জন্ম তারিখ: ২৮ অক্টোবর, ১৯৯৯
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১২ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা : শিক্ষকতা, মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসা, নগরকান্দা,ঢাকা, শাহাদাতের স্থান : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
পৃথিবীর বুকে সবাই সমানভাবে জন্ম নেয় না। কেউ সুখের ভিতরে কেউ দুঃখের ভিতরে জন্ম নেয়। পিতা মাতার আদর যত্নে অনেকে বেড়ে ওঠে আবার কেউ বেড়ে ওঠে দুঃখ কষ্টের মধ্যে। শহীদ মো: মঈনুল ইসলাম এরকমই একজন ছেলে ছিলেন। তিনি ছোটকাল থেকেই অনেক কষ্ট করে বেড়ে উঠেছিলেন। ১৯৯৯ সালের ২৮ অক্টোবর স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার প্রিয় এলাকা গোপালগঞ্জের কেকনিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শহীদ মো: মঈনুল ইসলাম। পিতা মো: কামরুল ইসলাম এবং মাতা মোছা: মাহফুজা বেগম। পিতা মাতার অনেক আদরের সন্তান ছিলেন শহীদ মইনুল ইসলাম। ইসলামিক বিষয়ে পড়াশোনা করানোর মাধ্যমে ছেলেকে আখেরাতে মুক্তির জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। শহীদ মইনুল ইসলাম বিয়ে করেছিলেন কিন্তু ঘর সংসার করা খুব বেশি দিন সম্ভব হয়নি। পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যা ছিল শহীদ মইনুল ইসলামের। মঈনুল ইসলামের দুই ভাই মোস্তাফিজুর রহমান এবং মাহমুদুর রহমান হেফজখানায় লেখাপড়া করেন। পিতা মো: কামরুল ইসলাম মসজিদে মুয়াজ্জিনের চাকরি করে সংসার চালান। গত পাঁচ বছর থেকে শহীদ মঈনুল ইসলাম ঢাকায় অবস্থান করছেন। শহীদ মইনুল ইসলাম মৃত্যু কালীন অবস্থায় একটি কওমী মাদ্রাসায় অল্প কিছু বেতনে চাকরি করতেন। চাকরির পাশাপাশি তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসার শিক্ষক এবং ছাত্রদের সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেখান থেকেই ইসলাম এবং ইসলামী আন্দোলনের মূল বিষয়গুলো তিনি অনুধাবন করতে পারেন। অবশেষে জালিম সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি তার জীবন উৎসর্গ করলেন। সবাই দুনিয়াতে থাকলো কিন্তু সন্ত্রাসী পুলিশের গুলিতে তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হল। অনেকেই হয়তো ভাবছে ছেলেটা অনেক কষ্ট করেছিল কষ্টের মধ্যেই মরতে হল, কিন্তু না, শাহাদাতের মৃত্যু কষ্টের না, শাহাদাতের মৃত্যু সৌভাগ্যের। শাহাদাতের ঘটনা ইতিহাসের রেখা রক্ত ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে লেখা যায় না। বিজয় শুধু মাথার খুলি দিয়ে তার দালান তৈরি করে। গৌরব এবং সম্মান শুধুমাত্র আহত এবং মৃতদের ভিত্তির উপর উঠতে পারে। সাম্রাজ্য, অভিজাত মানুষ, রাষ্ট্র এবং সমাজ এই উদাহরণ দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। যারা মনে করে যে তারা রক্ত, ত্যাগ, আহত মানুষ, বিশুদ্ধ ও নিষ্পাপ প্রাণ ছাড়াই সত্যকে পরিবর্তন করতে পারে বা সমাজকে পরিবর্তন করতে পারে, তারা এই ইসলাম ধর্মের মর্ম বোঝে না এবং নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর শিক্ষাও জানে না। "তোমরা কি মনে করো যে, আল্লাহ তোমাদের মধ্যে যারা সংগ্রাম করে এবং ধৈর্যশীল তাদের চিহ্নিত না করেই তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে?" (সূরা আল-ইমরান, আয়াত ১৪২) এই কারণে, জাতির প্রতিষ্ঠাতা এবং বিজয়ের স্থপতি কম। যে ব্যক্তি বিজয়ের স্থপতি হতে চায়, এই ব্যক্তিকে তার রক্ত ও ঘামের সাগর দিয়ে আত্মত্যাগ করতে হবে যতক্ষণ না সে তার মূল্যে বিজয় অর্জন করে। তাকে অবশ্যই তার চারপাশের লোকদের রক্ত এবং তার দায়িত্বের অধীনে থাকা বাধাগুলো উৎসর্গ করতে হবে। আর এই পথ অতিক্রম না করলে বিজয় অর্জিত হতে পারে না। শহীদ মাঈনুল ধর্মের সেই মর্ম বুঝেছিলেন এবং নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষাও জেনেছিলেন। তাই তিনি সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে এবং মিথ্যাকে ধ্বংস করতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি সকল সময় শাহাদাতের মৃত্যু কামনা করতেন। অবশেষে শহীদ মঈনুল ইসলামের স্বপ্ন পূরণ হলো। কিন্তু সেটা যুদ্ধের ময়দানে নয় সেটা বিজয়ের ময়দানে। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পোষা সন্ত্রাসী পুলিশ বাহিনী শহীদ মঈনুল ইসলামকে বিজয় উল্লাস করতে দিল না। মঈনুল ইসলামের কোন সমস্যা নেই কারণ তিনি বিজয় উল্লাস করবেন জান্নাতের মধ্যে ইনশাল্লাহ। যেদিন হত্যাকারীরা চিৎকার করে বলবে, হায় আমরা যদি আবার দুনিয়াতে যেতে পারতাম এবং তাহলে আমরা অবশ্যই ভালো ভালো কাজ করতাম এবং আল্লাহর জন্য শহীদ হতাম! কিন্তু তাদের এই সুযোগ কখনো দেওয়া হবে না। মূল ঘটনা শহীদ মঈনুল ইসলাম জেনেছে স্বৈরাচার সরকারের পতন হয়েছে তারপরেও আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের প্রকাশ্যে গুলি চালানোর সাহস কিভাবে হয়! সে ভেবেছিল হয়তো সন্ত্রাসীরা আর গুলি চালাতে পারবে না ।কিন্তু কে জানে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসী পুলিশ শহীদ মঈনুল ইসলামসহ সাধারণ ছাত্র-জনতার উপর এভাবেগুলি করবে! আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসী পুলিশ বাহিনীর উপরের চেহারা দেখে তো আর বোঝার উপায় নেই যে তারা মানুষ নয় তারা হিংস্র জানোয়ারের চাইতেও বেশি কিছু। শেখ হাসিনা এমনভাবে এদেরকে তৈরি করেছে যেন বিন্দু পরিমাণ এদের অন্তরে মায়া মহব্বত নেই।শহীদ মঈনুল ইসলামের সমস্ত ভাবনাকে দূর করে দিয়ে তার দিকে ধেয়ে আসে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের পোষা পুলিশ বাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া বুলেট। সাথে সাথে অশান্তিতে ভরা, নৈরাজ্যপূর্ণ এই পৃথিবীর মায়া মহব্বত ত্যাগ কর শান্তিময় জান্নাতের দিকে চলে যান শহীদ মঈনুল। ৫ আগস্ট ২০২৪ দীর্ঘ দিনের আন্দোলনের পর স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পদত্যাগ করল। দেশ থেকে স্বৈরাচার শাসকের বিদায় হল। দেশের সকল জনগণ আজ নতুন করে স্বাধীনতা অর্জন করল। স্বাধীনতার এই দিনে সবাই মুক্ত আকাশের নিচে বিজয় উল্লাস করতে বের হয়েছে। শহীদ মঈনুল ইসলামও যোহরের নামাজের পর তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার রোডে বিজয় উল্লাস এর জন্য বের হলেন। সকাল থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন তিনি। দুপুরে বাড়ি থেকে আবার তিনি বিজয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে রাস্তায় নেমে আসলেন। বিভিন্ন জায়গায় স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দোসর ও পুলিশ বাহিনী গুলি চালাচ্ছিলো তখনো। এমনকি এই গণহত্যায় জড়িত সন্ত্রাসী পুলিশ বাহিনী হেলিকপ্টার থেকে সাধারণ ছাত্র-জনতার ওপরে নির্বিচারে গুলি চালাতে লাগল। সাধারণ মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা এদিকে ওদিকে পালাতে লাগল। অনেকেই বুঝে ওঠার আগেই পুলিশের গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে লাগলো। রাস্তা রক্তে লাল হয়ে গেল। এরই মাঝে দুপুর ২:৪০ টার দিকে হঠাৎ মইনুল ইসলামের বুকে গুলি লেগে পেছন দিক থেকে বেরিয়ে যায়। এটি সাধারণ কোনো গুলি নয়। এটি ছিল সন্ত্রাসী পুলিশ বাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে স্পেশাল রাইফেল দিয়ে ছোড়া গুলি। মঈনুল ইসলামকে সাধারণ জনতা ধরাধরি করে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়।ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে দীর্ঘ ৭ দিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে অবশেষে হেরে যান। চলে যান এই দুঃখ কষ্ট আর যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবী ছেড়ে সুন্দর শান্তিময় এক জগতে। শহীদের পিতার বক্তব্য মৃত্যু সকলের জন্য অবধারিত কেউ স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করে আবার কেউ অস্বাভাকি মৃত্যুবরণ করে। আর কিছু মৃত্যু হয় স্মরণীয় মৃত্যু। আর আমার মঈনুল সবসময় সে স্মরণীয় মৃত্যুই কামনা করত। তার মৃত্যুতে আমি মোটেও দুঃখিত না বরং শহীদের পিতা হতে পেরে আমি গর্বিত। তবে যারা আমার সন্তানকে অন্যায় ভাবে হত্যা করল তাদের সকলের ফাঁসি হোক সেটাই চাই। গণহত্যাকারী শেখ হাসিনার যেন বাংলাদেশের আদালতে রায়ের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। সেজন্য আমি নতুন সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি। শহীদের পারিবারিক অবস্থা শহীদের পরিবারে অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই করুণ। স্থায়ী তেমন কোন সম্পত্তি নেই। পিতার মোয়াজ্জেমি করে যা আয় হয় তাতে কোনরকম সংসার চলে। দুই ভাই এখনো লেখাপড়া করেন। শহীদ মঈনুলকে হারিয়ে মা পাগলের মত হয়ে গেছেন। শহীদ মঈনুল এর স্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে নিজ পিতা-মাতার বাড়িতে অবস্থান করেন। একনজরে শহীদ মো: মঈনুল ইসলাম নাম : মো: মঈনুল ইসলাম জন্ম তারিখ : ২৮-১০-১৯৯৯ জন্মস্থান : কেকনিয়া, গোপালগঞ্জ সদর, গোপালগঞ্জ পেশা : শিক্ষকতা, মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসা, নগরকান্দা,ঢাকা বর্তমান ঠিকানা : কেকনিয়া, গোপালগঞ্জ সদর, গোপালগঞ্জ স্থায়ী ঠিকানা : কেকনিয়া, গোপালগঞ্জ সদর, গোপালগঞ্জ পরিবার পিতার নাম : মো: কামরুল ইসলাম (৫৫) মসজিদের মুয়াজ্জিন মাতার নাম : মাহফুজা বেগম (৪০) গৃহিণী বৈবাহিক অবস্থা : বিবাহিত ভাই ১. মোস্তাফিজুর রহমান (২২) ২. মাহামুদুর রহমান (২০) আঘাতকারীর : সন্ত্রসী পুলিশ আহত হওয়ায় ও স্থান সময় : ঢাকা তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা, ০৫-০৮-২০২৪ বিকেল ২:৪০টা মৃত্যুর তারিখ ও সময়, স্থান : ১২-০৮-২০২৪, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাত ৯.০০টা জানাজা : ১৩-০৮-২০২৪, সকাল ১১:০০টা কবরস্থান : গোপালগঞ্জ সদর প্রস্তাবনা ১. নিয়মিত মাসিক আর্থিক সহায়তা প্রদান ২. ব্যবসায়িক কাজে মূলধন সহায়তা প্রদান