জন্ম তারিখ: ২ জানুয়ারি, ১৯৯১
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা : ফুটপাতের হকার, শাহাদাতের স্থান : সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ছোবহান মুন্সি ২ জানুয়ারি ১৯৯১ সালে মাদারীপুর জেলার রাজৈর থানার বাসুদেবপুর গ্রামে একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আয়ুব আলী মুন্সি। যার বর্তমান বয়স ৬০ বছর, এবং মাতার নাম মোছা: রুববান, বয়স ৫২ বছর। ছোবহানের পরিবার সবসময়ই অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে দিন কাটাতো। দারির্দ্যতার কারণে ছোবহান ছোটবেলা থেকেই নানা সংকটের মুখোমুখি হন, যার ফলে তিনি স্কুলে যাওয়া এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। ছোট বয়সেই সংসারের হাল ধরতে হয় সোবহানকে। ঢাকায় পাড়ি জমিয়ে ফুটপাতে হকারির কাজ শুরু করেন, যার মাধ্যমে অন্ন, বস্ত্র এবং পরিবারের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করতেন। মাসিক আয় ছিল মাত্র ১৫,০০০ টাকা, যা দিয়ে কোনো রকমে পরিবারের ভরণ-পোষণ চালাতেন। তার এই আয়ে নির্ভর করত তার মা-বাবা ও সন্তানরা। সোবহান ছিলেন সৎ এবং পরিশ্রমী একজন মানুষ। জীবনের প্রতিটি ধাপে তিনি হালাল উপার্জন করে সংসার চালানোর চেষ্টা করতেন। ছোবহান তার ছোটবেলা থেকেই দারিদ্রের সাথে লড়াই করে বড় হয়েছেন। তিনি কখনও সুযোগ পাননি স্কুলে পড়ার, তবে নিজের সন্তানদের জন্য তিনি স্বপ্ন দেখতেন ভালো ভবিষ্যতের। ঢাকায় হকারির কাজ করে সন্তানদের পড়াশোনার খরচ মেটাতেন এবং পরিবারের সুখ-শান্তির জন্য নিরলস পরিশ্রম করতেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকায় আন্দোলনের সময়, ছোবহান মুন্সি পুলিশের গুলিতে নিহত হন। তার এই আত্মত্যাগ ছিল দেশের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামের একটি অংশ। তার মৃত্যুতে তার পরিবার চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে এবং তাদের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে ওঠে। ছোবহান মুন্সির মতো একজন পরিশ্রমী এবং সৎ মানুষের মৃত্যুতে সমাজ এক নিষ্ঠাবান কর্মীকে হারিয়েছে। শহীদের অর্থনৈতিক অবস্থা শহীদ ছোবহান মুন্সির জীবন ছিল সংগ্রামমুখর এবং দুঃখ-বেদনায় পরিপূর্ণ। তিনি একজন দিনমজুর হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতেন, এবং তার উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম ছিল ঢাকার ফুটপাথে হকারি করা। প্রতিদিনকার পরিশ্রমের মাধ্যমে যে সামান্য আয় করতেন, তা দিয়েই তিনি তার পরিবারের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতেন। সুবহানের জীবনের প্রতিটি দিনই ছিল কঠিন সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি, যেখানে তার আয়েই নির্ভর করত পুরো পরিবারের ভাগ্য। ছোবহানের সংসারে তিনটি ফুটফুটে রয়েছে, যারা সবাই পড়াশোনা করছে। তাদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য ছোবহান কঠোর পরিশ্রম করতেন। তিনি তার কষ্টার্জিত টাকায় মেয়েদের স্কুলে পাঠাতেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষাই তাদের জীবনের পরিবর্তন আনবে। কিন্তু তার এই আকাঙ্ক্ষা মাঝপথে থেমে গেল, যখন ৫ আগস্ট ২০২৪ সালের আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে তার মৃত্যু হয়। ছোবহানের মৃত্যুতে পুরো পরিবারটি যেন