জন্ম তারিখ: ১২ অক্টোবর, ১৯৯৮
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৮ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা : ব্যবসায়ী (ফুটপাতে কাপড়ের ব্যবসা, রাজলক্ষ্মী, উত্তরা) , শাহাদাতের স্থান : রাজলক্ষ্মী কুশল সেন্টার, উত্তরা
জাকারিয়া হাসান, গাজীপুরের কালিগঞ্জের এক অতি সাধারণ পরিবারের সন্তান। জন্ম ১২ অক্টোবর ১৯৯৮ সালে। ছোটবেলা থেকেই জীবন সংগ্রামের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। ফুটপাতে কাপড়ের ব্যবসা করে উত্তরা রাজলক্ষ্মী মার্কেটে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তার পিতা আকবর আলী শেখ একজন চা বিক্রেতা, মা ঝর্না বেগম একজন গৃহিণী। কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়েই পরিবারকে সহায়তা করে যাচ্ছিলেন তিনি। জাকারিয়ার স্বপ্ন ছিল ছোট, কিন্তু তার হৃদয় ছিল বিশাল। পরিবারকে একটু ভালোভাবে দেখার, সংসারে সুখ আনার স্বপ্ন ছিল তার। জীবনের ঠিক এক নতুন অধ্যায়ে পা রেখেছিলেন, বিয়ের ২৫ দিনের মাথায়, যখন সবকিছু রঙিন হওয়ার কথা ছিল, তখনই ১৮ আগস্ট ২০২৪, সেই বিকেলটা কালো মেঘের মতো ছায়া ফেলে জাকারিয়ার জীবনে। রাজলক্ষ্মী কুশল সেন্টারে কাপড়ের দোকানে থাকার সময় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের যৌথ আক্রমণে জীবনটি শেষ হয়ে যায়। তার মৃত্যুর সঙ্গে একটি পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে যায়, স্তব্ধ হয়ে যায় তার বাবা-মা, বড় ভাই মুজাহিরুল হাসান শেখ, যিনি নিজেও পরিবারের দায়িত্ব নিতে লড়ছেন। জাকারিয়ার জীবনের শেষ ঠিকানা হয় তার নিজ গ্রাম কালিগঞ্জের পারিবারিক কবরস্থানে, যেখানে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। জাকারিয়া হাসান আমাদের শিখিয়ে গেছেন, লড়াই শুধুমাত্র অস্ত্র দিয়ে হয় না, কখনো কখনো জীবন দিয়ে লড়াই করতে হয়। ঘটনার বিবরণ ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছিল একটি ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রামী প্রয়াস। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা চাকরিতে কোটার নামে নানা বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ রাস্তায় নেমেছিল, তাদের দাবি ছিল উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, এবং সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের উদাসীনতা এবং ফ্যাসিবাদী নীতির বিরুদ্ধে এই দাবিগুলোকে জবাব দেওয়ার পরিবর্তে, সরকার তা দমন করতে চেয়েছিল। ১৮ জুলাই ২০২৪, বৃহস্পতিবার। জাকারিয়া ছাত্র জনতার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ মিছিলে অংশ নেন। তারা রাজলক্ষ্মী কুশল সেন্টারের দিকে এগোচ্ছিল। মিছিলটি এগিয়ে গেলে স্বৈরাচারী সরকারের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশ ও আওয়ামী লীগ বাহিনী বিনা উসকানিতে মিছিলের ওপর আক্রমণ চালায়। সরকারের নির্দেশে পুলিশ ও সন্ত্রাসীরা নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। জাকারিয়া ছিলেন মিছিলের সামনের সারিতে। গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। গুরুতর আহত জাকারিয়াকে দ্রুত উদ্ধার করে উত্তরা রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু বাঁচানো সম্ভব হয়নি। ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। শহীদ জাকারিয়ার মরদেহ কালিগঞ্জে তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে জানাজা শেষে তাকে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়। জাকারিয়ার এই শাহাদাত তার পরিবারের জন্য এক অসীম বেদনা হয়ে আসে, কিন্তু তার স্বপ্ন ও সংগ্রাম আজও মানুষের মনে প্রজ্জ্বলিত রয়েছে। জাকারিয়ার মৃত্যুর পর সারা দেশে বিক্ষোভ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। ছাত্রসমাজের হৃদয়ে যে ক্ষোভ জ্বলে উঠেছিল, তা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। রাজপথে হাজারো ছাত্রছাত্রী, শ্রমজীবী মানুষ, এবং সাধারণ জনগণ কণ্ঠে একই স্লোগান নিয়ে নেমে আসে—"ন্যায়বিচার চাই, খুনি সরকারের পতন চাই!" স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশ যতই দমনমূলক পদক্ষেপ নেয়, ততই আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। শহীদ জাকারিয়ার পরিবার এই শোকের মধ্যে দিয়ে দেশের মানুষের ভালোবাসা এবং সহানুভূতি পেতে শুরু করে। কালিগঞ্জের ছোট গ্রামটি এখন শহীদের স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে উঠেছে। মানুষ তার কবরের পাশে এসে শপথ নেয়, "আমরা জাকারিয়ার স্বপ্ন পূরণ করব।" সেই স্বপ্ন ছিল একটি বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে সবার জন্য শিক্ষার অধিকার এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। জাকারিয়ার রক্তে রাঙা রাজপথ বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায় হয়ে উঠেছে, যেখানে গণমানুষের সংগ্রাম থামবে না, যতক্ষণ না বৈষম্য ও দমনমূলক শাসনের অবসান ঘটে। আর্থিক অবস্থা শহীদ জাকারিয়া হাসান একজন ক্ষুদ্র কাপড় ব্যবসায়ী। সচ্ছলতার জন্য তিনি অল্প বয়সেই কাজকর্ম করতেন। মৃত্যুর আগে ফুটপাতে কাপড়ের দোকান দিয়ে সংসার চালাতেন। আর স্ত্রী পাপিয়া আক্তার শর্মী পেশায় একজন নার্স। মাত্র ২৫ দিনের মাথায় তিনি তার স্বামীকে হারান। তার বাবা দিন এনে দিন খেয়ে সংসার চালান। তার বাবা চা বিক্রেতা হিসেবে বাড়ির পাশেই ব্যবসা করছেন। তার বড় ছেলে কয়লা ঘাটে ছোট চাকুরী করছেন। তার পরিবারের অবস্থা মোটামুটি। তার বাবার পক্ষে পরিবারের জন্য সংসার চালানো কষ্টকর হচ্ছে। শহীদ সম্পর্কে বন্ধুর বক্তব্য শহীদের বন্ধু মুনসুর আলী বলেন, জাকারিয়া ভদ্র ও নম্র ছিলেন। তিনি মুলগাও দাখিল মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। তিনি এলাকার সামাজিক কাজগুলি করতেন। যে আন্দোলন করতে গিয়ে নিহত হলেন আল্লাহ যেন তাকে শাহাদাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করেন। দেশ যেন ফ্যাসীবাদ দূর হয়। ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে কবুল করেন। প্রস্তাবনা শহীদ জাকারিয়া হাসানের পরিবার আজ এক নিদারুণ কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। তার অকাল মৃত্যুতে পুরো পরিবারের স্বপ্নগুলো যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে পরিবারের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। পরিবারটি আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারে, যদি আমরা সবাই মিলে কিছু সহায়তা করতে পারি। প্রথমত, শহীদ জাকারিয়ার বড় ভাই মুজাহিরুল হাসান শেখ বর্তমানে একটি ছোট প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। যদি তার জন্য একটি স্থায়ী চাকুরির ব্যবস্থা করা যায়, তবে পরিবারটি একটি নির্দিষ্ট আয়ের উৎস পাবে, যা তাদের স্থিতিশীলভাবে চলতে সহায়ক হবে। দ্বিতীয়ত, শহীদের পিতা আকবর আলী শেখ একজন চা বিক্রেতা। তার ছোট্ট দোকানটিতে পুঁজির অভাবে তিনি এগোতে পারছেন না। যদি তার দোকানে কিছু পুঁজির সংস্থান করা যায়, তবে তিনি নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করতে পারবেন এবং পরিবারের জন্য কিছুটা হলেও স্বস্তি আসবে। তৃতীয়ত, শহীদ জাকারিয়ার নববধূ, যিনি স্বামীর মৃত্যুর পর গভীর শোকে আচ্ছন্ন, তার জন্য একটি হাসপাতালে নার্সিংয়ের চাকরির ব্যবস্থা করা গেলে তিনি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবেন এবং পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে ভূমিকা রাখতে পারবেন। এই প্রস্তাবনাগুলি বাস্তবায়িত হলে শহীদ জাকারিয়া হাসানের পরিবার আবারও নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে পারবে, এবং তাদের এই অন্ধকার সময়ে কিছুটা আশার আলো দেখা দেখাবে। এক নজরে শহীদ পরিচিতি নাম : জাকারিয়া হাসান জন্ম তারিখ : ১২ অক্টোবর ১৯৯৮ জন্মস্থান : কালিগঞ্জ, গাজীপুর পেশা : ব্যবসায়ী (ফুটপাতে কাপড়ের ব্যবসা, রাজলক্ষ্মী, উত্তরা) স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: দেওপাড়া, থানা: কালিগঞ্জ, জেলা: গাজীপুর বর্তমান ঠিকানা : দেওপাড়া, কালিগঞ্জ, গাজীপুর পিতা : আকবর আলী শেখ (চা বিক্রেতা) মাতা : ঝর্না বেগম স্ত্রী : পাপিয়া আক্তার শর্মি, পেশা: নার্স মাসিক আয় : ৮-১০ হাজার টাকা আয়ের উৎস : চা বিক্রি বিশেষ তথ্য : শহীদ জাকারিয়া হাসান বিয়ের ২৫ দিনের মাথায় শাহাদাত বরণ করেন ঘটনার স্থান : রাজলক্ষ্মী কুশল সেন্টার, উত্তরা আক্রমণকারী : পুলিশ ও আওয়ামীলীগ আহত হওয়ার সময়কাল : ১৮ আগস্ট ২০২৪, বিকাল ৪:০০টা মৃত্যুর তারিখ ও সময় : ১৮ আগস্ট ২০২৪, বিকাল ৪:১০টা মৃত্যুর স্থান : রাজলক্ষ্মী কুশল সেন্টার, উত্তরা শহীদের কবরের অবস্থান : পারিবারিক কবরস্থান, কালিগঞ্জ, গাজীপুর