জন্ম তারিখ: ২ মে, ১৯৯৭
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা :চাকুরিজীবী , শাহাদাতের স্থান : ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল
শহীদ মোহাম্মদ অহিদ মিয়া গাজীপুর জেলার টঙ্গী থানায় ১৯৯৭ সালের মে মাসে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মো: খোরশেদ এবং মাতার নাম ফুরকান বিবি। অষ্টম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় তার পিতা মৃত্যুবরণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর আর পড়ালেখা করার সুযোগ পাননি মোহাম্মদ অহিদ মিয়া। এরপরই ঢুকে যান চাকরি জগতে। পোশাক কারখানার হেলপার হিসেবে নিয়োগ পান। স্বল্প বেতনে মাকে নিয়ে ভালোই বেশ ভালো চলছিল শহীদের সংসার। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, হঠাৎ তার বড় বোনের তালাক হয়ে যায়। তালাকপ্রাপ্ত বোনের দায়িত্ব নিতে হয় তাকে। এরপর অপারেটরের কাজ শিখে ২০২২ সালে যোগ দেন শান টেক্স প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিতে। অপারেটর হিসেবে তার বেতন ছিল ১৫ হাজার টাকা। পটভূমি বাংলাদেশে গত ১৫ বছর ধরে একটিমাত্র শাসকগোষ্ঠী ছিল ক্ষমতায় যারা নির্বাচন কিংবা শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য নির্যাতন কিংবা দমন-পীড়ন সহ অনেক কিছু তারা করেছে। তারা মিডিয়াকে ভয়াবহভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। আদালত অকার্যকর হয়ে গেছে। মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন কোনো কাজ করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেরুদণ্ডহীন মাস্তানদের সমাবেশ তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে একটি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তৈরি করেছিল। দুর্নীতির কারণে একদিকে যেমন জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ কমেছে, অন্যদিকে হাজারো কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এর মধ্যেই বিভিন্ন ধরনের গোপন চুক্তি, মেগাপ্রকল্পের কারণে মানুষের মধ্যে বিষণ্নতা বাসা বেঁধেছিল। সবশেষ ২০২৪ সালের প্রহসনের নির্বাচনের পর মানুষের মধ্যে একটি হতাশা তৈরি হয়, একটা জাতিগত ডিপ্রেশন তৈরি হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা মানুষের মধ্যে অসহায়ত্ব তৈরি করেছিল। আওয়ামীলীগের বিকল্প বিএনপি-জামায়াত জোটের অতীত মানুষ দেখেছে। জাতীয় পার্টিকেও তারা দেখেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয়ে মানুষের অভিজ্ঞতা বেশি সুখের ছিল না। এজন্য জনগণের মনে ক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও গত ১৫ বছরের অন্যান্য আন্দোলনগুলো সরকার পতনের দিকে যায়নি। কিন্তু মানুষের মাঝে প্রশ্ন ছিল যে এগুলো কতদিন চলবে? স্বৈরাচারী ব্যবস্থা, মানুষকে অপমান, প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা আর কতদিন চলবে? বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যে সরকার পতন আন্দোলনের দিকে গেল, তা কোনো পরিকল্পিত ঘটনা ছিল না। সমাজের মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয়েছে আন্দোলনে। শুধু এই সময়ের আন্দোলন দিয়েও এটাকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। এখানে মূল বিষয় হলো এর সূত্রপাত রাজনৈতিক নেতৃত্বে হয়নি। গণঅভ্যুত্থান তো আগেও দেখেছি। ১৯৬৯, ১৯৯০ এ গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। '৬৯ এ রাজনৈতিক দলগুলো যেমন—আওয়ামী লীগ, ভাসানী ন্যাপ সামনে ছিল। এই আন্দোলনের ফল মুক্তিযুদ্ধ। আরেকটা গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল ১৯৯০ সালে এরশাদ পতন আন্দোলন। তখন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বামদলের নেতৃত্বে তিনটি রাজনৈতিক জোটের সম্মিলিত আন্দোলন হয়। এবারের জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না, এর কোনো নির্দিষ্ট নেতা ছিল না। কিন্তু যার বিরুদ্ধে আন্দোলন, সেই স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা আন্দোলন দমাতে গিয়ে যা যা করলেন, তার সবই এটাকে সরকার পতন আন্দোলনের দিকে নিয়ে গেছে। কোটা বাতিলের পরিপত্র আদালত বাতিল করে দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হলো। তাদের অনেকে ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছিল। তারা আবার অনিশ্চয়তায় পড়ল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোটা সংস্কার আন্দোলন আবার শুরু হয়। প্রথম থেকেই শান্তিপূর্ণ হওয়ায় জনগণের সমর্থন পায়। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর শান্তিপূর্ণ মিছিলে বা সমাবেশে সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ, যুবলীগ আক্রমণ করল, মেয়েদের ওপর আক্রমণ করা হলো, এরপর আন্দোলনকে অবজ্ঞা করে ধূর্ত শেখ হাসিনা বক্তব্য দিলেন। এছাড়াও ফ্যাসিস্ট সরকারের লেলিয়ে দেয়া পুলিশ, র্যাব শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনরত নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করল, এসব ন্যাক্কারজনক ঘটনা মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলল। ১৬ জুলাই আবু সাঈদসহ সাতজন যখন নিহত হলো, তখন মানুষের প্রতিক্রিয়া এমন হলো যে আর কত সহ্য করা যায়? আবু সাঈদের ওপর যেভাবে গুলি হয়েছে এর তো কোনোভাবেই যৌক্তিকতা নেই। এর প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ মানুষ সমর্থন দিলো আন্দোলনে। একপর্যায়ে পাবলিক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা যখন পারছিল না, তখন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা এলো, যেটা ছিল সরকারের ধারণার বাইরে। পরে কলেজের শিক্ষার্থীরা, স্কুলের শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত আন্দোলনে যোগ দিলো, পুরো দেশে স্ফুলিঙ্গের মত ছড়িয়ে পড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতা আন্দোলন। যেভাবে শহীদ হন গত ৫ আগস্ট ২০২৪ ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার সংবাদে বিকাল তিনটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। অহিদ মিয়া উত্তরার আজমপুরের আমীর কমপ্লেক্স এলাকায় আসার পর বিজয় মিছিল করার আগেই গুলিবিদ্ধ হন সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের হাতে। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে ডাক্তার সংকট অবস্থা দেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেন। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে লড়তে রাতেই ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। এদিকে পরিবার খুঁজতে থাকে ইয়াতিম এই ছেলেকে। পরে ৭ তারিখ পরিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজে তার লাশ খুঁজে পায় এবং ৮ তারিখ সকাল ৯ টায় পরিবার লাশ গ্রহন করে। জানাজা ও দাফন ৮ আগস্ট শহীদ মো: অহিদ মিয়ার নিজ এলাকায় বাদ যোহর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে গাজীপুরের টঙ্গী মরখুন কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। অনুভূতি ও মন্তব্য শহীদ অহিদের বন্ধু মো: তানভীর আহমেদ বলেন, সে আমার খুব কাছের বন্ধু। হাসিখুশি নামাজি একজন ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি পরোপকারী ও বিশ্বস্ত ছিলেন। তিনি দেশের জন্য শাহাদত বরণ করেন। বৃদ্ধা মা ও তালাকপ্রাপ্তা বোনের এই সংসারের ভরণপোষণের জন্য সহযোগিতার আহবান করেন। বন্ধুর এই করুণ মৃত্যুর সুষ্ঠ বিচারের দাবি করেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম অহিদ মিয়ার অকাল মৃত্যুতে বয়স্কা বৃদ্ধা মা এবং তালাকপ্রাপ্তা বোন অতীব কষ্টে জীবন যাপন করছে। প্রিয় সন্তানকে হারিয়ে বৃদ্ধা মা এখন দিশেহারা। প্রস্তাবনা ১। শহীদের পরিবারের জন্য এককালীন আর্থিক অনুদান ও নিয়মিত মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করা। ২। মা ও বোনের স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্য একটা স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করে পরিবারের পাশে দাড়ানো। একনজরে শহীদ মোহাম্মদ অহিদ মিয়ার ব্যক্তিগত তথ্যাবলি নাম : শহীদ মো: অহিদ মিয়া জম্ম : ২ মে ১৯৯৭ জন্মস্থান : টঙ্গী, গাজীপুর পেশা : চাকুরিজীবী স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: পূর্ব আরিচপুর, ইউনিয়ন: সিট কর্পোরেশন, থানা: টঙ্গী, জেলা: গাজীপুর পিতা : মৃত মোহাম্মদ খোরশেদ মাতা : মোসা: ফোরখান বিবি পেশা : গৃহিণী, বয়স : ৫২ বছর মাসিক আয় : ১৫০০০ টাকা। আয়ের উৎস : চাকরি