অন্ধকারে তলিয়ে গেছে। তার মা-বাবাও ছিল তাকে কেন্দ্র করে, কারণ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন ছোবহান। তিনি যেভাবে পরিবারের দেখাশোনা করতেন, তার উপর নির্ভর করেই মা-বাবা বাকি জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু সেই স্বপ্নগুলো এখন শুধুই ভগ্নাংশ, কারণ ছোবহানের মৃত্যুতে ইনকামের একমাত্র চাকা থেমে গেছে। পরিবারটি এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে, তাদের কোনো আয়ের উৎস নেই। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা এখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। স্কুলের ফি, বইপত্র, এবং অন্যান্য খরচ মেটানোর আর কোনো উপায় নেই। ছোবহান তার মেয়েদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের যে স্বপ্ন দেখতেন, তা এখন ধূলিসাৎ হওয়ার পথে। তাদেরকে হয়তো পড়াশোনা ছাড়তে হবে এবং অল্প বয়সেই কর্মজীবনে নামতে হবে পরিবারের খরচ মেটানোর জন্য। ছোবহানের মৃত্যুর পর তার পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। কোনো সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য ছাড়াই তারা বর্তমানে দারিদ্রের সাথে লড়াই করছে। প্রতিদিনের খাবার জোগাড় করতেও তারা হিমশিম খাচ্ছে। ঋণের বোঝা বাড়ছে, আর জীবনযাপন হয়ে উঠেছে অসহনীয়। এই অসহায় পরিবারটি এখন সমাজের করুণ চিত্র, যারা দেশের জন্য একজন শহীদকে হারিয়ে নিজেরাই হারিয়ে যাচ্ছে দারিদ্রের অতলে। শাহাদাতের বর্ণনা ৫ আগস্ট ২০২৪ সাল, একটি দিন যা বাংলাদেশের ইতিহাসে রক্তক্ষয়ী দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। দেশব্যাপী চলমান ছাত্র-জনতার আন্দোলন, ন্যায়ের শাসন, ভোটাধিকার এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছিল। ফ্যাসিস্ট শাসন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে লাখো জনতা রাস্তায় নেমে এসেছিল। শেখ হাসিনার দীর্ঘকালীন স্বৈরাচারী শাসন, যেখানে ন্যায় শাসন, জবাবদিহিতা এবং মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছিল, সেই অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনতার আন্দোলন ধীরে ধীরে গণজাগরণে পরিণত হয়। ছোবহান মুন্সি, একজন সাধারণ ছাত্র, তার মতো অসংখ্য তরুণের সাথে এই আন্দোলনে যোগদান করেন। ছোবহান একদিনের জন্যও পিছিয়ে থাকেননি; তিনি বিশ্বাস করতেন এই আন্দোলন শুধু তার নিজের জন্য নয়, দেশের সকল মানুষের স্বাধীনতা এবং অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর, জনতা বিজয়ের আনন্দে উল্লসিত হয়ে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিজয় মিছিল বের করে। সুবহান মুন্সি সেই মিছিলের সামনের সারিতে ছিলেন। মিছিলটি যখন বংশাল থানার কাছে আসে, তখন পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শেখ হাসিনা সরকারের কিছু অতি উৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তা মিছিলটিকে ভয় দেখাতে শুরু করে। হঠাৎই গুলির আওয়াজ শোনা যায়, এবং সেখানেই ঘটে যায় মর্মান্তিক ঘটনা। পুলিশ বাহিনী জনতার উপর বেপরোয়া গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। প্রথমে একটি গুলি এসে সুবহানের পায়ে লাগে, কিন্তু তাতেও তিনি থামেননি; তিনি আরও দৃঢ়তার সাথে সামনে এগিয়ে যেতে থাকেন। তারপর হঠাৎ আরেকটি গুলি এসে তার বুকে লাগে। মুহূর্তের মধ্যে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। মিছিলের অন্যান্য অংশগ্রহণকারীরা তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। হাসপাতালে নিয়ে গেলে, চিকিৎসকরা তার অবস্থা সংকটাপন্ন ঘোষণা করেন। অবশেষে, চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকেল ৬:১৫ টায় সুবহান মুন্সি মৃত্যুবরণ করেন। তার এই আত্মত্যাগ কেবল তার নিজের পরিবারের জন্য নয়, গোটা দেশের জন্য এক বিরাট ক্ষতি। তিনি হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে নিজের জীবন দিয়ে প্রতিবাদ জানালেন।সুবহানের মতো হাজারো তরুণ-তরুণী শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে ভয়াবহ দুর্নীতি, অন্যায় এবং অধিকার হরণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। তাদের একমাত্র চাওয়া ছিল একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন, ন্যায়বিচার এবং জনতার ক্ষমতায়নের মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা। কিন্তু সেই দাবিগুলো দমন করতে পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায়, জীবন কেড়ে নেয় অসংখ্য নিরীহ মানুষের, ঠিক যেমনটি ঘটেছিল সুবহান মুন্সির সাথে। তার সাহসিকতা এবং আত্মত্যাগ সবসময়ই দেশের তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে যাবে। দেশে ভোটাধিকার, ন্যায় শাসন, এবং জবাবদিহিতার দাবিতে তার এই অমর সাহসিকতা যেন নতুন করে জাগ্রত করে দেশের জন্য আত্মত্যাগের শক্তি। শহীদ সম্পর্কে অনুভুতি শহীদ ছোবহান মুন্সি সম্পর্কে তার প্রতিবেশীরা বলেন, তিনি ছিলেন একজন সৎ ও পরিশ্রমী মানুষ। হালাল উপার্জন করেই নিজের এবং পরিবারের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতেন। তার জীবনে অসততার কোনো জায়গা ছিল না। এলাকায় কেউ বিপদে পড়লে সোবহানই প্রথমে এগিয়ে যেতেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। সবাই তাকে ভালোবাসত এবং তার সাহায্যপ্রবণ স্বভাবের জন্য তিনি এলাকায় খুবই শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। এখন তার মৃত্যুর পর, সবাই তাকে গভীরভাবে স্মরণ করছে এবং তার অভাব অনুভব করছে। এক নজরে নাম : ছোবহান মুন্সি জন্মসাল : ০২/০১/১৯৯১ পেশা : ফুটপাতের হকার স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা : গ্রাম: বাসুদেবপুর, ইউনিয়ন: পাইকপাড়াপ, থানা: রাজৈর, জেলা: মাদারীপুর পিতার নাম : আয়ুব আলী মুন্সী, বয়স: ৬০ বছর মাতার নাম : মোছা: রুববান, বয়স: ৫২ বছর মাসিক আয় : ১৫০০০/- আয়ের উৎস : হকারী পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ৪ জন ছেলে-মেয়ে : ১ ছেলে ২ মেয়ে : ১. ছেলে: সায়েম মুন্সি, বয়স: ১০ বছর, শিক্ষার্থী: বাসীদাতপুর প্রাইমারি স্কুল : ২. মেয়ে: মারিয়া, বয়স: ৭ বছর, নুরানি মাদরাসা : ৩. মেয়ে: সায়মা, বয়স: ৩ বছর ঘটনার স্থান : বংশাল আক্রমণকারী : ঘাতক পুলিশ আহত হওয়ার সময়কাল : তারিখ: ০৫ আগস্ট ২০২৪, বিকাল : ৪:০০টায় নিহত হওয়ার সময়কাল : তারিখ: ০৫ আগস্ট ২০২৪, সন্ধ্যা: ৬:০০টায় স্থান : সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কবরস্থান : পারিবারিক কবরস্থান প্রস্তাবনা ১. স্থায়ী বসবাসের জন্য জায়গা। ২. সন্তানদের পড়া-লেখার ব্যবস্থা করে দেওয়া। ৩. স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়া।