জন্ম তারিখ: ৬ জুন, ১৯৮৮
শহীদ হওয়ার তারিখ: ২১ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা : ব্যবসায়ী, কাজী ভিআইপি গার্মেন্টসের যৌথ সত্ত্বাধিকারী শাহাদাতের স্থান : ঢাকা মেডিকেল কলেজ
মো: জাকির হোসেনের জন্ম ১৯৮৮ সালের ৬ জুন, গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানার চর দুর্লভ খাঁ গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন আত্মপ্রত্যয়ী, পরিশ্রমী ও সাহসী। বাবা আব্দুস সামাদ ছিলেন একজন সৎ কৃষক, আর মা মোমেনা বেগম ঘর সামলানোর পাশাপাশি সন্তানদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সবসময় সচেষ্ট ছিলেন। জাকির হোসেন পারিবারিক দায়িত্ব নিতে খুবই দক্ষ ছিলেন, আর তার সেই দায়িত্ববোধই তাকে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে তোলে। জাকির হোসেন গাজীপুরের কাজী ভিআইপি গার্মেন্টসের যৌথ সত্ত্বাধিকারী ছিলেন। ছোট একটি ব্যবসা থেকে শুরু করে তিনি জীবনের প্রতিটি ধাপে পরিশ্রমের মাধ্যমে উন্নতি করেছিলেন। তার ছিল একটি ছোট্ট পরিবার। সাত বছর বয়সী ছেলে আব্দুর রহমান ও দুই বছরের ছোট্ট ছেলে বাইজিদ। স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে সুখী জীবনযাপনের স্বপ্ন ছিল তার, কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই সব কিছু থেমে যায়। আন্দোলনের প্রেক্ষপট ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই ছিল জাকিরের জীবনের এক ভয়াবহ দিন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতা তখন সারাদেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল আর উত্তরা ছিল পুলিশের বেপরোয়া গুলির ক্ষতবিক্ষত। ব্যবসায়িক কাজে গিয়েছিলেন উত্তরায়, কিন্তু সে কাজ শেষ করে ফিরে আসার সময় তার জীবন থেমে যায় পুলিশের গুলিতে। বিকাল ৩:৩০ টায় হেলিকপ্টার থেকে নিক্ষিপ্ত পুলিশের এলোপাথাড়ি গুলি তার পিঠে বিদ্ধ হয়। আশেপাশের মানুষজন তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যান, কিন্তু ২১ জুলাই ভোর ৪:৩০ টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শহীদ জাকির হোসেনের মৃত্যু তার পরিবারের জন্য যেমন এক শোকের ঘটনা, তেমনি তার দুই ছোট সন্তানের জন্য অনিশ্চয়তা ও কষ্টের জীবন। তিনি ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার পিঠে পাওয়া গুলির চিহ্ন এখনো তার আত্মত্যাগের নীরব সাক্ষী। তার নামে থাকা ৫ শতাংশ জমির মধ্যে ছোট একটি বাড়ি ছাড়া আর কোনো সহায়-সম্পত্তি নেই। এছাড়া ব্যবসার জন্য নেওয়া প্রায় দুই লক্ষ টাকা ঋণও রয়েছে। আজ তার দুই ছেলের শিক্ষাজীবন ও ভবিষ্যত অন্ধকারে নিমজ্জিত। তার স্ত্রী, যিনি একসময় স্বামীকে সাপোর্ট দিয়ে সংসার সামলাতেন; এখন অসহায় আর নিরুপায় পরিস্থিতির সম্মুখীন। শহীদ মো: জাকির হোসেনের আত্মত্যাগ কেবল তার পরিবারকেই নয়, সমগ্র জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতার সংগ্রামে, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের জন্য তার মতো হাজারো সাহসী মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। তার মৃত্যু আমাদের মনে গভীর শোকের জন্ম দেয়, তবে তার এই আত্মবলিদান আমাদের মনোবল আরও দৃঢ় করে তোলে। ঘটনার বিবরণ ১৯ জুলাই ২০২৪, শুক্রবারের সেই দিনটি ছিল শহীদ মো: জাকির হোসেনের জীবনের শেষ দিন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তখন সারা দেশে বিক্ষোভের দাবানল ছড়িয়ে দিয়েছিল। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী জনতা রাজপথে নেমে আসছিল। তবে পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছিল, কারফিউ জারি ছিল, ইন্টারনেট এবং সকল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ। কোথায় কী ঘটছে, কেউই সঠিকভাবে জানতে পারছিল না। ঘটনার দিন নিজের কারখানার জন্য কোনাবাড়িতে কিছু মালপত্র কিনতে গিয়েছিলেন জাকির হোসেন। পরে দুপুরে একজন ক্রেতার সঙ্গে দেখা করতে রাজধানীর উত্তরার দিকে রওনা হন। পথে আব্দুল্লাহপুরে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এমন সময় রাজধানীতে নানা স্থানে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের ব্যাপক হামলা চলছিল। দেশের পরিস্থিতি ভালো না ভেবে ছেলে জাকির হোসেনকে (৩৮) কল দেন তাঁর মা মোমেনা বেগম। ছেলেকে বাইরে যেতে মানা করেন। কথার একপর্যায়ে হঠাৎ বিকট আওয়াজ পান মা। এরপর আর ছেলের কোনো কথা শুনতে পাননি তিনি। তখনই ঐ এলাকায় পুলিশের আগ্রাসী হামলাকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও ছাত্র-জনতার ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হয়ে যায়। আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দিতে বৃষ্টির মত গুলি ছোড়ে স্বৈরাচারী সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পর পর দুটি গুলি এসে পিঠে ও পেটে লাগলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাটিতে পড়ে যান জাকির হোসেন। সেখান থেকে হাসপাতালে নেওয়া হলে ১৪ ঘণ্টা পর মারা যান তিনি। পথচারীরা দ্রুত তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু জীবন-মৃত্যুর এই লড়াইয়ে তিনি হার মানেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২১ জুলাই ২০২৪, ভোর ৪টা ৩০ মিনিটে শহীদ জাকির শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হেলিকপ্টার থেকে সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়েছিল। আর সেই গুলিতেই প্রাণ হারান শহীদ জাকির। তাঁর পিঠে গুলি বিদ্ধ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। জাকিরের পরিবার যখন তার মৃত্যুর সংবাদ পায়, তখন তারা শোকের সাগরে ভাসছিলেন। একটি সাধারণ কাজে বেরিয়ে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটি আর কখনও ফিরবেন না, এমনটি তাদের ভাবনাতীত ছিল। ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাঁর পরিবারের কাছে কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না, এমনকি কোনো সাহায্যের সুযোগও ছিল না কারণ পুরো দেশজুড়ে মোবাইল নেটওয়ার্কও স্লো করা ছিলো; সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোও ছিল বন্ধ। গাজীপুরের কাপাসিয়া চরদুর্লভ খাঁ গ্রামে জাকিরের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং তাঁকে স্থানীয় কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। শহীদ জাকির হোসেনের নির্মম মৃত্যু মানুষের মনে কেবল শোকই জাগায় না বরং ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে জাগায় অপরিমেয় ঘৃণা আর সৃষ্টি করে স্বৈরাচারবিরোধী দৃঢ় মনোবল। শহীদ সম্পর্কে পরিবারের বক্তব্য জাকিরের মা মোমেনা বেগম বলেন, "সেদিন সকাল থেকেই মনটা খুব খারাপ লাগছিল। চারদিকে নানা গণ্ডগোলের খবর পাচ্ছিলাম। কেউ কেউ বলছিল, গাজীপুরে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষ হচ্ছে। তাই জাকিরকে ফোন করেছিলাম। তাকে বললাম, বাবা, সাবধানে থাকিস। কিন্তু সে আমার সঙ্গে কথা বলতেই গুলিবিদ্ধ হয়। মুহূর্তের মধ্যে ফোনের ওপাশ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। একজন মা হিসেবে সেই মুহূর্তের কথা মনে হলে আমি আর ঠিক থাকতে পারি না।" জাকিরের স্ত্রী জান্নাতুন নাঈম বলেন, "জাকির ১৯ জুলাই সকালে খাবার খেয়ে বাসা থেকে বের হয়, অফিসের কাজে যাবে বলে। সারা দিন অফিসে থাকবে জানিয়েছিল। তারপর সারাদিন আর তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়নি। বিকেল ৫টার দিকে তার অফিসের কয়েকজন আমাদের বাসায় আসেন। তাদের কাছেই প্রথম জানতে পারি যে, জাকির গুলিবিদ্ধ হয়েছে। পরে দ্রুত উত্তরার হাসপাতালে ছুটে গেলেও তাকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি।" জাকিরের পিতা আবদুস সামাদ বলেন, "২০০৩ সালে জাকির তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করে। কঠোর পরিশ্রম আর মেধার প্রমাণ দিয়ে কয়েক বছর আগে গাজীপুরের একটি তৈরি পোশাক কারখানায় সহকারী প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতি পায়। গত ছয় মাস আগে ছোট পরিসরে নিজেই একটি পোশাক তৈরির কারখানা গড়ে তুলেছিল। এখন সব শেষ হয়ে গেলো।" শহীদের বোন লাকী আক্তার (২৫) বলেন, "আমি বোন হিসেবে বলছি, আমার ভাই অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। সরকার কর্তৃক আইন শৃংখলা বাহিনীর দ্বারা অন্যায়ভাবে নিহত হন। তিনি ধর্মের প্রতি অটল ছিলেন। পরিবারের সদস্যরা চাই- শহীদ হিসেবে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হোক।" পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার বিবরণ শহীদ মো: জাকির হোসেনের পরিবার নিম্নমধ্যবিত্ত হলেও তাঁকে ঘিরে ছিল অগাধ স্বপ্ন। তিনি ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, যিনি ছোট একটি ব্যবসার মাধ্যমে পরিবারকে টিকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু তার অকাল মৃত্যু সেই আয়ের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। শহীদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের উপর প্রায় ২ লক্ষ টাকার ঋণ রয়েছে, যা তাঁর পরিবারের কাঁধে বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবারটি মাত্র ৫ শতাংশ জায়গার মধ্যে একটি ছোট বাড়িতে বসবাস করে, যেখানে কোনো অতিরিক্ত জমি নেই। অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকা আজ তাদের জন্য প্রতিদিনের সংগ্রাম। শহীদ জাকিরের মৃত্যুতে তার পরিবার এখন গভীর সংকটে নিমজ্জিত, আর্থিক সহায়তা ছাড়া তাদের সামনে কোনো পথ খোলা নেই। প্রস্তাবনা শহীদ মো: জাকির হোসেনের পরিবার আজ আর্থিক সংকট এবং অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দিন পার করছে। একজন স্বপ্নবান ব্যবসায়ী এবং নিবেদিত প্রাণ পিতার আকস্মিক চলে যাওয়া তাঁর পরিবারের ওপর চেপে বসিয়েছে অসহনীয় ভার। তাঁর স্ত্রী, দুই ছোট সন্তান এবং পরিবারের সদস্যরা আজ বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করছেন। এমতাবস্থায়, শহীদের পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ করার মত ৩টি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা তুলে ধরা হলো: প্রস্তাবনা-১: জাকিরের দুই অবুঝ শিশুর ভবিষ্যৎ যেন অনিশ্চয়তার অন্ধকারে হারিয়ে না যায়। সেজন্য তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। প্রস্তাবনা-২: শহীদ পরিবারের উপর প্রায় ২ লক্ষ টাকা ঋণের বোঝা আজ তাদের জীবনযুদ্ধে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই ঋণ পরিশোধে সহায়তা প্রদান করলে তারা নতুন করে বাঁচার আশায় এগিয়ে যেতে পারবে। প্রস্তাবনা-৩: শহীদ জাকিরের স্ত্রী বর্তমানে নিরুপায় অবস্থায় আছেন। তার জন্য একটি উপযুক্ত চাকরির ব্যবস্থা করা গেলে তিনি তার সন্তানদের নিয়ে সম্মানের সঙ্গে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন। এই প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়ন হলে শহীদ মো: জাকির হোসেনের পরিবারের জীবনযুদ্ধে কিছুটা হলেও সুখের সন্ধান মিলবে; যা তাঁর আত্মত্যাগের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন হবে। এক নজরে শহীদ পরিচিতি জন্ম তারিখ : ০৬ জুন ১৯৮৮ জন্মস্থান : গাজীপুর পেশা/পদবী : ব্যবসায়ী, কাজী ভিআইপি গার্মেন্টসের যৌথ সত্ত্বাধিকারী নিজ জেলা : গাজীপুর ঠিকানা সংক্রান্ত তথ্য স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: চরদুর্লভ খাঁ, ইউনিয়ন: বারিষাব, থানা: কাপাসিয়া, জেলা: গাজীপুর বর্তমান ঠিকানা : গ্রাম: চরদুর্লভ খাঁ, থানা: কাপাসিয়া, জেলা: গাজীপুর পরিবার সংক্রান্ত তথ্য পিতার নাম : আব্দুস সামাদ (৭০), পেশা: কৃষক মায়ের নাম : মোমেনা বেগম (৬০), পেশা: গৃহিণী মাসিক আয় : ৮০০০ টাকা আয়ের উৎস : কৃষিকাজ শহীদের সন্তান : ১. আব্দুর রহমান (৭ বছর), ২. বায়েজিদ (২ বছর) ঘটনার স্থান : বিএনএস সেন্টার, উত্তরা আক্রমণকারী : র্যাব আঘাত : হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয় আহত হওয়ার সময় : ১৯ জুলাই ২০২৪, বিকাল ৩:৩০ মৃত্যুর তারিখ ও সময় : ২১ জুলাই ২০২৪, ভোর ৪:০০, ঢাকা মেডিকেল কলেজ শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : চরদুর্লভ খাঁ, কাপাসিয়া, গাজীপুর