জন্ম তারিখ: ১ জানুয়ারি, ১৯৯৫
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা : মোটর মেকানিক, শাহাদাতের স্থান : মধ্য বাড্ডা, ঢাকা।
শহীদ সিরাজুল বেপারী তাইজুদ্দিন মুন্সীডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানায় এই গ্রামের অবস্থান। ছোটকাল থেকেই তিনি একটু সহজ সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম এবং শিরিন আক্তার দম্পতির ঘরে ১৯৯৫ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েই লেখাপড়া জীবনের ইতি টানেন। তারপর উপার্জনের তাগিদে ঢাকাতে চলে আসেন। মোটর কার গ্যারেজে কাজ নেন। অনেক পরিশ্রম এবং মনোযোগের সাথে অন্যের গ্যারেজে কাজ করে অবশেষে তিনি ভালো মানের একজন মেকানিক হয়ে ওঠেন। ঢাকার স্বনামধন্য লোকজন তার কাছে গাড়ি মেরামত করতো। গত দুই বছর আগে তিনি পিংকি খাতুনের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ঘরে এখন পর্যন্ত কোন সন্তান আসেনি। তবে অনেক স্বপ্ন ছিল সুন্দর করে সংসার সাজানোর। অবশেষে সকল স্বপ্ন ভেঙ্গে দিল আওয়ামীলীগ সন্ত্রাসী পুলিশ বাহিনী। ৫ আগস্ট ২০২৪ দুপুরে পরাজিত হওয়ার পরও এরকম ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটাবে কেউ কল্পনাও করেনি। সিরাজুল বেপারীকে পুলিশ রাত ১০:৩০ মিনিটে গুলি করে হত্যা করে। শাহাদাতের ঘটনা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের কারচুপির নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশ আসনে জিতে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করে। এরপর থেকে আর দলটি ক্ষমতা থেকে বের হতে চায়নি।একতরফা বা জালিয়াতির নির্বাচন, বিরোধীদের ও বিরুদ্ধ মত দমন, অনিয়ম আর দুর্নীতি, আমলা আর প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে দলটির টিকে থাকা, এই পতনের পেছনে মূল কয়েকটি কারণ হিসেবে উঠে আসছে। ১৫ বছরে বেশিরভাগ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ ধ্বংস করে দিয়েছিল। এসব প্রতিষ্ঠান সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তারা নিজেরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের যে ক্ষমতার ভিত্তি, তার কোনটাই টেকসই ছিল না। কারণ তারা জনগণ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ফলে মানুষের একটা ক্যাটালিস্ট বা স্ফুলিঙ্গের দরকার ছিল। সেটাই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দিয়ে শুরু হয়েছে। ফলে সরকার বিরোধী একটা আন্দোলন যখন জোরালো হয়ে ওঠে, সেই আন্দোলন ঘিরেও মানুষের ক্ষোভের জন্ম হয়, তখন সেনাবাহিনী, কারফিউ বা পুলিশের পরোয়া না করে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার হাজার হাজার মানুষ গণভবনের উদ্দেশ্যে পথে নেমে এসেছিলেন। ১৫ বছরের একটা পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, জিনিসপত্রের দাম, গণপরিবহনের অব্যবস্থাপনা, লুটপাট, ব্যাংকিংয়ের অনিয়ম সব কিছু নিয়ে ক্ষুব্ধ মানুষ কোটা আন্দোলনের একটা উপলক্ষ্য করে পরিবর্তনের আশায় বজ্রকন্ঠে হুংকার দিয়ে রাজপথে নেমে এসেছে। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার পর আওয়ামীলীগ যে বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়েছিল, প্রায় ৫০ বছরের মাথায় দলটি আবার সেই একই অবস্থায় পড়েছে।কিন্তু পুরো পরিস্থিতি কীভাবে এবং কেন এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছালো, যাতে বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ দলটির বিরুদ্ধে এভাবে রাজপথে নেমে আসলো? কেন ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে থাকা শেখ হাসিনাকে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে হলো? শেখ হাসিনা পালিয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু কয়েক হাজার মায়ের বুক খালি করে পালাল। অনেক শিশুকে এতিম করল এবং অনেক মা-বোনকে বিধবা করল। ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পালানোর পরেও তার নির্দেশে তার পোষা কিছু সন্ত্রাসী পুলিশ বাহিনী সিরাজুল বেপারীর মত কয়েকশো মানুষকে হত্যা করল। এতেই বোঝা যায় স্বৈরাচার শেখ হাসিনা কত বড় সন্ত্রাসী মনোভাব নিয়ে বাংলাদেশ শাসন করেছে। সেদিন রাতের ঘটনা প্রতিদিনের মতো সিরাজুল ইসলাম তার ঢাকার বাড্ডায় মোটর ওয়ার্কশপে কাজ করে ঘরে ফিরবেন। রাত ৮:৩০ মিনিটে গ্রাম থেকে তার বাবা ফোন দিয়ে খোঁজখবর নিলেন। বাবা তুমি কি খাওয়া দাওয়া করেছ। সিরাজুল ইসলাম বলল না বাবা আমি খাওয়া-দাওয়া করিনি। আজকে গ্যারেজের কাজ শেষ করে বাসায় যাব, গিয়ে রান্না করে তারপরে খাব। আজ যেতে একটু দেরি হবে। বাবা বললেন দ্রুত বাসায় গিয়ে খেয়ে নিবে। বেশি রাত করলে শরীর খারাপ করবে। সিরাজুল ইসলাম বললেন ঠিক আছে বাবা আমি দ্রুত খেয়ে নেব। আমার জন্য দোয়া করো। বাবা বললেন তোমার স্ত্রীর সাথে কি কথা বলবে? সে আমার পাশেই আছে? সিরাজুল বলল এখন একটু ব্যস্ত আছি তাই পরে কথা বলব, এখন রেখে দাও। সিরাজুল বেপারী তার গ্যারেজের কাজ শেষ করে বাসার দিকে ফিরছিলেন। হঠাৎ মনে হল স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এতদিন অংশগ্রহণ করলাম, সহযোগিতা করলাম, কিন্তু আজ স্বৈরাচারীর পতন হলো অথচ আনন্দ করতে পারলাম না! তাই সে মনে করলো একটু আনন্দ মিছিলে ঘুরে আসি। রাত ১০:৩০ মিনিটের দিকে মধ্য বাড্ডায় হঠাৎ অচেনা পুলিশ সদস্যদের গুলি করতে দেখা যায়। তারা জনগণকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। লোকজন এদিকে ওদিকে ছুটাছুটি করে পালাচ্ছে। সিরাজুল বেপারীও পুলিশের গুলি থেকে বাঁচার জন্য ছুটতে শুরু করল। হঠাৎ পিছন দিক থেকে পরপর তিনটা বুলেট এসে তার শরীরে বিদ্ধ হয়। কয়েক পা এগিয়েই সিরাজুল বেপারী মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আনন্দ মিছিলে অংশগ্রহণকারী সাধারণ জনগণ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু এরই মাঝে কখন যে তার প্রাণ চলে গেছে তারা তা বুঝতেও পারেনি। মেডিকেলে পৌঁছানোর পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। রাত ১২:৩০ মিনিটে সিরাজুলের বড় ভাইয়ের ফোনে হঠাৎ কল আসে এবং বলে সিরাজুল বেপারীর গায়ে গুলি বিদ্ধ হয়েছে। আপনারা বাসা থেকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন। পরিবারের লোকজন এসে ঢাকা মেডিকেল কলেজে অনেকগুলো লাশের মধ্য থেকে সিরাজুল বেপারীকে সনাক্ত করে। পরের দিন সকালে নিজ এলাকায় তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং দাফন করা হয়। শহীদ সিরাজুল ইবেপারীর এক শিক্ষকের বক্তব্য প্রত্যেক আত্মাকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে।পৃথিবীর জীবন ক্ষণস্থায়ী আর মৃত্যু এক অনিবার্য বাস্তবতা। মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থা নিয়ে মতভেদ আছে, কিন্তু একদিন সবাইকে মরতে হবে-সে বিষয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কোন মতপার্থক্য নেই। ‘মৃত্যু পৃথিবীর মায়ামোহ ধন-দৌলত থেকে সবাইকে বিচ্ছিন্ন করে। ভাই-বোন, পিতা-মাতা কিংবা বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয়-স্বজনের সম্পর্কের মাঝে ফারাক তৈরি করে। প্রেম-ভালোবাসার বন্ধনকে ছিন্ন করে। এমনকি এক পর্যায়ে মৃত ব্যক্তিকে তাদের স্বজন কিংবা পরিচিত জনের হৃদয় থেকে ভুলিয়ে দেয়।কিন্তু মানুষকে চিরদিন বাঁচিয়ে রাখে একটি মৃত্যু। সেই মৃত্যু সৌভাগ্যের, সেই মৃত্যু শাহাদাতের। আমি মনে করি আমার প্রিয় ছাত্র সিরাজুল বেপারী শাহাদাত বরণ করেছেন এবং আল্লাহ তাকে পরকালে জান্নাত নসিব করবেন। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ, শহীদ সিরাজুল বেপারীই ছিল একমাত্র আয়ের উৎস। বাড়ির ভিটা ছাড়া আবাদি কোন জমি নেই। বৃদ্ধ পিতা নৌকা চালিয়ে সংসার চালাতেন, কিন্তু অসুস্থতার কারণে এখন আর নৌকা চালাতে পারেন না তাই অনেক কষ্টেই দিনযাপন করতে হচ্ছে। বড় ছেলে ঢাকায় ছোট চাকরি করে সামান্য কিছু সহযোগিতা মাঝে মাঝে করে থাকেন। শহীদ সিরাজুল বেপারীর বউ পিংকি খাতুন সিরাজুল বেপারীর শাহাদাতের পঞ্চম দিনে নিজ পিতার বাসায় চলে যান। এখন তার অবস্থাও করুণ। এক নজরে শহীদ মো: সিরাজুল বেপারী নাম : মো: সিরাজুল বেপারী জন্ম তারিখ : ০১-০১-১৯৯৫ জন্মস্থান : তাইজউদ্দিন মুন্সীডাঙ্গা, কোতোয়ালী, ফরিদপুর পেশা : মোটর মেকানিক বর্তমান ঠিকানা : গ্রাম: তাইজউদ্দিন মুন্সীডাঙ্গা, ইউনিয়ন: ডিগ্রীর চর, থানা: কোতোয়ালী, জেলা: ফরিদপুর স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: তাইজউদ্দিন মুন্সীডাঙ্গা, ইউনিয়ন: ডিগ্রীর চর, থানা: কোতোয়ালী, জেলা: ফরিদপুর পরিবার পিতার নাম : শফিকুল বেপারী (৬৮) কৃষিকাজ মাতার নাম : মোছা: শিরীন আক্তার (৪৮) গৃহিণী স্ত্রী : পিংকি খাতুন আঘাতকারীর : পুলিশ আহত হওয়ায় ও স্থান সময় : মধ্য বাড্ডা, ঢাকা। ০৫-৮-২০২৪ রাত ১০:৩০ মৃত্যুর তারিখ ও সময়, স্থান : মধ্য বাড্ডা ঢাকা। ০৫-০৮-২০২৪ : রাত ১০:৩০ ঢাকা মেডিকেল কলেজ কবরস্থান : ০৬-০৮-২০২৪ নিজ গ্রাম সরকারি কবরস্থান প্রস্তাবনা : শহীদ পরিবারকে এককালীন আর্থিক অনুদান প্রদান : পাকা বাড়ি নির্মাণ করে দেয়া