জন্ম তারিখ: ৫ জানুয়ারি, ১৯৯৪
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা : পাটকল শ্রমিক শাহাদাতের স্থান : জালকুড়ি বাসস্ট্যান্ড মোড় সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ
শহীদ মোঃ সুজন খাঁন ১৯৯৪ সালের ৫ জানুয়ারি চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর থানার অন্তর্ভুক্ত এখলাসপুর ইউনিয়নের হাশিমপুর গ্রামের খাঁন বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মঞ্জিল খাঁন ও মাতার নাম নুর জাহান বেগম। পরিবারের প্রথম সন্তান সুজন খাঁন, তাই তাকে নিয়ে আনন্দের কমতি ছিল না পরিবারে। আর তাঁর জন্মের অনেকটা পরেই আরও একটি পুত্র ও কন্যা সন্তান হয় সুজন খাঁনের পিতা-মাতার। সব মিলিয়ে তাঁদের ছিল এই পাঁচ সদস্যের সুখী পরিবার। ছোট থেকেই পিতা-মাতা আর আত্মীয় স্বজনের খুব আদরের ছিলেন তিনি। মায়ের কাছে হাতেখড়ির পর, হাশিমপুরের একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় তাকে। এই মাদ্রাসাতেই পরবর্তীতে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন তিনি। তবে ছোট থেকেই তাঁর আগ্রহ ছিল ব্যবসা কেন্দ্রীক। তাই পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর ফুফাতো ভাইয়ের সঙ্গে রাজধানী ঢাকায় চলে আসেন তিনি। ঢাকার ইসলামপুরের একটি কাপড়ের দোকানে কাজের মাধ্যমে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। পরিবার এলো ঢাকায়, সুজন আবার পেল পরিবার সুজন খাঁন ঢাকায় এসে ফুফাত ভাইয়ের সাথে ইসলামপুরে কাজ করার একটা সময় পর তাঁর বাবা প্রবাস থেকে ফিরলেন। গ্রামে তেমন কোন কাজ না করতে পেরে তিনি এবার পরিবারের অন্য সব সদস্য সহ ঢাকায় এলেন। ঢাকায় এসে তাঁর বাবা সুজন খানের চাচাদের সাথে ব্যবসা শুরু করলেন। নারায়নগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় তাঁর বাবা ট্রলারের মাধ্যেমে নারায়ণগঞ্জ থেকে বিভিন্ন জায়গায় পণ্য আনা-নেওয়া করতো। পরবর্তীতে সুজন নিজেও ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের জালকুড়ি এলাকায় এসে, পরিবারের সাথে একত্রে বসবাস করতেন। সর্বশেষ, তিনি স্থানীয় একটি পাটকলে শ্রমিকের কাজ করতেন। আন্দোলনের সূত্রপাত ও প্রতিবাদী সুজন খাঁন সারাদেশে ২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারি করা পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণার পরপরই কোটা সংস্কার আন্দোলন নতুন করে শুরু হয়। জুলাই মাসে আন্দোলন আরও তীব্র রূপ নেয়, জুলাইয়ের শুরু থেকেই শিক্ষার্থীরা বৈষম্য মূলক কোটা পদ্ধতি সংস্কারের উদ্দেশ্য "বাংলা ব্লকেড" সহ বিভিন্ন কর্মসূচি চালায়। এই সময়ে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমাতে পুলিশের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের ফলে সংঘর্ষ ঘটে। ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাইদ আর চট্টগ্রাম ওমরগনি এমইএস কলেজের ফয়সাল মাহমুদ শান্ত ও শিক্ষার্থী ওয়াসিম আকরাম সহ ছয়জন শহীদ হলে আন্দোলন আরও তীব্রতর হতে থাকে। এরপর ঢাকাসহ সারাদেশে আন্দোলন সহিংস হয়ে উঠে ও বিভিন্ন জায়গায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, স্বৈরাচারের লেলিয়ে দেওয়া সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মতো সংগঠনের হামলায় হতাহত সূচকীয়ভাবে বাড়তে থাকে। নিরীহ মানুষ হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলন বাড়তে থাকলে খুনী হাসিনা, সারাদেশে কারফিউ জারি করে এবং ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে নারায়ণগঞ্জেও। সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুড়ি এলাকায় ১৮ জুলাই প্রথমবারের মতো ব্যাপক আন্দোলন হয়। আন্দোলনে অংশ নেন, সুজন খাঁনের ছোট ভাই মাহবুব নিজেও। মাহবুব জানায়,"সেদিন আন্দোলনে গিয়ে, ভাইয়াকে দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। কারণ তখন তাঁর কারখানায় থাকার কথা ছিলো।" আন্দোলন শেষে যে যার মত বাড়িতে ফিরে এলে পরবর্তীতে মাহবুব জানতে পারে যে, শিক্ষার্থী আর সাধারণ মানুষের আন্দোলনে আমার বড় ভাইয়ের কারাখানা শ্রমিকেরাও যুক্ত হয়েছিলো। এ নিয়ে মাহবুব আরও বলেন," আমার বড় ভাই আগে থেকেই বেশ প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন, তাঁর সামনে হওয়া কোন অন্যায় তিনি সহ্য করতে পারতেন না। বিগত আওয়ামী স্বৈরশাসনের শুরু থেকেই তিনি এর বিরুদ্ধে ছিলেন, সবসময় এর প্রতিবাদ করতেন। আমরা যখন মুখ ফুটে সরকারের কোন অপকর্মের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারতাম না, তখনও তিনি মামলা-গ্রেপ্তারের ভয় উপেক্ষা করে হাসিনা সরকারের বিভিন্ন অপকর্মের কথা নির্ভয়ে মানুষের কাছে তুলে ধরতেন।" জালকুড়ির প্রথম শহীদ মোঃ সুজন খাঁন প্রতিবাদী সুজন খাঁন বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবীতে শুরু হওয়া সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে প্রথম থেকেই একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। জালকুড়িতে প্রথম ১৮ জুলাই তীব্র আন্দোলন শুরু হলে, তিনি নিজেও কাজের মাঝে এসে তাতে যোগ দিয়েছিলেন। ঘটনার শুরু ১৯ জুলাই, মূলত ১৮ তারিখের পরদিনও জালকুড়ি এলাকায় আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সেদিন ছিল শুক্রবার, সকালে উঠেই সুজন খাঁন মাকে জানান তিনি কারখানায় যাবেন। দেশের এমন পরিস্থিতিতে কারফিউয়ের মধ্যে তাকে কারখানা যেতে বাঁধা দেন তাঁর মা। মাকে সুজন জানায়,"এখন মাসের শেষ, এখন একদিন হাজিরা না দিলে পরে বেতন নিয়ে ঝামেলা হইবো। " ছেলে কারখানায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলে, মা ছেলের জন্য কাঁঠাল আর মুড়ির ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে তাঁর মা কান্না বিজড়িত কন্ঠে জানান, "অই কারখানাই যাইতে চাইলে, ওর লাইগা কাঁঠাল ভাঙলাম, বাজান। আমরা তিন মা-পুত এক লগেই কাঁঠাল আর মুড়ি খাইলাম। কে জানতো, হেইডাই ওর আমার লগে শেষ দেহা।" সেদিন জুম্মা নামাজের জন্য সাধারণ মানুষের সমাগম বেড়ে গেলে, অন্যদিকে অস্ত্র হাতে প্রস্তুতি নিতে থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। নামাজ শেষে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী জালকুড়ি বাসস্ট্যান্ড মোড়ে একত্রিত হতে থাকে আন্দোলনকারীরা। শুরু থেকেই পুলিশ আর বিজিবির সাথে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হতে থাকে তাদের। পুলিশ-বিজিবি একসাথে আন্দোলনরত সাধারণ মানুষের ওপর রাবার বুলেট আর টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনরতদের মাঝে। বিকাল ৩টার কিছু সময় পর কারখানা থেকে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেন সুজন খাঁন। পথিমধ্যে আন্দোলনকারীদের সাথে যুক্ত হন তিনি। ততক্ষণে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পুলিশ-বিজিবির পাশাপাশি আওয়ামী লীগের চিহ্নিত সন্ত্রাসীরাও আন্দোলনকারী সাধারণ মানুষের ওপর চড়াও হতে থাকে। সন্ত্রাসীদের এমন বেপরোয়া আচরণে উত্তেজিত জনতা জালকুড়ি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় নারায়ণগঞ্জের কুখ্যাত সাংসদ শামীম ওসমানের বাসে আগুন দেয়। এবার আরও মারমুখী হয় পুলিশ-বিজিবি। নির্বিচারে গুলি করতে থাকে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর। তখন বেলা ঠিক ৫টা, আন্দোলনের সম্মুখ সারীতে থাকা সুজন খাঁনের কোমড়ে এসে লাগলো ঘাতকের ছোঁড়া বুলেট। সঙ্গে সঙ্গেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। সাধারণ শিক্ষার্থী আর আন্দোলনরত সাধারণ কিছু মানুষ তাকে দ্রুতই স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার জানালেন তিনি ইতিমধ্যেই মৃত্যুবরণ করেছেন৷ কান্নায় ভেঙে পড়লেন তাঁর সাথে আন্দোলনরতরা। সুজন খাঁনের নাম উঠলো শহীদের খাতায়, ইতিহাসে অংশ হয়ে রইলেন তিনি। জুলাই বিপ্লবে তিনিই সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুড়ি এলাকার প্রথম শহীদ। প্রতিবাদে সম্মুখে সুজনেরা থাকে নিজের রক্তে নব স্বাধীনতা আঁকে, পাঁজর আঘাতে তাঁরা ভাঙে শৃঙ্খল সরিয়ে যুগের জেঁকে বসা জগদ্দল। শহীদ সুজনেরা তখনও স্বৈরাচারের চক্ষুশূল সুজন খাঁনের শাহাদাতের পর, তাঁর কারখানার এক সহকর্মী রাজু গিয়ে তাঁর পরিবারকে জানালেন গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর অবস্থায় ক্লিনিকে ভর্তি তিনি। খবর পেয়ে ক্লিনিকে ছুটে এলেন তাঁর মা-বাবা আর ছোট ভাই। কিন্তু এসে দেখলেন এরমধ্যেই শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেছেন সুজন। মা-বাবা আর ভাইয়ের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠলো চারপাশ। কিন্তু এরমধ্যেই ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ সুজন খাঁনের লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকলো। ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের ভাষ্য ছিল এরকম যে, "সারাদেশের অবস্থা তো জানেনই। দ্রুতই আপনাদের লাশ আপনারা ক্লিনিক থেকে নিয়ে যান। তাছাড়া কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে আপনাদের পাশাপাশি আমাদেরও হয়রানি করবে।" ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের কথামতো, কোন মৃত্যু সনদ ছাড়াই দ্রুত শহীদ সুজনের লাশ নিয়ে আসা হলো জালকুড়ি বাসস্ট্যান্ডের কাছে তাঁদের বাড়িতে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হয়রানির চিন্তায় রাতেই শেষ গোসল করানো হলো তাকে। কারফিউয়ের মাঝেও অগণিত জনতার উপস্থিতে রাত প্রায় ১১টার পর রাব্বানীনগর মাদ্রাসায় জানাজা নামাজের পর জালকুড়ি ঈদগাঁহ সংলগ্ন কবরস্থানে তাঁকে দাফন করানো হয় । শহীদের পারিবারিক বর্তমান অবস্থা শহীদ সুজন খাঁনের বাবা প্রবাস থেকে ফিরে, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় এসে ট্রলারের মাধ্যেমে পণ্য পরিবহনের ব্যবসা শুরু করেন। আর অন্যদিকে শহীদ মোঃ সুজন খাঁন স্থানীয় একটি পাটকলে শ্রমিকের কাজ করতেন। পিতার আয়ে বাজার সদাই, আর পুত্রের আয়ে ভাই-বোনের পড়াশোনা। এমন করেই দিন চলতো মধ্যবিত্ত পরিবারটির। পরিবারের বড় ছেলের মৃত্যুতে তাই সংসার চালাতে বেশ হিমসিম খেতে হচ্ছে তাঁর বাবা মঞ্জিল খাঁনের। শহীদের ছোট ভাই মোঃ মাহবুব খাঁন জানান, "পরিবারের সাপ্তাহিক বাজার আর অন্যান্য আনুষাঙ্গিক খরচ ছাড়াও আমার লেখাপড়ার জন্য টাকা দিতেন আমার বড় ভাই। তাঁর অবর্তমানে আমার পড়াশোনার খরচ যোগাতে সংসারে টানাপোড়েন চলে।" এক নজরে শহীদ মো: সুজন খাঁন সম্পর্কিত তথ্যসমূহ নাম : মোঃ সুজন খাঁন জন্ম তারিখ : ৫ জানুয়ারি, ১৯৯৪ পেশা : পাটকল শ্রমিক পিতার নাম : মনজিল খাঁন পিতার পেশা ও বয়স : ট্রলারে পণ্যপরিবহন, ৫৫ বছর মাতার নাম : নুর জাহান বেগম মাতার পেশা ও বয়স : গৃহিণী, ৫০ বছর পরিবারের মাসিক আয় : ১০০০০ টাকা পরিবারের বর্তমান সদস্য সংখ্যা : ৪ জন পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নাম, পেশা ও প্রতিষ্ঠান শহীদের ছোট ভাই : মোঃ মাহবুব খান, তুলারাম কলেজের ডিগ্রি প্রথম বর্ষের ছাত্র শহীদের ছোট বোন : মোসা: খাদিজা আক্তার, গৃহিণী ঘাতক : সিদ্ধিরগঞ্জ থানার পুলিশ ও স্থানীয় বিজিবি সদস্যরা নিহত হওয়ার সময় ও স্থান : ১৯ জুলাই ২০২৪, বিকাল আনুমানিক ৫টা, জালকুড়ি বাসস্ট্যান্ড মোড় সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ শহীদের কবরের অবস্থান : জালকুড়ি ঈদগাঁহ সংলগ্ন কবরস্থান, ৯ নম্বর ওয়ার্ড জালকুড়ি সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন বর্তমান ঠিকানা : গ্রাম: জালকুড়ি, ওয়ার্ড নম্বর: ০৯, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা: সিদ্ধিরগঞ্জ, জেলা: নারায়ণগঞ্জ স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: খাঁন বাড়ি হাশেমপুর, ইউনিয়ন: এখলাসপুর, উপজেলা: মতলব উত্তর, জেলা: চাঁদপুর সহযোগিতা সংক্রান্ত এক বা একাধিক প্রস্তাবনা ১. শহীদের দরিদ্র পিতাকে এককালীন কিছু অর্থ সহযোগিতা করে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে সহযোগিতা করা ৩. শহীদের কলেজ পড়ুয়া ছোট ভাইয়ের জন্য শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করা