জন্ম তারিখ: ৮ অক্টোবর, ১৯৯৫
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা : টেকনিশিয়ান, শাহাদাতের স্থান : মুগদা মেডিকেল হাসপাতাল
আল আমিন, ১৯৯৫ সালে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার শৈশব ছিল কষ্টের, কিন্তু ভালোবাসা আর স্নেহের কোনো কমতি ছিল না। বাবা-মা তাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতেন। তাদের একমাত্র আলোর প্রদীপ ছিল আল আমিন। সেই পরিবারটি প্রতিদিনকার জীবন সংগ্রামে লিপ্ত ছিল, দিন এনে দিন খায়, ক্ষুধার তাড়নায় প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে। তবুও আল আমিনের শৈশব কাটে শান্তিতে, বাবা-মায়ের স্নেহময় আশ্রয়ে। শহরের ইট-পাথরের বুকে বেড়ে ওঠা আল আমিন যেন তার চারপাশের কোলাহল, ধূলাবালি, আর নির্মম বাস্তবতাকে খুব কাছ থেকে অনুভব করেছিল। ঢাকার কঠিন বাস্তবতায়ও তার হৃদয় ছিল কোমল, ন্যায়ের প্রতি ছিল প্রবল টান। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সে বরাবরই ছিল সোচ্চার। বৈষম্যের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা তরুণদের দলে সে নিজেকে বিলিয়ে দিল, যেন সমাজের নিপীড়িতদের জন্য তার জীবন উৎসর্গ করাই ছিল তার শেষ লক্ষ্য। অবশেষে, একদিন সেই সংগ্রামের মিছিলে দাঁড়িয়ে আল আমিন হয়ে গেলেন শহীদ। বৈষম্যের শৃঙ্খল ভাঙার জন্য জীবন দিয়ে গেলেন, রেখে গেলেন এক শূন্যতা। তার মৃত্যুতে বাবা-মা পরিণত হলেন অসহায়, যেন তাদের সারা জীবনের সম্বল হারিয়ে গেছে। আল আমিনের স্মৃতি শুধু তার পরিবারের জন্য নয়, সমাজের নিপীড়িত মানুষের জন্যও এক অনুপ্রেরণা হয়ে রয়ে গেল। শহীদ সম্পর্কে অনুভতি শহীদ আল আমিন সম্পর্কে তার বড় ভাই বলেন, তিনি অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। কখনও কোনো দ্বন্দ্বে জড়াতে দেখা যায়নি তাকে। বরং তিনি সবসময় সবার সাথে মিলে-মিশে চলার চেষ্টা করতেন। এলাকার সবাই তাকে একজন ভালো মানুষ হিসেবেই জানতেন। পরিবারের আবদার পূরণের জন্য আল আমিন সবসময় সাধ্যমতো চেষ্টা করতেন। তার মধ্যে একটি মমতাময়, সহানুভূতিশীল স্বভাব ছিল, যা তাকে পরিবারের প্রিয় সদস্যে পরিণত করেছিল। তিনি পরিবার ও সমাজে সবার কাছে শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন, এবং তার অনুপস্থিতি পরিবার ও এলাকাবাসীর জন্য গভীর শোকের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শাহাদাতের বিবরণ শহীদ মো: আল আমিনের জীবন ও তার শাহাদাতের ঘটনা গভীর বেদনা ও ত্যাগের প্রতীক। ৫ আগস্ট, বিজয়ের দিন। বিকেলের আলো তখনও ফিকে হয়নি। আনুমানিক বিকাল ৩টার দিকে আল আমিন তার ছোট ভাইকে দোকান বন্ধ করার নির্দেশ দেন। দুজনেই তখন বিজয়ের আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে মিছিলে শামিল হওয়ার জন্য বাড্ডা মোড়ের দিকে পা বাড়ান। সেই মুহূর্তে তাদের মন ভরে ছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন আর ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায়। মোড়ের কাছাকাছি পৌঁছালে হঠাৎ করে মিছিলের মধ্যে এক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। লোকজন ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। পরিস্থিতির অবনতি দেখে আল আমিন তার বড় ভাইকে বললেন, "তুমি বাসায় যাও, আমি পরে আসছি।" যেন সবকিছু শান্ত হলে তিনি ফিরে আসবেন। কিন্তু কে জানতো এটাই হবে তাদের শেষ কথা! আল আমিন সামনে এগিয়ে মোড়ে পৌঁছালে হঠাৎ করে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত গুলি তার দেহে আঘাত হানে। স্থানীয়রা তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে থেকে তাকে মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। চিকিৎসকদের সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, কিছুক্ষণ পরই আল আমিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। একটি স্বপ্নময় জীবন অকালে থেমে যায়। এই ঘটনার পর আল আমিনের ছোট ভাই তাকে খুঁজতে বের হন। বাড্ডা পৌঁছে একে-অপরকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন, তার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে স্থানীয় হাসপাতালে আছেন। কিন্তু হাসপাতালের রেজিস্ট্রারের ভুলের কারণে তার ভাইয়ের কোনো খোঁজ তিনি পাননি। বিভিন্ন হাসপাতালে দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর, মুগদা মেডিকেল কলেজ আল আমিনের নিথর দেহের সন্ধান মেলে। শহীদ ছিলেন একজন প্রখর রাজনৈতিক সচেতন যুবক। বয়সে তরুণ হলেও তিনি স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামে সাহসিকতার সাথে অংশগ্রহণ করতেন। ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বাক স্বাধীনতার পক্ষে তিনি সবসময় সরব থাকতেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনসহ বিভিন্ন সামাজিক ন্যায়ের দাবিতে মাঠে থাকতেন তিনি। ন্যায়বিচারের স্বপ্নে বেঁচে থাকা এই তরুণ, যিনি মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সবসময় নিজের শক্তি ও সময় ব্যয় করতেন, তার এই অকাল প্রয়াণ যেন সেই স্বপ্নগুলোকে স্তব্ধ করে দিল। শহীদ আল আমিনের মৃত্যু কেবল তার পরিবারকেই শোকের সাগরে ভাসিয়ে দেয়নি, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরে গভীর শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। তার মতো সাহসী এবং সৎ মানুষের অনুপস্থিতি একটি জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। শহীদের অর্থনৈতিক অবস্থার বিবরণ শহীদ মো: আল আমিনের জনক দীর্ঘদিন সৌদি প্রবাসী ছিলেন। দুই বছর পূর্বে দেশে ফিরে এসেছেন। বর্তমানে পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস টেকনিক্যাল কাজ। যার আয়ে চলে পরিবারের দৈনন্দিন জীবনযাপন। আল আমিনের শহীদ হওয়ার পর পরিবারটি গভীর অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। তিনি পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন এবং তার সাহায্য ছাড়া পরিবারের সমস্ত চাহিদা পূরণ করা দুঃসাধ্য ছিল। শহীদের অভাব এখন শুধু পরিবারের জন্য মানসিক শোকই নয়, বরং অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহীদের প্রোফাইল নাম : মো: আল আমিন জন্ম : ০৮/১০/১৯৯৫ পেশা : টেকনিশিয়ান পিতা : ইসমাঈল মাতা : জেসমিন স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা : আফতাব নগর, সি-ব্লক, বাড্ডা, ১২১২ ঘটনার স্থান : বাড্ডা আক্রমণকারী : ঘাতক পুলিশ আহত হওয়ার সময়কাল : তারিখ: ৫ আগষ্ট ২০২৪ নিহত হওয়ার সময়কাল : তারিখ: ৫ আগষ্ট ২০২৪, মুগদা মেডিকেল হাসপাতাল কবরস্থান : বাড্ডা কবরস্থান পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ৪ জন ১) সুমি আক্তার, বয়স: ২৮, সম্পর্ক: স্ত্রী ২) সিয়াম, বয়স: ১৩ বছর, শ্রেণি: ৫ম, সম্পর্ক: ছেলে ৩) নূর, বয়স: ০৩ বছর, সম্পর্ক: ছেলে প্রস্তাবনা ১. শহীদ স্ত্রীকে মাসিক বা এককালীন সহযোগিতা করা যেতে পারে ২. শহীদ সন্তানদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেয়া যেতে পারে ৩. শহীদ সন্তানের লালনপালনে তাঁর স্ত্রীকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে