরপিশাচদের নির্মমতার শিকার হন শহীদ মোশারফ। ব্যক্তিগত ও কর্মজীবন শহীদ মোশারফ ১৮ আগস্ট ১৯৮৭ সালে মাদারীপুর জেলার কালকিনী উপজেলার মৃধা কান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মাতা দুজনেই গ্রামের বাড়িতে থাকেন। ব্যবসায়িক সূত্রে তিনি পরিবার নিয়ে গাজীপুরের বোর্ডবাজার এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। শহীদ মোশারফ একজন ব্যবসায়ী। গাজীপুরের বোর্ডবাজারে তাঁর মেশিনারীজ এর ব্যবসা ছিল। পারিবারিক জীবন ও অর্থনৈতিক অবস্থা শহীদ মোশারফ একজন ব্যবসায়ী। তিনি মূলত মেশিনারীজ এর ব্যবসা করতেন। তার প্রতিষ্ঠানের নাম এম আর ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ। দেশের নাজুক পরিস্থিতির জন্য ব্যবসায়ে ধ্বস নামে। বেচাকেনা ঠিকমত না হওয়ায় অনেক লোকসান গুনতে হয় তাকে। ব্যবসা ধরে রাখার জন্য অনেক টাকা ঋণ করতে হয় তাঁকে। কিন্তু তাতেও কোন লাভ হয় না। বর্তমানে তার ব্যবসা প্রায় বন্ধের উপক্রম। তার বর্তমান ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ টাকা। তার মৃত্যুর পর পরিবারে এক শোকের ছায়া নেমে আসে। তাঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে জিসান ইসলাম ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ে। ছোট ছেলে মোঃ মুবিন ইসলাম এর বয়স ৬ বছর আর মেয়ে রাইসা ইসলাম এর বয়স ২ বছর। বাবার মৃত্যুতে ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তাদের দায়িত্ব নেওয়ার মত কেউ নেই। জুলাই বিপ্লবের প্রেক্ষাপট ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উদ্দীন আহমেদের পাতানো নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনা। ভারতের মধ্যস্থতায় শেখ হাসিনা এই নিশ্চয়তা দেয় যে, মইন উদ্দীন আহমেদ ও তার দোসরদের দুই বছরের সকল অপরাধের দায়মুক্তি দেওয়া হবে। হলোও তাই। ২০০৭-২০০৮ এই দুই বছরের সেনাশাসনের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা অনেক বিষোদগার করলেও কুশীলবদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ভারতের মধ্যস্থতায় বিনা ভোটে ক্ষমতায় এসে সাধারণ মানুষের জনজীবন বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। পিলখানার হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সেনাবাহিনীকে পোষা বিড়ালে পরিণত করা হয়েছে। হাসিনা বাংলাদেশের মানুষের মাথার ওপর চেপে বসেছে জগদ্দল পাথরের মতো। এ যেন রূপকথার ভয়ংকর ডাইনি। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন ক্রমেই জনসাধারণের আন্দোলনে রূপ নেয়। এটি বৈষম্যবিরধী ছাত্র-জনতা আন্দোলন হিসেবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে সাধারণ ছাত্রদের অহিংস আন্দোলন ধীরে ধীরে ফ্যাসিস্ট সরকার বিরোধী অভ্যুত্থানের দিকে ধাবিত হতে থাকে। পর্যায়ক্রমে এ আন্দোলন শুধু ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; হয়ে উঠে দেশের আপামর জনতার এক বিশাল গণঅভ্যুত্থান। জাতি,ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এ অভ্যুত্থানে একাত্মতা প্রকাশ করে রাজপথে বেরিয়ে আসে। ক্ষুব্ধ জনতার তোপের মুখে স্বৈরাচার সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু পদত্যাগের পূর্বে তিনি রেখে যান তার ঘৃণ্য ও বিকৃত মস্তিষ্কের অজস্র কুকীর্তি। এরই অংশ হিসেবে আন্দোলনকারী সহ অনেক নীরিহ জনতার উপর লেলিয়ে দেয়া হয় সশস্ত্র বাহিনী। তাদের গুলিতে শহীদ হয় জনতা। জুলাইয়ের শুরু থেকেই কোটা সংস্কার আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। প্রতিদিনই ছাত্ররা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন নিয়ে শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট গুলোতে অবস্থান করে। ১৫ জুলাই সাধারণ ছাত্ররা নায্য দাবী আদায়ের লক্ষ্যে শাহাবাগ ও ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয় এলাকায় অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকে। স্বৈরাচার সরকার ছাত্রদের নায্য দাবী আদায়ের আন্দোলনকে প্রতিরোধ করার জন্য অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে। ছাত্রদের দমন করতে সরকার তার দলীয় পোষা গুন্ডা ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দেয়। ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ইনানের নির্দেশে ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনী লোহার রড, হকিস্টিক, স্ট্যাম্প, রামদা, চাপাতি ও দেশীয় অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে নিরীহ ছাত্র-জনতার উপর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অতর্কিত হামলা চালায়। ছাত্রলীগের পোষা গোণ্ডা এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে ভাড়া করে আনা গোণ্ডাদের নিয়ে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার উপর হায়েনার মত ঝাপিয়ে পড়ে। তাদের হামলার হাত থেকে নিরস্ত্র বোনদেরও রক্ষা মিলেনা। রাস্তায় আটকিয়ে বোনদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরে তাদেরকে নির্বিচারে পিটাতে থাকে। রাতে স্বৈরশাসক খুনি হাসিনা এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে ছাত্র-জনতাকে রাজাকার বলে গালি দেয়। মুহুর্তেই ছাত্র-জনতা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। মধ্যরাতে ঢাবির হলগুলো থেকে ভেসে আসে, “তুমি কে আমি কে?-রাজাকার, রাজাকার।” মুহুর্তেই ৭১’র ঘৃণিত শব্দ ২৪ এ এসে মুক্তির স্লোগানে পরিণত হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলের মেয়েরা মধ্য রাতে রাজপথে নেমে আসে। ঢাকা সহ সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা একযোগে প্রতিবাদ জানায়। এরপর থেকে আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে। ক্রমেই ছাত্র-জনতার আন্দোলন গণ আন্দোলনে পরিণত হয়। সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ আন্দোলনে যুক্ত হতে থাকে। হুমকি, গুম-খুন, হত্যা, গ্রেফতার, জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে আন্দোলন দমনের সকল চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। শহীদ নুর হোসেন ছিলেন এই আন্দোলনের একজন সম্মুখ যোদ্ধা। বৈষম্যবিরোধী স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ৫ আগস্ট সোমবার ছাত্র-জনতা লং মার্চ টু গণভবন ঘেরাও ঘোষণা করে। সারাদেশ থেকে মুক্তিকামী জনতা গণভবনের দিকে রওনা করে। স্বৈরাচারের ঘাতক-দালাল আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও বিপথগামী পুলিশ সদস্যরা একত্রিতভাবে ছাত্র-জনতার উপর টিয়ারশেল, ছোররা, গ্রেনেড, বোমা, সাজোয়াজান ও আধুনিক অস্ত্র-সস্ত্র দিয়ে হামলা চালাতে থাকে। অসংখ্য মানুষ হামলায় আক্রান্ত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে আরও অনেকে। তবু ছাত্র-জনতা জুলুমের সাথে আপোষ করেননা। জালিমের বুলেটকে উপেক্ষা করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। ১৯ জুলাই বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলন দমনে সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করে। ঘাতক পুলিশ, আওয়ামীলীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী বাহিনী ছাত্র-জনতাকে টার্গেট করে টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, ছররা, ফাঁকা গুলি, গ্রেনেড, বোমা ইত্যাদি নিক্ষেপ করে। সেদিন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পুলিশ সাজোয়া যান ও আধুনিক অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়। শুধু তাই নয় স্বৈরাচারের হেলিকপ্টার ও উচু ভবনের উপর থেকে আধুনিক অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। অত্যাচার নির্যাতনের ঘটনার সংবাদ যেন বহির্বিশ্বে প্রচারিত হতে না পারে সেজন্য সরকার ১৯ জুলাই রাত ১০ টায় সারাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। দলীয় কর্মীদের দ্বারা শহরের বিভিন্ন স্থাপনা ভাংচূর করে আন্দোলকারীদের উপর দায় চাপানোর নোংরা রাজনীতি শুরু করে। পুলিশের গুলিতে অনেক মানুষ মারা যায়। এসব মৃত্যু সাধারণ মানুষের মনে পীড়া দেয়। যার ফলে মানুষ আর ঘরে থাকতে পারে না। শহীদের আর্তনাদ তাদেরকে রাজপথে নিয়ে আসে। শহীদ মাহফুজের শহীদ হওয়ার ঘটনা এমন একজন বীর শহীদ মোশারফ। ২০ জুলাই ২০২৪ শুক্রবার তিনি দুপুরে ভাত খেয়ে নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার জন্য রাস্তা পারাপার হচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় বোর্ডবাজার বেস্ট বাই শোরুমে পৌঁছালে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পেটুয়া পুলিশ ও বিজিবির যৌথ বাহিনী মোশারফকে লক্ষ্য করে অনবরত গুলি ছোড়ে। পেট ও বুকে গুল বিদ্ধ হলে তিনি রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। তার আশে পাশের মানুষ তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে হসপিটালে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁকে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের বেডে কাতরাতে কাতরাতে রাত বারোটার সময় তিনি শাহাদাত বরণ করেন। দাফন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে লাশ সংগ্রহ করে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই জানাজা এবং দাফন-কাফন সম্পন্ন করা হয়। একনজরে শহীদ মোশারফ নাম : শহীদ মোশারফ পেশা : ব্যবসায়ী জন্ম তারিখ : ১৮-০৮-১৯৮৭ বয়স : ৩৭ বছর পিতা : আ: রাজ্জাক হাওলাদার মাতা : মোছা: রাজিয়া বেগম শাহাদাতের তারিখ : ২০ জুলাই ২০২৪ শুক্রবার শাহাদাতের স্থান : বোর্ড বাজার, বেস্ট বাই শোরুম এর সামনে স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: মৃধা কান্দি, থানা: কালকিনী, জেলা: মাদারীপুর বর্তমান ঠিকানা : হোল্ডিং নং ২০১৪, পূর্ব কলমেশ্বর (বোর্ড বাজার), গাজীপুর প্রস্তাবনা ১. শহীদ পরিবারে মাসিক সহযোগিতা করা যেতে পারে ২. শহীদ সন্তানদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেয়া যেতে পারে শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়ের অনুভূতি শহীদ মোশারফের প্রতিবেশী মোসা: আছমা হক বলেন, আমরা ১২ বছর একসাথে পাশাপাশি বাড়িতে থাকছি। মোশারফ অনেক ভালো মানুষ ছিল। অনেক ধৈর্য্যশীল ও ভদ্র ছিল।