জন্ম তারিখ: ১২ সেপ্টেম্বর, ২০০৮
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৮ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা :ছাত্র, শাহাদাতের স্থান :আজমপুর
কী অপরাধ ছিল আমার ছেলের?” প্রশ্ন অসহায় মায়ের শহীদ রাহাত হোসেন শরিফ শহীদ রাহাত হোসেন শরীফ নবাব হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজে এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি ২০০৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর গাজীপুর জেলার গোপারপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শহীদ পিতা মো: সেলিম সৌদি আরবে থাকেন। মা স্বপ্না গার্মেন্টসে চাকরি করেন। রাহাত হোসেন শহীদ পিতা মাতার একমাত্র সন্তান ছিল। ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই উত্তরার আজমপুরে নওয়াব হাবিবুল্লাহ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে মানবিক বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। কলেজে ভর্তি হওয়ার মাত্র ৪ দিনের মাথায় পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন শহীদ রাহাত হোসেন ছিলেন একজন সচেতন তরুণ। তিনি ছিলেন সুদুর প্রসারি চিন্তার অধিকারী। সবসময় সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতেন। একটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দূষণ মুক্ত দেশ গড়তে চেয়েছিলেন। তাই তিনি “বিডি ক্লিনে” স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দেন। ২০২৩ সালের শুরুর দিক থেকে কাজ শুরু করেন। এর মাধ্যমে তিনি এলাকার বিভিন্ন সমাজসেবামুলক কাজে অবদান রাখেন। তাঁর নম্রতা, ভদ্রতা ও অমায়িক ব্যবহার দিয়ে সকলের মন জয় করে নিয়েছিলেন। শহীদ রাহাত হোসেন ছিলেন একজন নিয়মিত পাঠক। নিয়মিত তাঁর পাঠাগারে যাতায়াত ছিল। তাঁর পছন্দের তালিকায় ইতিহাস সম্পর্কিত বইগুলো বেশি স্থান পেয়েছে। পারিবারিক অবস্থা বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল শহীদ রাহাত। তাঁর পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৩ জন। শহীদ রাহাতের বাবা বিদেশ থাকায় ভরণ পোষণে তেমন সমস্যা হতো না। তাদের নিজস্ব কোন সম্পত্তি নেই। আন্দোলনে অংশগ্রহণ ২০২৪ সালের জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন ক্রমেই জনসাধারণের আন্দোলনে রূপ নেয়। এটি বৈষম্যবিরধী ছাত্র-জনতা আন্দোলন হিসেবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে সাধারণ ছাত্রদের অহিংস আন্দোলন ধীরে ধীরে ফ্যাসিস্ট সরকার বিরোধী গণ-অভ্যুত্থানের দিকে ধাবিত হতে থাকে। পর্যায়ক্রমে এ আন্দোলন শুধু ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; হয়ে উঠে দেশের আপামর জনতার এক বিশাল গণঅভ্যুত্থান। জাতি,ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এ অভ্যুত্থানে একাত্মতা প্রকাশ করে রাজপথে বেরিয়ে আসে। ক্ষুব্ধ জনতার তোপের মুখে স্বৈরাচার সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু পদত্যাগের পূর্বে তিনি রেখে যান তার ঘৃণ্য ও বিকৃত মস্তিষ্কের অজস্র কুকীর্তি। এরই অংশ হিসেবে আন্দোলনকারী সহ অনেক নীরিহ জনতার উপর লেলিয়ে দেয়া হয় সশস্ত্র বাহিনী। তাদের গুলিতে শহীদ হয় জনতা। জুলাই মাস জুরেই প্রতিবাদ মিছিল, আন্দোলন সংগ্রাম চলতে থাকে। ছাত্র সমাজের যৌক্তিক দাবীকে মেনে না নিয়ে বরং দমনের পথ বেছে নেওয়া