Image of মো: মনোয়ার হোসেন

নাম: মো: মনোয়ার হোসেন

জন্ম তারিখ: ১২ জুলাই, ১৯৭৪

শহীদ হওয়ার তারিখ: ৬ আগস্ট, ২০২৪

বিভাগ: ঢাকা

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা : বাস ড্রাইভার, শাহাদাতের স্থান : ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল

শহীদের জীবনী

শহীদ মো: মনোয়ার হোসেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেন শরীয়তপুর জেলার ফাতেহ জাঙ্গাপুর ইউনিয়নের নড়িয়া গ্রামে। সেখানেই তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। তার বাবার নাম আশু চৌকিদার ও মা খতেজা বিবি। খুব সাধারণ পরিবারে অর্থকষ্টের মধ্য দিয়েই তিনি বড় হয়ে ওঠেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি বিভিন্ন ছোটবড় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। তিনি আন্দোলনের উত্তপ্ত ময়দানে যাত্রাবাড়িতে পুলিশের গুলিতে ৫ আগস্ট গুরুতরভাবে আহত হন। তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করানো হয়। ৬ আগস্ট পৃথিবীর সমস্ত মায়া ত্যাগ করে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল পঞ্চাশ বছর। দিনকাল শহীদ মো: মনোয়ার হোসেন সাধারণ জীবনযাপনে ছিলেন অভ্যস্ত। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে তিনি নিজ জন্মভূমি শরীয়তপুর শহরে একটি টিনশেড বাড়িতে দুই রুমের একটি ঘর ভাড়া করে থাকতেন। তিনি শরীয়তপুর সুপার ডিলাক্স পরিবহনের ড্রাইভার ছিলেন। তার মাসিক আয় ছিল পনেরো থেকে বিশ হাজার টাকার মতো। তবুও তিনি স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন। একার উপার্জনে চলা সংসারটি তার বিদায়ের মধ্য দিয়ে গভীর সংকটে পড়েছে। ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে কিভাবে সামনের দিন কাটবে জানেন না তার স্ত্রী। তার স্বপ্ন ছিলো সন্তানদের পড়াশুনা করাবেন। নিজের একটা মাথা গোজার ঠাঁই হবে। স্ত্রী সন্তানদের মুখে হাসি দেখবেন। কিন্ত সকলের মুখে হাসি ফোটাতে গিয়ে নিজের জীবনই বিলিয়ে দিলেন। ছোট ছোট সন্তানদের এতিমের তালিকায় নাম লিখিয়ে চলে গেলেন পরপারে। মহান রবের সান্নিধ্যে। রেখে গেলেন হাজারো স্মৃতি। এতিম সন্তানেরা আর কাউকে ডাকতে পারবে না বাবা বলে। উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পরিবারটি বহুকষ্টে দিনযাপন করছে। আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ২০২৪ সালের জুলাই মাসেই শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মেধা মূল্যায়নের দাবিতে শুরু এই আন্দোলনের। তারা চায় বৈষম্যপূর্ণ কোটার অবসান হোক। মেধার ভিত্তিতে চাকরি দেয়া হোক। শত হাজার পেরিয়ে গেছে বেকারত্বের সংখ্যা। নিন্মবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তের একটাই ভরসার জায়গা তা হলো চাকরি। কুলি মজুরি করে খেয়ে না খেয়ে যারা পড়াশুনা করে একটা স্বপ্ন বুকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায় তা হলো একটা চাকরির প্রত্যাশা। কিন্তু বিভিন্ন কোটার কারণে তাদের মধ্যে বেশির ভাগই ওই পর্যন্ত পৌছাতেই পারে না। তাই তাদের একটাই দাবী বৈষম্য দূর করা। কিন্তু স্বৈরাচার সরকার তাদের এ দাবীর প্রতি সহানুভূতি না দেখিয়ে বরং অহমিকা প্রকাশ করেছে। বাধ্য হয়েই এই আন্দোলনের রূপরেখা পরিবর্তন হয়ে যায়। এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের শিক্ষার্থীরাও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে। নতুনভাবে দেশ স্বাধীন করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে আসে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ত্যাগের নজির দেখে মো: মনোয়ার হোসেন নিজেও শামিল হন আন্দোলনে। এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন তার সন্তানও। তিনিও বাবা হয়ে তাদের পাশে থেকেছেন জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অমায়িক চরিত্রের অধিকারী। সবার সাথে খুব সহজেই মিশে যেতেন। খুব বেশি পড়াশুনা করেননি তিনি। কিন্তু পড়াশুনার গুরুত্ব বুঝতেন। বিগত বছরগুলোতে কেমন করে দেশ চলছে তিনি জানতেন। ড্রাইভার ছিলেন বলে আরো বুঝতেন এ দেশের আইনের লোকগুলো কতোটা অনিয়ম করে চলেছে। যৌক্তিক ন্যায্য দাবীর কোন মূল্যায়নই নেই। নিজেদের যৌক্তিক দাবী আদায়ে কত সংগ্রাম আর ত্যাগের প্রয়োজন ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে শহীদ মনোয়ারও জানতেন। শহীদ হবার সময় জীবিকার তাগিদে মো: মনোয়ার বাড়ি থেকে ঢাকা চলে আসেন। সময়টি ছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চরম মুহুর্ত। তিনিও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে ছেলেমেয়েদের উৎসাহ দিয়ে পুলিশের নৃশংস আচরণের মোকাবেলা করছিলেন। ৫ আগস্ট তিনি যাত্রাবাড়ী থানার সামনে আন্দোলনে থাকাকালীন সময়ে মুহুর্মুহু গুলি বর্ষন হতে থাকে। ওই সময় অবস্থার ভয়াবহতা দেখে তিনি বাড়িতে তার স্ত্রীকে ফোন করেন। ফোনে স্ত্রীকে তিনি তখনকার অবস্থার বিররণ দিয়ে দোয়া করতে বলেন। তিনি তার স্ত্রীকে বলেন, ‘আমরা সবাই অনেক বিপদের মধ্যে আছি। আমাদের জন্য দোয়া করো। ছেলেমেয়েদের দেখে-শুনে রেখ। সব পাশ থেকে পুলিশ আমাদের ঘিরে রেখেছে। অনবরত গুলি চালাচ্ছে। দেশের মানুষের জন্য দোয়া করো।’ এই বলে তিনি ফোন রেখে দেন। এ ঘটনার কিছুক্ষন পর মো: মনোয়ার হোসেনের পাশে থাকা একজন তার স্ত্রীকে ফোন করে বলে ভাইয়ের বুকে গুলি লেগেছে। আমরা তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি। এরপর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আগস্টের ৩ তারিখ থেকেই তিনি আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। চিকিৎসারত অবস্থায় ৬ আগস্ট ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি শহীদ হবার সৌভাগ্য লাভ করেন। শহীদ পরিবারের আর্থিক অবস্থা শহীদ মো: মনোয়ার হোসেন তিন ছেলে রেখে এই দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। বড় ছেলে ইমন চৌকিদার (২৪) শরীয়তপুর কলেজে এইচএসসি তে পড়াশোনা করতেন। বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করেও তার আর যাওয়া হয়নি। মেঝো ছেলে রাকিব ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। অর্থের অভাবে বর্তমানে তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। আর ছোট্ট ছেলে সামিরের বয়স মাত্র ৩ বছর। শৈশবে বাবার আদর তার ভাগ্যে জোটেনি। শহীদ মনোয়ার হোসেন বড় ছেলেকে নিজেই বিয়ে করিয়ে ঘরে পুত্রবধু এনেছিলেন। তাদের সংসারেও গত ২৮ সেপ্টেম্বর কন্যা সন্তানের আগমন ঘটে। দাদার অন্তরে সেই নাতনির মুখ দেখার স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যায়। তাঁর শাহাদাতের মধ্য দিয়ে একটি সুখী সংসারের ভরণপোষণ চলছে বর্তমানে আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতার মাধ্যমে। উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে স্বচ্ছল একটি পরিবার আর্থিক দৈন্যদশায় দিনাতিপাত করছেন। শাহাদাতের ঘটনার পরপরই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী থেকে তারা দুই লাখ টাকা অনুদান পেয়েছিলেন। যা তাদের আর্থিক দুরাবস্থায় আশার আলো জাগায়। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীদের অনুভূতি শহীদ মো: মনোয়ার হোসেনের আচার-ব্যবহারে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা সবাই মুগ্ধ ছিলেন। তার প্রতিবেশী দোকানদারেরা বলেন, ‘মনোয়ার ভাই একজন ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি সবসময় হাসিমুখে কথা বলতেন। তার লেনদেন খুবই ভালো ছিল। কাউকে কষ্ট দিয়ে কখনও কথা বলতেন না। আমরা সবাই তার ব্যবহারে সন্তুষ্ট ছিলাম।’ শহীদের জীবনসঙ্গীনী নিজের স্বামী সম্পর্কে অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, ‘আমার স্বামী নিজের সুখ শান্তির কথা বাদ দিয়ে সবসময় আমাদের সুখের কথা ভাবতেন। সন্তানদের খুব ভালোবাসতেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেই তিনি এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলেন সবসময়। কারো সাথে তার কোনো ঝগড়া-বিবাদ ছিল না। তিনি খুবই মিশুক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন।’ এক নজরে শহীদ মো: মনোয়ার হোসেন নাম : মো: মনোয়ার হোসেন পেশা : বাস ড্রাইভার পিতা : আশু চৌকিদার মাতা : খতেজা বিবি ছেলে-মেয়ে : ৩ ছেলে। বড় ছেলে: ইমন চৌকিদার, বয়স: ২৪ বছর মেঝো ছেলে: রাকিব, বয়সয় ১৭ বছর, ছোট ছেলে: সামির, বয়স: ৩ বছর জন্ম তারিখ ও বয়স : ১২ জুলাই ১৯৭৪। বয়স: ৫০ বছর স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: শিলঙ্গল, ইউনিয়ন: ফাতেহ জাঙ্গাপুর, থানা: নড়িয়া, জেলা: শরীয়তপুর আহত হওয়ার তারিখ : ৫ আগস্ট ২০২৪ শহীদ হওয়ার তারিখ : ০৬ আগস্ট ২০২৪, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল আক্রমণকারী : পুলিশ শাহাদাত বরণের স্থান : যাত্রাবাড়ী থানা, ঢাকা দাফন করা হয় : নিজ মাতৃভূমি গ্রামের বাড়ি শিলঙ্গলের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ৬ জন আর্থিক সমস্যা সমাধানের প্রস্তাবনা ১. শহীদের বড় ছেলে ইমন চৌকিদারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হলে পরিবারটির আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে আসবে। ২. শহীদ পরিবারের স্বচ্ছলতার জন্য স্থায়ী একটি আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করা।

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of মো: মনোয়ার হোসেন
Image of মো: মনোয়ার হোসেন

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

নাজমুল হাসান

হাফেজ ছলেমান

ছোবহান মুন্সি

আব্দুল গণি

মামুন সরদার

মো: সোহেল

মোহাম্মদ নুরু

মো: হাছান মিয়া

মানিক মিয়া

জসিম ফকির

জাহাঙ্গীর আলম

মো: রিয়াজ হোসেন

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo