Image of মো: নাঈম

নাম: মো: নাঈম

জন্ম তারিখ: ১৩ জানুয়ারি, ২০০৭

শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪

বিভাগ: ঢাকা_সিটি

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা: ছাত্র, সানারপাড় রওশন আরা ডিগ্রি কলেজ, নারায়নগঞ্জ, বিভাগ: মানবিক, সেশন-২০২৩-২০২৪ শাহাদাতের স্থান :যাত্রাবাড়ী থানা সংলগ্ন, ঢাকা

শহীদের জীবনী

“দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলা দুরন্ত এক তরুণের পরিচয়” শহীদের পরিচয় মো: নাঈম একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। বড় হয়ে উকিল হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। হয়তো কল্পনার জগতে ডুবে যেতেন আর ভাবতেন, ”আমার সমস্ত চেতনা যদি শব্দে শব্দে তুলে ধরতে পারতাম। ” শহীদ নাঈম বাবা মায়ের আদরের ছোট সন্তান ছিলেন। জন্ম ১৩ জানুয়ারি, ২০০৭। গ্রামের বাড়ী ঝালকাঠী জেলার নলছিটি উপজেলার রানাপাশা গ্রামে। তবে তার জন্ম রাজধানী শহর ঢাকায় এবং বেড়ে ওঠা নারায়নগঞ্জ জেলায়। তার বাবা জনাব কামরুল ইসলাম দুই ছেলেকে নিয়ে অনেক আশা করতেন। যে কারণে চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর ঢাকায় ফিরে আসেন। তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি গার্মেন্টসের কোয়ালিটি ম্যানেজার পদে চাকরি করতেন। যেখানে মাসিক ভাতা ছাড়া আর কোনো বিশেষ ভাতা ছিল না। যে কারণে অবসর নেয়ার পর তিনি একপ্রকার রিক্ত হাতেই ঢাকায় ফিরে আসেন। অতঃপর সন্তানদেরকে নিয়ে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী এলাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে ওঠেন। চাকরী জীবনের মাসিক বেতন থেকে সামান্য কিছু অর্থ জমিয়েছিলেন তিনি। ইচ্ছে ছিল যে কোনো ভাবে ঋণ করে হলেও সন্তানদের লেখাপড়া শেষ করাবেন। নতুন শহরে দুই মাস পেরিয়ে গেলেও অর্থাভাবে দোকান ভাড়া নিতে পারেননি তিনি। বাসা ভাড়া এবং সংসারের যাবতীয় খরচ বহন করতে গিয়ে পুঞ্জীভূত অর্থ যেতে থাকে নিচের দিকে। নাঈমের বড় ভাইয়ের এইচএসসি পাশের পর অর্থাভাবে উচ্চ শিক্ষা ব্যাহত হয়েছে। বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গ্রাফিক্স ডিজাইনের কোর্সে ভর্তি হয়েছেন। তবে সম্পূর্ণ ফি এখনও পরিশোধ করা হয়নি। শহীদের মা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। চিকিৎসকের পরামর্শে বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা দেয়া হয়েছে তাকে। শহীদ নাঈমের মায়ের চিকিৎসা ভাতা দেয়া যেতে পারে।তবে আর্থিক সংকুলান না থাকায় পরবর্তীতে ল্যাবে যাওয়া সম্ভব হয়নি তার। চাকরি জীবনে নাঈমের বাবার উপার্জিত অর্থ ছিল খুবই সামান্য। যেন নুন আনতে পান্তা ফুরায়। সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ ও বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হতো জনাব কামরুল ইসলামকে। ফলে গ্রামের পৈতৃক জমিতে পিতার রেখে যাওয়া টিনের ঘরই ছিল একমাত্র মাথা গুঁজার আশ্রয়স্থল। ওয়ারিশ সূত্রে পাওয়া তার কিছু আবাদি জমিও রয়েছে। যা প্রভাবশালী চাচাত ভাই দখল করে রেখেছেন। তাই গ্রামে ফিরে যাওয়ার শেষ রাস্তাটাও একপ্রকার বন্ধ। “চক্ষুর অন্তরালে, ধীরেধীরে এ করুন সুরে’’ জুলাই ১৮ ২০২৪। চারিদিকে তখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলে। ছাত্ররা অলিগলি মহাসড়ক অবরোধ করে তাদের দাবি দাওয়া প্রকাশ করে। আন্দোলনকে প্রতিহত করতে তৎকালীন স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি ইন্ধন দেয়। দলীয় ছাত্রদের হাতে লাঠিসোঁটা, রামদা, চাপাতি, হকিস্টিক, স্ট্যাম্প, ককটেল, দেশীয় অস্ত্র, রাইফেল প্রভৃতি তুলে নিতে বলে। সরাসরি পুলিশ বাহিনীকে টিয়ারশেল, রাবার বুলেট,ছররা গুলি ও ফায়ারের নির্দেশ দেয়া হয়। যার নেতৃত্বে ছিল তৎকালীন ঘাতক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। এসব বাঁধা অতিক্রম করে এগিয়ে যায় ছাত্ররা। দুর্বার সে আন্দলনে যোগ দেয় ২৪ এর শহীদ মো: নাঈম। বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তোলেন “স্পেশাল ওয়াটার সাপোর্ট ইউনিট এন্ড রিমেডি ইউনিট।” দু-দলে ভাগ হয়ে যান তারা। যার কমান্ডার হিসেবে মনোনীত হয় মুক্তিকামী ছাত্র শহীদ নাঈম। আন্দোলনকে সামনের দিকে নিতে তার নেতৃত্বে যাত্রাবাড়ীতে আরও ছোট ছোট ইউনিট গঠিত হয়। নাওয়া-খাওয়া ভুলে যায় তারা। এ যেন নতুন দিনের যুদ্ধ। আবারও দেশে ১৯৭১ সাল সংগঠিত হওয়ার ডাক দেয় দেশপ্রেমিক ছাত্র-জনতা। সকলে দীপ্ত কণ্ঠে আওয়াজ তুলে শপথ করেন। আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনী থেকে দেশকে মুক্ত করতেই হবে। ঢাকাসহ সারা দেশের রাজপথ অবরোধ করে রাখে ছাত্র-জনতা। যাত্রাবাড়ী সেক্টর কমান্ডার শহীদ নাঈমের চোখে ঘুম নেই। প্রতিদিন আন্দোলন থেকে ফিরে পতাকাটি জানালার গ্রিলে বেঁধে রাখেন। ভাল করে হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসেন। কিন্তু খেতে পারেন না। রাজপথের মুক্তিকামী জনতার কথা মনে পড়ে তার। মনে পড়ে ছয় বছরের শিশু রিয়া গোপের কথা। স্বৈরাচারী সরকারের দোসররা মাত্র ছয় বছর বয়সী শিশুকেও রেহায় দেয়নি। পরের দিনের প্রস্তুতি নিতে নিজের রুমে এসে প্ল্যাকার্ড ডিজাইন করেন নাঈম। নির্ঘুম রাত কেটে যায় ভঁয়ে ভঁয়ে। কি হবে কাল? পরদিন শুক্রবার, ১৯ জুলাই, ২০২৪। বাবা এবং ভাইকে নিয়ে মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়তে যান নাঈম। বাড়িতে ফিরে পারিবারের সাথে খাওয়া-দাওয়া শেষ করেন। অতঃপর শহীদের বাবা জানান-তার শরীরে জ্বর অনুভূত হয়েছে। বাসার দরজা বন্ধ করে তিনি বিশ্রামে যান। চারিদিকের হট্টগোলের আওয়াজ জানালা দিয়ে ভেসে আসে। বহু লোকের মিলিত চিৎকারে যেন দম বন্ধ হয়ে আসে জনাব কামরুল ইসলামের। সেদিন ছুটির দিন থাকায় কলেজ বা প্রাইভেট টিউশন সবই বন্ধ ছিল। যার কারনে আন্দোলনে শামিল হওয়ার অজুহাত খুঁজতে থাকেন এই বীর সৈনিক। বারবার জানালা দিয়ে রাজপথের দিকে চেয়ে অসহায়চিত্তে নিজের উপর রাগ করছিলেন। বাবার দরজায় উঁকি দিয়ে দেখলেন বাবা ঘুমিয়েছে। সাথে সাথে পতাকা রেখে বাইরে বেরিয়ে আসেন তিনি। কারণপতাকা গ্রিলে না দেখলে তার বাবা বুঝে যাবেন যে ছেলে আন্দোলনে গিয়েছে। যে আলোর দ্বীপ নিয়ে বের হয়েছিল নাঈম, সে কি পেরেছিল দেশটাকে আলোকিত করতে? কিছুক্ষণ পর বাসার দরজা বন্ধ দেখে শহীদ জননীর সন্দেহ হয়। ছেলেকে খুঁজে আনতে অনুরোধ জানায় তার স্বামীর কাছে। নাঈমের বাবা বলেন, আমি অসুস্থ। তুমিও আমার সাথে চল। অতঃপর দুজন মিলে নাইমকে খুঁজতে বের হয়। রাত আটটা পার হলে তাঁরা ভাবেন হয়তো যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ তাদের গ্রেফতার করেছে। তবে থানার ডিউটি অফিসার জানায়,আমাদের থানা পরিপূর্ণ। নতুন একজনকেও রাখার মতো জায়গা থানায় নেই। যে কারনে আজ কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। যাত্রাবাড়ীর প্রতিটি অলিগলি খুঁজে ব্যর্থ হয় নাঈমের বাবা-মা। একে একে পার করেন রাত নয়টা থেকে দুইটা। তারপর সন্তানকে না পেয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। আদরের সন্তানকে ছাড়া বিনিদ্র রজনী কাটে বাবা-মায়ের। সন্তানের লাশ যে বাবা কাঁধে নেন তিনিই বোঝেন হারানোর বেদনা শোকের সাগরে নিমজ্জিত পরিবার পরদিন শনিবার, ২০ জুলাই ২০২৪। সারাদেশে কারফিউ জারী করে হাসিনা সরকার। সন্তানকে খুঁজতে বাধ্য হয়ে ছদ্ববেশে লুঙ্গী পরিহিত অবস্থায় আবারও বের হন জনাব কামরুল ইসলাম। ঢাকা মেডিকেলের প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে প্রতিটি মর্গে সন্তানকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ান তিনি। সর্বশেষ হিমঘরে মেলে আদরের সন্তানের লাশ। সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে পড়েন তিনি। পরবর্তীতে শহীদের লাশ হস্তান্তর প্রক্রিয়া শেষে রাত ১১ টার দিকে গ্রামের বাড়ী রানাপাশা, নলছিটি, ঝালকাঠি পৌঁছে। এরপর ২১ জুলাই রবিবার স্থানীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে নিজস্ব পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় শহীদ মো: নাঈমকে। তাকে হারিয়ে যেন পাগলপ্রায় দশা পরিবারটির। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন চরমভাবে ভেঙে পড়েছে। যে শহরে স্বপ্ন গড়তে এসেছিলেন নাঈমের বাবা, সে শহর ঠিক থাকলেও শুধু নেই স্বপ্নবাজ এক তরুণ। যে সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। প্রিয় সন্তানকে হারিয়ে জনাব কামরুল ইসলাম যেন আজ জীবন্ত লাশ। প্রতিবেশীর অনুভূতি মো: রাকিব বলেন, “মাঝে মাঝে খেয়াল করতাম প্রায়ই একটা ছেলে মাথা নিচু করে কলেজে যায়। রাস্তার অনেককেই সালাম দেয়। ছোটদের দেখলে কেমন আছে জিজ্ঞাসা করে। মসজিদে যাওয়া আসা করে। এত ভদ্র ছেলে আমাদের পাড়ায় এর আগে তেমন একটা চোখে পড়েনি। যতই দেখতাম মুগ্ধ হতাম আমরা। সালাম ছাড়া তার সাথে তেমন কোনো কথা হয়নি আমার। ছেলেটির নাম যে নাঈম ওর মৃত্যুর পরে জানতে পেরেছি। এখনও কানে তার সালাম ভেসে আসে।” খুনি হাসিনা বলে- ‘এদেশে কুকুর, বিড়াল, বন্য প্রানী পিটিয়ে মারলেও আইনের আওতায় আসতে হবে।’ হয়ত মনে মনে ভেবেছিল মানুষ মারাটা নিছকই ছেলেখেলা। এই নরখেকো রক্তপিপাসু স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার বিচার হবেই। যার বিচার মুক্তিকামী এই স্বাধীন দেশের নাগরিকরাই করবেন। এক নজরে শহীদের ব্যক্তিগত প্রোফাইল নাম : মো: নাঈম পেশা : ছাত্র জন্ম তারিখ ও বয়স : ১৩ জানুয়ারি ২০০৭, ১৭ বছর শহীদ হওয়ার তারিখ : ১৯ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার, আনুমানিক বিকেল ৪.১৫ শাহাদাত বরণের স্থান : যাত্রাবাড়ী থানা সংলগ্ন দাফন করা হয় : নিজস্ব পারিবারিক কবরস্থান স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: রানাপাশা, থানা: নলছিটি, জেলা: ঝালকাঠি পিতা : মো: কামরুল ইসলাম মাতা : মাহমুদা পারভিন ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : বসতি জমি রয়েছে। আবাদি জমি দখল নিয়েছে প্রভাবশালী চাচা ভাইবোনের বিবরণ : মো: নোমান, সম্পর্ক: ভাই, বয়স: ২২, পেশা: ছাত্র প্রস্তাবনা শহীদের বড় ভাইকে কর্মসংস্থান করে দেয়া যেতে পারে। বাবা ব্যবসা করতে চায়। তবে পুঁজি স্বল্পতায় ভুগছেন। এককালীন সাহায্য পেলে ব্যবসা করবেন।

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of মো: নাঈম
Image of মো: নাঈম
Image of মো: নাঈম
Image of মো: নাঈম
Image of মো: নাঈম
Image of মো: নাঈম
Image of মো: নাঈম
Image of মো: নাঈম

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

গঙ্গা চরন রাজবংশী

অজ্ঞাত

মো: রমজান আলী

মোঃ নুরু বেপারী

মো: মনসুর মিয়া

মো: মনিরুল ইসলাম

মো: মনির হোসাইন

মো: মাসুদ

মো: জাহিদ-এ-রহিম

মো: সালাউদ্দিন সুমন

 মো: জাহাঙ্গীর আলম

আলাউদ্দিন

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo