জন্ম তারিখ: ১৪ জুলাই, ২০০৭
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা : নির্মাণ শ্রমিক, শাহাদাতের স্থান : সার্বিক ফিলিং স্টেশন, খাগদি, মাদারীপুর
তাওহিদ সন্যামাত, জন্ম ১৪ জুলাই, ২০০৭। তিনি মাদারীপুর জেলার সুচিয়াডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের শুরু থেকেই দারিদ্র্যের কঠিন বাস্তবতা তাঁকে পরিবেষ্টিত করে। পিতার নাম মো: সালাহ উদ্দিন সন্যামাত, যিনি পেশায় একজন দিনমজুর এবং বয়স ৬০ বছর। এই পরিবারের জন্য প্রতিদিনের সংগ্রামই ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। গ্রামের পরিবেশে তাওহিদ বেড়ে উঠেছেন। সবার সঙ্গে তাঁর সখ্যতা ছিল অতুলনীয়। মিশুক প্রকৃতির কারণে তিনি খুব সহজে সকলের মন জয় করতেন। শৈশবের খেলার সঙ্গী থেকে শুরু করে, অভিজ্ঞদের কাছে শেখার মাধ্যমে জীবন সংগ্রামের পাঠ নেন। অল্প বয়সেই পরিবারের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিতে তাঁকে বাধ্য করেছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দারিদ্র। নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করে তাওহিদ প্রতিদিন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতেন। কিন্তু কখনোই তাঁর মুখে হতাশার ছায়া পড়তে দেননি। এভাবে তিনি জীবনকে নতুন করে উপলব্ধি করেছেন, যেখানে পরিশ্রমের মূল্যই সত্যিকারের সুখের চাবিকাঠি। তাওহিদের জীবন গল্পে ফুটে ওঠে এক আদর্শ যুবকের চিত্র, যে কষ্টের মাঝে বাঁচার অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে চলে। শহীদ পরিবারের দারিদ্রতার ছাপ তাওহিদ সন্যামাতের জীবন যেন এক করুণ কাহিনীর প্রতিচ্ছবি। পাঁচ সদস্যের পরিবার, যার তিন ভাইয়ের মধ্যে তাওহিদ মধ্যম। তাদের ঘর, টিনের চালা দিয়ে তৈরি, মাত্র দুই রুমের এক ক্ষুদ্র আশ্রয়স্থল। পরিবারটি এই ঘরের ভিটা ছাড়া আর কোনো জমির মালিক নয়, যেন শূন্যে ভাসমান এক সংগ্রামী জীবন। তাওহিদের বাবা ছাড়া পরিবারের আর কেউ উপার্জনক্ষম নয়। বাবার কাঁধেই ভর করে পুরো সংসারের হাল ধরে রাখার চেষ্টা। তাওহিদ নিজেও নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে যে কষ্টার্জিত অর্থ উপার্জন করতেন, তা দিয়ে কোনো রকমে দিন চলে। দারিদ্র্যের শেকলে বাঁধা এই পরিবার প্রতিদিন বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত, দিন এনে দিন খাওয়া ছাড়া অন্য কোনো স্বপ্ন তাদের ধরা দেয় না। মানবেতর এই জীবনের ছাপ যেন তাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসে ধরা পড়ে। এই পরিবারটি বেঁচে থাকে শুধুমাত্র আগামী দিনের আশায়। কিন্তু তাদের জীবন যেন বৃষ্টিহীন মরুভূমিতে জলস্রোতের অপেক্ষা। তৌহিদের পরিবার দারিদ্র্যের অন্ধকারে ডুবে থাকলেও, তাদের ভেতরে বেঁচে থাকার এক অনির্বাণ ইচ্ছা জ্বলে, যা তাদের প্রতিদিনের কষ্টের মধ্যেও একটি ক্ষীণ আলোর উৎস হয়ে আছে। ঘটনার প্রেক্ষাপট ১৮ জুলাই ২০২৪ সালে, আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলার প্রতিবাদে সারা দেশের মতো মাদারীপুরেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল। ন্যায়ের দাবিতে উদ্দীপ্ত ছাত্ররা রাস্তায় নেমে এসেছিল। তাদের কণ্ঠে ছিল অধিকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান। ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে এলাকাবাসীও মন থেকে তাদের সমর্থন জানায়। কিন্তু সেই দিনে কিছু অশান্তি ও বর্বর আক্রমণ ঘটেছিল। যার ফলে দীপ্ত দে নামের এক ছাত্র জীবন হারায় এবং অনেকে আহত হন। এই মর্মান্তিক ঘটনার পর মাদারীপুরের জনগণের মনে ক্ষোভ ও হতাশার সঞ্চার হয়। পরদিন ১৯ জুলাই, পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়, যখন ছাত্র-জনতা একত্রিত হয়ে পুনরায় আন্দোলনে নামে স্বৈরাচার হাসিনার বাকশালের বিরুদ্ধে। তারা চেয়েছিল ন্যায়বিচার এবং শোষণের অবসান। কিন্তু এই সংগ্রামে তারা বাধার সম্মুখীন হয়। যদিও তারা নিরস্ত্র ছিল, তবুও প্রতিরোধের চেষ্টায় তাদের সাহস হারায়নি। তারা শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য পথে নামে। তাওহিদ সন্যামাত, একজন সাধারণ নির্মাণ শ্রমিক, ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। তার বন্ধুরা এই আন্দোলনের অংশ ছিল এবং তাদের ওপর আক্রমণের খবর তাওহিদকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। বিকাল ৩ টার দিকে, তাওহিদ সিদ্ধান্ত নেন যে, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। কাউকে কিছু না বলে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন আন্দোলনের মিছিলে যোগ দেওয়ার জন্য। আনুমানিক বিকাল ৫ টার দিকে, মাদারীপুর শহরের উপকণ্ঠে খাগদি নামক স্থানে আন্দোলনের সময়, তাওহিদ গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং সেখানেই শহীদ হন। তাওহিদের এই আত্মত্যাগ আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে নতুন প্রেরণার জন্ম দেয়। তাওহিদের মৃত্যু ছাত্র-জনতাকে একত্রিত করে আরও দৃঢ়ভাবে। তার প্রতি সম্মান জানিয়ে আন্দোলনকারীরা একসঙ্গে দাঁড়িয়ে মাদারীপুরকে আওয়ামী সন্ত্রাসমুক্ত শান্তির পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তাওহিদ সন্যামাত ছিলেন এক সাধারণ ব্যক্তি, যার হৃদয়ে ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার দৃঢ় সংকল্প। তার আত্মত্যাগ মানুষকে এক নতুন শক্তি দেয় এবং তাকে স্মরণীয় করে রাখে ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে। শহীদ সম্পর্কে অনুভুতি তাওহিদ ছিলো এক অমায়িক, স্নেহময় সন্তান, যে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্য ছিলো নিবেদিত প্রাণ। বড় ভাইয়ের কণ্ঠে ঝরে পড়ে তার আত্মত্যাগের করুণ গল্প, "তৌহিদ ছিলো সত্যিই এক অসাধারণ ছেলে। সে নিয়মিত নামাজ পড়তো, ধর্মীয় দায়িত্বগুলো নিষ্ঠার সাথে পালন করতো। যখন দেখলো পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ভঙ্গুর, তখন নিজের স্বপ্নকে থামিয়ে দিয়ে আমার পড়াশোনার খরচ চালাতে এবং বাবাকে সহযোগিতা করতে পড়াশোনা ছেড়ে দিলো। বাবার পাশে দাঁড়িয়ে শ্রমিকের কাজে যোগ দিলো, যেন সংসারের চাকা সচল থাকে।" মায়ের হৃদয়ে জমে থাকা কথা যেন অশ্রুবিন্দুর মতো গড়িয়ে পড়ে, "আমার ছেলে আমাকে বলতো, 'মা, তোমার আর কোনো চিন্তা নেই। আমি বিদেশে যাবো, ঘর বানাবো, তোমাদের সব কষ্ট দূর করবো। দুই ভাইয়ের দায়িত্ব আমি নেবো, বাবাকে আর কষ্ট করতে দেবো না।'" তাওহিদের প্রতিটি কথা যেন প্রতিশ্রুতির বাতিঘর হয়ে ঝলমল করছিলো, যে প্রতিশ্রুতির আলোয় তার মা-বাবার মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলো। তাওহিদ ছিলো পরিবারের জন্য আলোকবর্তিকা, যার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিলো ভালোবাসা, দায়িত্ব, আর আত্মত্যাগের এক নিঃস্বার্থ প্রদীপ। কিন্তু সেই প্রদীপ নিভে গেলো, রেখে গেলো তার স্বপ্ন আর প্রতিশ্রুতির অপূর্ণতা, আর পরিবারের বুকের গভীরে এক শূন্যতার কালো মেঘ। প্রস্তাবনা বাসস্থান প্রয়োজন। বাবা অথবা বড় ভাইয়ের জন্য কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করে দিলে উপকার হবে। ছোট ভাইয়ের লেখা-পড়ার খরচ যোগাতে সহযোগিতা করা যেতে পারে। এক নজরে শহীদের ব্যক্তিগত তথ্য পুরো নাম : তাওহিদ সন্যামাত জন্মসাল : ১৪/০৭/২০০৭ পেশা : নির্মাণ শ্রমিক স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা : গ্রাম: সুচিয়াডাঙ্গা, ইউনিয়ন: মোস্তফাপুর, থানা: মাদারীপুর, জেলা: মাদারীপুর পিতার নাম : মো: সালাহ উদ্দিন সন্যামাত, পেশা: দিনমজুর, বয়স: ৬০ বছর ঘটনার স্থান : সার্বিক ফিলিং স্টেশন, খাগদি, মাদারীপুর আক্রমণকারী : সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ আহত হওয়ার সময়কাল : তারিখ-১৯ জুলাই বিকাল : ৪:০০টায় নিহত হওয়ার সময়কাল : তারিখ- ১৯ জুলাই, ২০২৪ সময়: ৬:০০ সন্ধ্যা কবরস্থান : পারিবারিক কবরস্থান