হয়। আন্দোলন ক্রমান্বয়ে সহিংস রুপ ধারণ করতে থাকে। কোটা আন্দোলনকারীদের দমনে চরম ঘৃণ্য পন্থা অবলম্বন করে। আন্দোলনকারীদের উপর লেলিয়ে দেওয়া হয় ছাত্রলীগের গুণ্ডাদেরকে। ১৫ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর অতর্কিত হামলা চালায় ছাত্রলীগ। একদিকে নিরস্ত্র সাধারণ শিক্ষার্থী আর অন্য দিকে ছাত্রলীগের হাতে ছিল লাঠি, হকিস্টিক, লোহার রড, রামদা, চাপাতি সহ দেশীয় অস্ত্র-সস্ত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগসহ ঢাকার বিভিন্ন ইউনিটের ছাত্রলীগ কর্মীরা। ছাত্রলীগ একত্রিত হয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে হাত-পা ভেঙ্গে দেয়। রক্তাক্ত করে সাধারণদের। তাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়নি নিরীহ বোনরাও। ছাত্রীদের মেরে রক্তাক্ত করা হয়। এমন নির্মম ঘটনা ইতিহাসে বিরল। আহত হয়ে নিরীহ শিক্ষার্থীরা রাস্তায় পড়ে থাকে। পুলিশ প্রশাসন ছাত্রলীগের পক্ষ নিয়ে সাধারণদের উপর আক্রমণ করে। অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় সাধারণ ছাত্রদের। আহতদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হলে ছাত্রলীগ সেখানে গিয়েও বেডে শুয়ে থাকা আহত শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে। ভয়ে আহত অবস্থায় হাসপাতাল ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় অনেকে। ১৫ তারিখের পর থেকেই মুলত আন্দোলন চূড়ান্ত রুপ লাভ করে। কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলন শুরু হলেও তখন আর কোটা আন্দোলন থাকে না। সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হতে থাকে। সরকার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠে। সারা দেশে গণহত্যা চালায়। গণ গ্রেফতার, গুম, প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা চালিয়ে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করা হয়। ১৬ তারিখ দিনভর গণ গ্রেফতার ও গণহত্যা চালানো হয়। এসবের মাধ্যমে আন্দোলন থেমে যায় না বরং আরও বেড়ে যায়। আগুন জ্বলে উঠে। সেদিন রাতে ছাত্র জনতা ঢাবির হল থেকে ছাত্রলীগের গুন্ডাদেরকে হল থেকে বের করে দেয়। এরপর সরকার আরও ঘৃণ্য পন্থা অবলম্বন করে। ক্যাম্পাস গুলোতে নোটিশের মাধ্যমে রাতারাতি হল ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে চাপ প্রয়োগ করে। ঢাবি, জবি, জাবি সহ সারা দেশের ক্যাম্পাস গুলোতে একই ঘটনা ঘটায়। এরপর থেকে লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকে। রাহাতের শহীদ হওয়ার ঘটনা জুলাই বিপ্লবে ছাত্রদের ভুমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে স্কুল কলেজ মাদরাসা প্রাইভেট পাবলিক সবধরনের ছাত্ররা আন্দোলনে যোগ দেয়। একজন ছাত্র হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সর্বাত্মকভাবে সমর্থন করা একান্ত কর্তব্য। সেই কর্তব্য পালনে রাজপথে সরব ছিল শহীদ রাহাতও। ১৮ জুলাই ঢাকার সবগুলো পয়েন্টে ছাত্রদের সাথে পুলিশ বিজিবি ও র্যাবের সদস্যদের সংঘাত চলে। আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র জনতার উপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি করে। ঘাতক পুলিশ, আওয়ামীলীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী বাহিনী ছাত্র-জনতাকে টার্গেট করে টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, ছররা, ফাঁকা গুলি, গ্রেনেড, বোমা ইত্যাদি নিক্ষেপ করে। সেদিন রাজধানীর উত্তরা এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পুলিশ সাজোয়া যান ও আধুনিক অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়। শুধু তাই নয় স্বৈরাচারের হেলিকপ্টার ও উচু ভবনের উপর থেকে আধুনিক অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। এসময় রাহাত মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধ রাহাত রাস্তায় পড়ে থাকে। হাসপাতালে নেওয়ার মত কেউ ছিল না। সবাই দৌড়াদৌড়ির মধ্যে থাকে। দীর্ঘক্ষণ ধরে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। আহত রাহাতকে উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়েও বিরম্বনার শিকার হতে হয়। রোগীর চাপের কারনে ডাক্তার আসতে বিলম্ব হয়। অবেশেষে কর্তব্যরত ডাক্তার এসে তাকে মৃত ঘোষণা করে। হাসপাতালে নিয়ে গেলে সন্ধ্যা ৭টার দিকে তার মৃত্যু হয়। দাফন-কাফন তার স্বজনরা হাসপাতাল থেকে তার লাশ উদ্ধার করে গ্রামের বাড়ি নরসিংদী নিয়ে দাদার কবরের পাশে দাফন করেন। প্রতিক্রিয়া আদরের সন্তানকে হারিয়ে রাহাতের মা পাগলপ্রায়। ছেলের ছবি বুকে নিয়ে কান্না করতে করতে বারবার মূর্ছা যান। সৌদি প্রবাসী বাবা সেলিম মিয়া পুত্রশোকে পানাহার ছেড়ে দিয়েছেন বলেও জানা গেছে। বুকভরা আশা নিয়ে ১৪ জুলাই উত্তরার আজমপুরে নওয়াব হাবিবুল্লাহ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে মানবিক বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন টঙ্গীর রাহাত হোসেন শরীফ (১৬)। রাহাতের স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শেষ করে জার্মানি যাবেন। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন একটি গুলি রাহাতের সবকিছু থমকে দেয়। ভেঙে চুরমার হয়ে যায় তার সব স্বপ্ন। ছেলেকে হারিয়ে রাহাতের স্মৃতিই এখন মা স্বপ্না আক্তারের একমাত্র অবলম্বন। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়ের অনুভূতি শহীদের মা বলেন, সংসারে অভাব-অনটন থাকা সত্ত্বেও ছেলেকে তা কখনো বুঝতে দিইনি। রাহাত জার্মানি যাবে সে আশায় বুক বেঁধে লেখাপড়া করে যাচ্ছিল। স্বপ্ন পূরণের জন্য আমরা শতকষ্ট করেও টাকা-পয়সা জোগাড় করছিলাম। আজ তা ধূলিসাৎ হয়ে গেল। পুলিশের একটি গুলিতে, একটি ভবিষ্যৎ, একটি স্বপ্ন নিমিষেই চুরমার হয়ে গেল। ছেলেকে অবলম্বন করেই বেঁচে ছিলাম, এখন কাকে নিয়ে আমরা বাঁচব। ছেলে আমার ২০ বছরের সাধনার ধন। আমার ছেলে কারও সঙ্গে কখনো ঝগড়া-ফ্যাসাদে জড়াত না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত, আমার ছেলের কী অপরাধ ছিল? কার কাছে আমি ছেলে হত্যার বিচাই চাইব। এভাবে অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এক নজরে শহীদ রাহাত হোসেন শরিফ নাম : শহীদ রাহাত হোসেন শরিফ পেশা : ছাত্র জন্ম তারিখ : ১২-০৯-২০০৮ বয়স : ১৫ বছর পিতা : মো: সেলিম মাতা : মোসা: স্বপ্না বেগম শাহাদাতের তারিখ : ১৮-০৭-২০২৪ শাহাদাতের স্থান : আজমপুর স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: বাহের চর, থানা: চশবুদ্ধি জেলা: নরসিংদী বর্তমান ঠিকানা : গোপালপুর ওয়ার্ড ৪৪, টঙ্গী, গাজীপুর প্রস্তাবনা ১. শহীদ পরিবারে মাসিক সহযোগিতা করা যেতে পারে। ২. শহীদ পরিবারে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা।