Image of কাজী মো: আব্দুর রহমান

নাম: কাজী মো: আব্দুর রহমান

জন্ম তারিখ: ৩ জুলাই, ১৯৮০

শহীদ হওয়ার তারিখ: ৩১ জুলাই, ২০২৪

বিভাগ: ঢাকা

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা : কৃষক, শাহাদাতের স্থান : ঢাকা মেডিকেল কলেজ।

শহীদের জীবনী

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তথা জুলাই বিপ্লবে স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের পৈশাচিকতার শিকার, বাংলার বীর কৃষক আর দূর্ভাগা পিতাদের অন্যতম একজন প্রতিনিধি শহীদ কাজী মোঃ আব্দুর রহমান, নিজের মহামূল্যবান জীবন বিলিয়ে দিয়ে দেশের প্রতি; দেশের মানুষের প্রতি কিছু দায়িত্ব রেখে গেছেন। শহীদ কাজী মো: আব্দুর রহমান ১৯৮০ সালের ৩ জুলাই নরসিংদী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা কাজী মো: আমির উদ্দিন মিয়া এবং মাতা মোছা: ফাতেমা বেগম। শহীদ কাজী মো: আব্দুর রহমান পেশায় ছিলেন একজন কৃষক। এলাকায় তিনি একজন সৎ এবং ধার্মিক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। শহীদের সাধারণ জীবন কাজী মোঃ আব্দুর রহমান অতি সাধারন একজন মানুষ ছিলেন। কৃষিকাজ করে জীবন নির্বাহ করতেন তিনি। সারাদিন কাজের ব্যস্ততা আর পারিবারিক দায়িত্ব পালনের মাঝেও দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম চর্চাকে খুবই গুরুত্ব দিতেন তিনি। কৃষক হিসেবে ক্ষেতে খামারে কাজ করলেও বেশভূষায় থাকতেন পরিপাটি। পায়জামা পাঞ্জাবি আর টুপি ছিলো তার প্রিয় পোশাক। শত ব্যস্ততার মাঝেও নামাজ ছাড়তেন না তিনি। দু'বেলা দু'মুঠো ভাতের জন্য সংগ্রাম আর ইবাদত বন্দেগি করেই জীবন অতিবাহিত করতে চাইতেন তিনি। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে উপযুক্ত জায়গায় বিয়ে দেয়ার মতো সুন্দর এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। রাষ্ট্র, সরকার ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি গ্রামবাংলার কৃষক শহীদ কাজী মোঃ আব্দুর রহমান সাহেবের মতো বাংলাদেশের সাধারন মানুষও চায় দু'বেলা দুমুঠো খেয়ে-পড়ে বেঁচে-বর্তে থাকতে। অথচ সেই মৌলিক চাহিদাটুকু পূরণ করতে পারাটাই যেন অসাধ্য সাধন এই বৈষম্যের সমাজের। মুসলমান হিসেবে দাঁড়ি টুপি থাকাটাই যেন আজ সবচেয়ে বড়ো বিপদ। দেশের ইসলামবিদ্বেষী সরকার মুসলমানদের উপর যেমন জুলুম করেছে, তেমনি সবজায়গায় হরিলুট করে দেশের মধ্যে তৈরি করেছে এক কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ। দিনের ভোট রাতে করা নির্লজ্জ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার একের পর এক ডামি-নির্বাচন করে সিন্দাবাদের ভুতের মতো রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে বসে আছে। বিরোধী দলের প্রতিনিয়ত ন্যায্য দাবির আন্দোলন; মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বিবৃতি; সুশীল সমাজের পরামর্শ; আন্তর্জাতিক হুশিয়ারি; আলেম-ওলামাদের প্রতিবাদ; নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির সামাজিক আত্মাহুতি; গণমানুষের আহাজারি কোনো কিছুই তারা গ্রাহ্য করছে না। বরং বিরোধী দল-মত দমনের জন্য সারাদেশে শুরু করলো গণগ্রেপ্তার, গুম-খুন, জেল-জুলুম আর অত্যাচার-নির্যাতন। কারাগার আর আয়নাঘরে ভরে ফেললো বাংলাদেশ। হঠাৎ উত্তপ্ত রাজপথ ভোটচোর আওয়ামী সরকার তার গুম-খুন রাজনীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখে ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। জুলাইয়ের শুরুতে ছাত্রদের করা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে ঘুরানোর জন্য সরকার নানা রকম কুটচাল চালতে থাকে। তাদের কোনো চালে ধরা না দিয়ে রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সাধারন শিক্ষার্থীদের এমন দৃঢ়তা দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে স্বৈরাচার সরকার। ১৬ জুলাই থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর নৈরাজ্য। গুম, খুন, হত্যা। ১৭, ১৮ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চালায় গণহত্যা! শহীদের মিছিলে যুক্ত হয় আবু সাঈদ আর মুগ্ধ'র মতো শত শত শিক্ষার্থীর নাম। ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার রাতে ছাত্রদের খুনে হাত রাঙানো স্বৈরাচার হাসিনা ইন্টারনেট বন্ধ করে সারাদেশে কারফিউ জারি করে। নিত্য প্রয়োজনীয় জরুরী কাজছাড়া কেউ বাসা থেকে বের হতে পারবে না। যেকোনো জায়গায় ১০/১২ জন একসাথে দেখলেই চালানো হচ্ছে গুলি। এমন অবস্থায় ১৯ জুলাই শুক্রবার জনাব কাজী আব্দুর রহমান পরিবারের জন্য বাজার করতে বের হতে চাইলে তার স্ত্রী ও ছেলে মেয়েদের বাঁধায় আর বের হতে পারেননি। কিন্তু "কারফিউর মধ্যে কেনো বাজারে যেতে পারবো না? সরকার কি আমাকে ঘরে খাবার এনে দিবে? আমি কি কোনো দল করি? আর গতকাল সরকার তো ঘোষণা দিয়েছেই যে হাটবাজারসহ জরুরী প্রয়োজনে বাইরে বের হওয়া যাবে। তাহলে আর কি সমস্যা?" নিজের স্ত্রী আর সন্তানদেরকে সেদিন এমন কিছু সরল প্রশ্ন করেছিলেন সদালাপী সহজ সরল ধর্মপ্রাণ মানুষটি। তারা তাকে এই বলে সান্ত্বনা দেয় যে আজকে ঘরে যা আছে তাই দিয়ে কষ্ট করে চলে যাবে, তিনি যেন পরের দিন বাজার করে নিয়ে আসেন। স্ত্রী-সন্তানের কথা সহজেই মেনে নেন শহীদ আব্দুর রহমান। আহত হওয়ার ঘটনা ২০ জুলাই ২০২৪ শনিবার দুপুর ৩টায় কাজী আব্দুর রহমান বাজার করার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে পাঁচদোনা মোড়ে যান। একটি রিকশাতে করে গিয়ে বাজারের সামনে পৌঁছানোর পর রিক্সা থেকে নেমে বাজারের ভিতরে ঢুকবেন এমন সময় কোনো রকম ঘোষণা, মাইকিং বা সংকেত ছাড়াই স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের সন্ত্রাসী বিজিবি বাহিনী মানুষকে ভীত করার উদ্দেশ্যে সাধারণ জনতাকে লক্ষ্য করে অনবরত গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে চলে আসে বাজারের সামনে। এখানে এসে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়ে স্বৈরাচারীর পদলেহনকারী বিজিবি বাহিনী। এগুলোর মধ্যে একটি গুলি জনাব কাজী মোঃ আব্দুর রহমানের পিঠ দিয়ে ঢুকে পেট দিয়ে বের হয়ে যায়। সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে কিছু বুঝে ওঠার আগেই এসব ঘটে যায়। কোনরকম হুঁশিয়ারি ছাড়াই বিজিবি হঠাৎ করে গুলি শুরু করে। শরীরে গুলি লাগলে পেট ফুটো হয়ে ভূরি বের হয়ে আসে তার। তিনি পেটে হাত দিয়ে মাটিতে পড়ে যান। শহীদকে উদ্ধার প্রচেষ্টা ঘটনাস্থলে উপস্থিত জনতা প্রথমবার চেষ্টা করেও তাকে খুনি বিজিবির হাত থেকে উদ্ধার করতে পারেনি। বিজিবি তখন অনবরত গুলি বর্ষণ করছিলো নিরীহ-নিরস্ত্র মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার বজ্রকণ্ঠ চিরতরে রোধ করার জন্য। সেখানে আরো অনেকে শাহাদাত বরণ করেন। পরিচিত একজন আব্দুর রহমানের বাড়ীতে খবর জানান। খবর পেয়ে শহীদের ছেলে আর ভাতিজা বাড়ি থেকে ছুটে চলেন বাজারের দিকে। তারা গ্রামের রাস্তা দিয়ে দৌড়ে বাজারে যাবার সময় সেই রাস্তায়ও বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েকটি লাশ পড়ে থাকতে দেখে। ফলে মূহুর্তের মধ্যে এখানে কি হয়ে গেছে তা তারা অনুমান করতে পারে। স্বৈরাচারী বিজিবি সাধারণ একটা গ্রামের ছোট রাস্তায় ঢুকেও মানুষ হত্যা করতে কুন্ঠাবোধ করেনি। একটার পর একটা লাশ ঠেঙ্গিয়ে সামনে আগাতে ভয় লাগছে দুই চাচাতো ভাইয়ের। কিন্তু জন্মদাতা পিতাকে; বাবার মতো চাচাকে তো উদ্ধার করতেই হবে। একটা সময় তারা পৌঁছে যায় বাজারের সামনে। একটু দূর থেকেই দেখতে পায় শহীদ কাজী আব্দুর রহমান মাটিতে পড়ে আছেন। আর মাত্র কয়েক কদম গেলেই পৌঁছা যাবে তার কাছে। এমন সময় আবার রক্ত পিপাসু বিজিবির গুলি। একটু দূরেই যে বিজিবির গাড়ি ছিলো তারা তা লক্ষ্য করেনি। সাথে সাথে তারা পিছনের দিকে সরে যায়। বিজিবির মুহুর্মুহু গুলিতে কোনোভাবেই আর সামনে আগানো যাচ্ছে না। দুই চাচাতো ভাই বুদ্ধি করে আরও একটু পিছনে গিয়ে রাস্তা থেকে বিলের মধ্যে নেমে যায়। তারপর ফসলের ক্ষেত পেরিয়ে বনের ভিতর দিয়ে গিয়ে বাজারের পিছন দিক দিয়ে ঢুকে। আস্তে আস্তে চুপিচুপি পদক্ষেপে সামনের দিকে এগিয়ে যায় দুজন। একটা সময় বাজারের সামনে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। তারপর বিজিবির গুলির শব্দ কিছুটা কমে আসলে তারা দৌড়ে যায় শহীদ আব্দুর রহমানের কাছে। দুই ভাই মিলে শহীদকে রাস্তা থেকে তুলতে যাবে এমন সময় তাদের পিছন দিক থেকে কয়েকজন বিজিবি চিৎকার করে উঠে। বিচ্ছিরি ভাষায় গালিগালাজ করে তাদের দুজনকে। একজন রেগে গিয়ে কিছু একটা ছুড়ে মারে তাদের দিকে। আরএকজন বিজিবি সদস্য তাদেরকেও গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে গুলি করার প্রস্তুতি নিতে গেলে অন্য একজন বিজিবি সদস্য তাকে বাধা দেয় আর দুই চাচাতো ভাইকে ইশারা করে তাড়াতাড়ি লাশ নিয়ে চলে যেতে। শহীদের লাশের পাশে নিজেরাই যখন মনে মনে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল ঠিক তখন বিজিবির মধ্য থেকেই একজন সদস্যের এমন সংকেত পেয়ে যেন তাদের সাহস বেড়ে গেলো। কাল বিলম্ব না করে দুইজন মিলে শহীদ আব্দুর রহমানকে নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যায়। উদ্ধার ও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া শহীদ আব্দুর রহমানের ছেলে আর ভাতিজা তাঁকে বাজারের ভিতরের দিকে মাছ বাজারের মধ্যে নিয়ে আসে। তারপর তারা কয়েকটি এম্বুলেন্সকে কল করে। কিন্তু এখানকার উত্তপ্ত পরিস্থিতির কথা শুনে কোনো একটা এম্বুলেন্স আসতে রাজি হয়নি। অবশেষ উপস্থিত হাটুরেদের মধ্য থেকে কয়েকজনের সহযোগিতায় একটা মাছের ভ্যান খালি করে সেটাতে করেই তারা নরসিংদী জেলার সদর হাসপাতালে নিয়ে যায় শহীদ আব্দুর রহমানকে। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান আব্দুর রহমান এখনো মৃত্যু বরণ করেননি। তিনি এখনো বেঁচে আছেন! কিন্তু তার অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক। তাকে বাঁচাতে হলে যত দ্রুত সম্ভব ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। বাবা বেঁচে আছেন! চাচা বেঁচে আছেন! ডাক্তারের মুখে এমন সংবাদ শুনে জীবনের শ্রেষ্ঠতম খুশি হয় যেন শহীদের ছেলে আর ভাতিজা। সাথে সাথে তারা এই সুসংবাদ তাদের পরিবারকে জানায়। কেননা এর আগে ভ্যানে করে তাকে নিয়ে আসার সময় বাড়িতে কল করে শাহাদাতের খবর জানানো হয়। জনাব আব্দুর রহমানের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে তার পরিবারের সদস্যরা তখনই রওনা দিয়েছিল জেলা হাসপাতালের দিকে। পথিমধ্যে আবার তার বেচে থাকার সংবাদে যারপরনাই খুশি হয়ে যায় তারা। ডাক্তারের পরামর্শ মতো সকলে মিলে একটা এম্বুলেন্স ভাড়া করে এবার গুরুতর আহত আব্দুর রহমানকে নিয়ে পরিবার রওনা দিলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে ঘাতক পুলিশ বিজিবির বাঁধা আহত আব্দুর রহমানকে বহনকারী এম্বুলেন্স ঢাকা শাহবাগ মোড় দিয়ে যাবার সময় সেখানে টহলরত পুলিশ আর বিজিবি এম্বুল্যান্সের গতিরোধ করে। আটকে দেয় তাদের গাড়ি। খুনি পুলিশ আর নিষ্ঠুর বিজিবি গুলিবিদ্ধ আহত আব্দুর রহমানকে হাসপাতালে ভর্তি হতে দিবে না। আহত আব্দুর রহমানের শ্যালকেরা বিভিন্নভাবে তাদেরকে বুঝাতে থাকেন। তারা কোনোভাবেই এই রোগীকে হাসপাতালে নিতে দিবে না। তাহলে নাকি তাদের চাকরি থাকবে না। স্বৈরাচারের পা চাটা এই বাহিনী দুটোকে নানাভাবে বুঝাতে বুঝাতে অনেক সময় চলে যায়। স্বৈরাচার পুলিশ আর বিজিবি এরকম সরকারি আক্রমণে আহত রোগীকে কোনো হাসপাতালে কিছুতেই ভর্তি হতে দিবে না। ওইদিকে আহত আব্দুর রহমানের অবস্থা খুবই খারাপ। প্রতিনিয়ত রক্তক্ষরণ হচ্ছে তার শরীর থেকে। এমন সময় আহত আব্দুর রহমানকে বাঁচানোর জন্য তার এক শ্যালকের মাথায় আসলো নতুন কৌশল। তার মনে পড়ে গেলো বাংলাদেশের পুলিশের চিরায়ত চরিত্রের কথা। সাথে সাথে তিনি পুলিশের একজন অফিসারকে একপাশে ডেকে নিয়ে তার হাতে বেশ কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বিজিবিকে ম্যানেজ করতে অনুরোধ করে। হারামখোর সেই পুলিশের চেষ্টায় অবশেষে কাজ হলো। তারপর আবার ঢাকা মেডিকেলের দিকে ছুটে চলে আহত আব্দুর রহমানকে বহন করা এম্বুলেন্স। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে তাকে নিয়ে এম্বুলেন্স পৌঁছালো ঢাকা মেডিকেলের ইমারজেন্সি বিভাগে। হাসপাতালে ভর্তিতে বাধা হাসপাতালে পৌঁছে আহত আব্দুর রহমানকে ভর্তি করতে গেলে সেখানেও বাঁধা। স্বৈরাচার সরকারের বাহিনী দ্বারা আহতদেরকে ভর্তি নিতে তারা প্রচণ্ড রকম নারাজ। মনে হয় যেন পুরো দেশটাকে তারা ইজারা নিয়েছে। এইসব ন্যাক্কারজনক দৃশ্য দেখে আহত আব্দুর রহমানের ছেলে আর ভাতিজা কর্তব্যরতদের উপর রেগে যেতে নিলে তার শ্যালক তাদেরকে শান্ত করেন। অমানবিক শর্ত মেনে ভর্তি অনেক অনুনয় বিনয় করেও যখন স্বৈরাচার কর্মকর্তা কর্মচারীদের মন গলানো গেলো না তখন শাহবাগে পুলিশ আর বিজিবিকে যেভাবে ম্যানেজ করে এসেছে এখানেও সেভাবে ম্যানেজ করে আহত আব্দুর রহমানকে ভর্তি করানো হয়। তবে শর্ত থাকে যে হাসপাতালের চিকিৎসাদি দ্রব্য, ঔষধ, খাবার এই ধরনের সরকারি কোনো সুবিধাই আহত আব্দুর রহমানকে দেয়া হবে না। সবকিছুই তাকে কিনে নিতে হবে এবং যা কিছুই ঘটুক না কেনো এখানে কোনো কান্নাকাটি করা যাবে না। কোনো মিডিয়ার সাথে কথা বলা যাবে না। এসব কথার যদি কোনো হের ফের হয় তাহলে সাথে সাথে রুগীকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়া হবে। নিরুপায় হয়ে স্বৈরাচারের সকল শর্ত মেনে নেয় আহত আব্দুর রহমানের পরিবার। ঢাকা মেডিকেলে ১২ দিন ভর্তি করানোর পরে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আহত আব্দুর রহমানকে প্রথমে ঢালাও বিছানায় এবং কিছুদিন পরে বেডে দেয়া হয়। ওই সময়ে ঢাকা মেডিকেলে কেবল রোগী আর রোগী। বেশির ভাগই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনে আহত। ১৬,১৭,১৮ জুলাইয়ের রোগী বেশি। তখন সরকারের সরাসরি নিষেধাজ্ঞা ছিলো না, তাই ভর্তি নিতো। ভর্তির প্রায় চারদিন পরে আহত আব্দুর রহমানের অপারেশন হয়। ৮ ব্যাগ রক্ত লাগে তার। একে তো পরিবারের বেশিরভাগ আত্মীয়স্বজন গ্রামের বাড়িতে আছে তার উপর আবার দেশের এমন উত্তপ্ত অবস্থা। তাই রক্ত বা ডোনার সংগ্রহ করা সোনার হরিণ সংগ্রহ করার মতো অসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অবশেষে অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পরে রক্ত সংগ্রহ হয় এবং আহত আব্দুর রহমানের অপারেশন হয়। অপারেশন শেষে টানা ছয় দিন আইসিইউতে থেকে স্বৈরাচার হাসিনার বিষাক্ত কামড়ের সাথে লড়াই করতে করতে ৩১ জুলাই সকাল ৭টা বাজে মহান মুনিবের ডাকে সারা দিয়ে শহীদের অমর পেয়ালা পান করেন ধর্মপ্রাণ কাজী মো: আব্দুর রহমান। সন্তানদের পড়াশোনা করিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে নিজের হাতে তাদের উপযুক্ত জায়গায় বিয়ে দেয়ার মতো সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ ইহজগতে আর দেখা হলো না তার। শহীদের লাশ আনতে বাঁধা শহীদ কাজী মো: আব্দুর রহমানের শাহাদাতের পরে তার পরিবার যখন হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তারা জানতে পারে, হাসপাতাল থেকে লাশ দেয়া হবে না। এ ব্যাপারে নাকি সরকারের নির্দেশনা পেয়েছে হাসপাতাল। কেউ যদি একান্তই লাশ নিতে চায় তাহলে পুলিশের সাথে সমঝোতা করে নিতে হবে। এমন তথ্য পেয়ে পুলিশের কাছে ছুটে যায় শহীদ আব্দুর রহমানের পরিবার। এবার আর কোনো কথা বুঝিয়ে কাজ হয়নি। ফ্যাসিস্ট পুলিশের এক কথা। প্রশাসন বা সরকার দলীয় কারো দ্বারা আক্রান্ত কোনো লাশ পারিবারের কাছে হস্তান্তর করা যাবে না। অতঃপর এখানেও কিছু টাকা পয়সা দিলে, দায়িত্বরত পুলিশ অফিসার জানায়, শহীদের নামে জঙ্গি মামলা হলে লাশ দেয়া যেতে পারে। অর্থাৎ শহীদ কাজী মোঃ আব্দুর রহমান একজন জঙ্গি ছিলেন এবং একারণেই তিনি বিজিবির সাথে সম্মুখ যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন, এমন লিখিত কাগজে শহীদ পরিবার স্বাক্ষর করলে তবেই তাদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা যেতে পারে; নয়তো এই লাশ হাসপাতালের মর্গে নষ্ট হবে অথবা বেওয়ারিশ জঙ্গি লাশ হিসেবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে জমা দেয়া বা সরকারি নির্দেশ মতো অন্য যেকোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে। নির্লজ্জ খুনি পুলিশের মুখে এমন লোমহর্ষক কথা শুনে তাজ্জব বনে যান শহীদ পরিবার। অবশেষে তারা গুন্ডা পুলিশের কথায় রাজি হয়ে তাদের কাগজে স্বাক্ষর করেন। সারাজীবন কোনো দল বা রাজনীতি না করা বাংলার এক পরহেজগার সাধারণ কৃষক স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের নৃশংস গণহত্যার শিকার হয়েও মৃত্যুর মাত্র কয়েক মূহুর্তেই একজন জঙ্গির পরিচয় পেয়ে গেলেন। পরিবারের একমাত্র অভিভাবকের এমন করুণ মৃত্যুতে কেউ যেন কান্না করারও সাহস পাচ্ছে না। প্রতিমুহূর্তে একটা না একটা নতুন নৈরাজ্যের মুখোমুখি হতে হচ্ছে শহীদ পরিবারকে। এই অবর্ণনীয় বর্বরোচিত সেক্টরগুলো একটা একটা করে চুকিয়ে ৩১ জুলাই বিকাল ৫ টায় শহীদ কাজী মো: আব্দুর রহমানের মরদেহ নিয়ে এম্বুলেন্স রওনা দেয় নরসিংদীর উদ্দেশ্যে। নিজের বাড়িতে শহীদের লাশ সন্ধ্যার পরে শহীদের লাশের গাড়ি নিজ বাড়িতে পৌঁছালে চারদিকে কান্নার রব শোনা যায়। এমন সহজ সরল নির্ভেজাল একজন নামাজি ব্যক্তির এরকম নির্মমভাবে শহীদ হওয়ার কথা শুনে আশপাশের গ্রাম থেকেও ছুটে আসে শত শত মানুষ। অবশেষে ঐ রাতেই বাদ এশা শহীদের নিজ জন্মস্থান চৌয়া, মেহেরপারা দাখিল মাদ্রাসার মাঠে হাজারো জনতার উপস্থিতিতে জানাজা শেষে মেহের পাড়ায় সামাজিক কবরস্থানে দাফন করা হয় শহীদ কাজী মোঃ আব্দুর রহমানকে। স্মৃতিচারণ শহীদ সম্পর্কে তাঁর ভাতিজা জনাব মোঃ ওবায়দুর রহমান বলেন- "মোহাম্মদ আবদুর রহমান, তিনি একজন আলেম ছিলেন। তিনি নির্দিষ্ট কোন দলের অধিভুক্ত নন। তিনি একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন।" শহীদের পারিবারিক অবস্থা শহীদ কাজী মোঃ আব্দুর রহমান স্ত্রী ও তিন সন্তান রেখে গেছেন। তার স্ত্রী সায়েমা আক্তার একজন গৃহিণী। শহীদের ২০ বছর বয়সী বড়ো মেয়ে তৌফিকা রহমান এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী। ১৬ বছর বয়সী ছোট মেয়ে তৌহিদা রহমান এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। আর ১৪ বছর বয়সী একমাত্র ছেলে মোঃ তৈবুর রহমান নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। কাজী মোঃ আব্দুর রহমান শহীদ হওয়ায় তারা তিন ভাইবোন বাবাহারা এতিম হয়ে গেলো। পরিবারের একমাত্র অভিভাবক শ্রদ্ধেয় পিতার এমন করুণ মৃত্যু তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। শোক প্রকাশের ভাষাও যেন হারিয়ে ফেলেছে শহীদের স্ত্রী ও সন্তানেরা। শহীদ পরিবারের আর্থিক অবস্থা বর্তমানে খুবই সীমত পরিসরে শহীদ পরিবারকে সহযোগিতা দিচ্ছেন শহীদ কাজী মোঃ আব্দুর রহমানের শ্যালকরা। তার ৬ শতাংশ জমির উপর একটা পাকা ঘর আছে এবং ২২ শতাংশ আবাদী জমি আছে। আশেপাশের মানুষের সহায়তায় বর্তমানে শহীদের পারিবারিক ভরণপোষণ চলছে। শহীদ কাজী মোঃ আব্দুর রহমানের পরিবার প্রায় ২ লক্ষাধিক টাকার ঋণে আছে। তার তিন সন্তানের পড়ালেখা অনেকটা বন্ধের পথে। একমাত্র উপার্জনক্ষম অভিভাককে হারিয়ে শহীদ পরিবার অর্থনৈতিকভাবে খুব কষ্টে এবং শোকে দিন কাটাচ্ছে। প্রস্তাবনা শহীদের রেখে যাওয়া ঋণ পরিশোধ করা, শহীদ সন্তানদের পড়ালেখার সুব্যবস্থা করা, সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য চাকরি নিশ্চিত করা, একমাত্র বিধবা স্ত্রীর ভরণপোষণের জন্য মাসিক ভাতা চালু করা এবং দুটি মেয়েকে সুপাত্রের কাছে পাত্রস্থ করার দায়িত্ব সরকারের পাশাপাশি আমাদের সকলের। একনজরে শহীদ কাজী মো: আব্দুর রহমান পূর্ণ নাম : কাজী মো: আব্দুর রহমান জন্ম তারিখ : ৩ জুলাই ১৯৮০ জন্মস্থান : নরসিংদী নিজ জেলা : নরসিংদী পেশাগত পরিচয় : কৃষক বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম : দক্ষিণ চৌয়া, ইউনিয়ন : মেহেরপারা, থানা : মাধবদী, জেলা : নরসিংদী পিতার নাম : কাজী মোঃ আমির উদ্দিন মিয়া মায়ের নাম : মোসাঃ ফাতেমা বেগম পরিবারের বর্তমান সদস্য সংখ্যা : ০৪ মাসিক আয় ছিলো : ১৫০০০ টাকা ঘটনার স্থান/পয়েন্ট/এলাকা : পাঁচদোনার মোড়, মাধবদী আক্রমণকারী/আঘাতকারী : শেখ হাসিনার ঘাতক বিজিবিবাহিনী আহত হওয়ার সময়কাল : ২০ জুলাই ২০২৪, বিকাল ৩.৩০ মিনিট মৃত্যুর তারিখ, সময়, ও স্থান : ৩১ জুলাই ২০২৪, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শহীদের জানাজা : বাদ এশা, দক্ষিণ চৌয়া দাখিল মাদ্রাসার মাঠ শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : চৌয়া মেহেরপাড়া, পাথর

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of কাজী মো: আব্দুর রহমান
Image of কাজী মো: আব্দুর রহমান
Image of কাজী মো: আব্দুর রহমান
Image of কাজী মো: আব্দুর রহমান

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

মো: আল আমিন

মো: আবদুল্লাহ ইবনে শহীদ

মো: সোহেল

আহসান কবির (শরিফ)

তাওহিদ  সন্যামাত

মোঃ জালাল উদ্দিন

ইমরান হাসান

শেখ রাকিব

মো: ইরফান ভূঞা

মোঃ বাবুল মিয়া

আরমান মোল্লা

মো: ইসমাইল মোল্লা

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo