জন্ম তারিখ: ১৮ জুলাই, ১৯৮৪
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা : ব্যাংক কর্মকর্তা (এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, স্টান্ডার্ড ব্যাংক), শাহাদাত স্থান : ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
শহীদ মো: দুলাল জন্মগ্রহণ করেন শরীয়তপুর জেলার রুপবাবুর হাট ইউনিয়নের জাজিরা থানার চরগুটিয়া গ্রামে। তিনি শৈশব থেকেই বাবার সাথে কৃষিকাজ করতেন। পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য কৃষিকাজের পাশপাশি ভ্যানগাড়িও চালাতেন। অত্যন্ত মেধাবী হওয়ায় শৈশব থেকেই তিনি অনেক বড় হবার স্বপ্ন দেখতেন। বাবা মায়ের কষ্ট দূর করার জন্য দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা নিজ গ্রাম থেকেই সমাপ্ত করেন। পরবর্তীতে মাধ্যমিক ও উচ্চতর ডিগ্রি লাভের প্রত্যাশায় ঢাকায় চলে আসেন। সেখানে তিনি টিউশনি করে নিজ লেখাপড়ার ব্যয়ভার বহন করে পরিবারকেও আর্থিক সহযোগিতা করতেন। অত্যন্ত গরিব পরিবারের একজন সন্তান হয়েও তিনি জীবনের বাস্তবতায় সংগ্রামী হয়ে স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে গিয়েছেন। দিনকাল শহীদ দুলাল পেশায় একজন ব্যাংক কর্মকর্তা হিসেবে জীবনযাপন করেন। তিনি স্টান্ডার্ড ব্যাংকের এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি স্ত্রী, দুই সন্তান ও বাবা মা মিলে আজিমপুরে সরকারি কলোনিতে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। তার স্ত্রীও একজন কর্মজীবী মহিলা। তিনি একটি বেসরকারী স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত। শহীদ দুলালের পাঁচ ভাই গ্রামে বসবাস করেন। তন্মধ্যে চার ভাই কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন এবং অপর এক ভাই অটোরিক্সা চালক। বলা যায় সব ভাই-ই আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল। বোনদের মধ্যে সবাই বিবাহিত এবং তারাও আর্থিকভাবে অনগ্রসর। একমাত্র দুলালই ভালো অবস্থানে ছিলেন। দুলাল তার সাধ্যানুযায়ী ভাই-বোনসহ পরিবারের সবাইকে সহযোগিতা করতেন। তিনি শৈশব থেকেই সবাইকে নিয়ে ভাবতেন। অনেক কষ্টে বড় হওয়ায় নিজ সন্তানদের নিয়েও তিনি স্বপ্ন দেখতেন। তার খুব আকাঙ্ক্ষা ছিলো তার একটি বাড়ি হবে। সেই স্বপ্ন থেকেই এক টুকরো জমি কিনেছিলেন নিজ জেলার গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু একটি বুলেট সব স্বপ্নকে ধূলিস্যাৎ করে দিয়ে চলে যায়। স্বপ্নের বাড়িটি নির্মাণের আগেই তিনি শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন। শহীদ সম্পর্কে আপনজনদের মতামত শৈশব থেকেই ছিলো মাটির সাথে সম্পর্ক। ছিলো আপনজনদের আত্মার আত্মীয় হয়ে। বিপদে আপদে সর্বদা সবার আগে থাকতো দুলাল। স্বপ্নের শিখরে পৌঁছে ভুলে যায়নি গ্রামের অশিক্ষিত খেটে খাওয়া ভাইদের। বাবা-মাকে হৃদয়ের গভীরে সম্মান দিয়ে ভালোবেসে নিজের কাছেই রাখত দুলাল। তার সম্পর্কে প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, সহপাঠী, নিকটাত্মীয়, তার শিক্ষক সকলে এক বাক্যেই বলেন, দুলাল ছিল অত্যন্ত দায়িত্ববান একজন ব্যক্তি। তার ছোট ভাই তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন,‘ভাই ছিলেন অনেক দায়িত্ববান একজন। সবসময় আমাদের খোঁজখবর রাখতেন। তিনি সকলের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। এমনকি তিনি গ্রামের মুরব্বীদের বিশেষভাবে শ্রদ্ধা করতেন। ভাই আমার ছোট-বড় সবার সাথে ভালো ব্যবহার করতেন। শুধু নিজেদের নয় তিনি যে কারও বিপদে এগিয়ে যেতেন। আমাদের ভাই-বোনদের যে কোন জরুরি প্রয়োজনে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতেন। আমার আব্বা-আম্মাও ছিলেন ভাইয়ের প্রতি সন্তুষ্ট।’ এ থেকে সহজেই অনুমেয় শহীদ দুলাল কেমন ব্যক্তি ছিলেন। নতুন স্বাধীনতার যে স্বাদ আমরা আজ উপভোগ করছি এটা তাদেরই ত্যাগের ফসল। আগামীর বাংলাদেশ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করুক এই বীর যোদ্ধাদের। এটাই প্রত্যাশা। আন্দোলনের প্রেক্ষিত ঈদুল আজহা শেষ করে সব মানুষ তার কর্মস্থলের দিকে ধাবিত। তখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি ঈদুল আজহার আনন্দের রেশ। একযোগে পয়ত্রিশটি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। শিক্ষকেরা কর্মবিরতিতে। সরকারের এই বিষয়ে ছিলোনা কোন মাথা ব্যাথা। সামনেই ছিল ছাত্রদের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা। শিক্ষকদের কর্মবিরতির এই সময়ে ছাত্ররা তাদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন হয়। তারা চায় মেধার মূল্যায়ন। কোটা নয় মেধা। এটাই তাদের চাওয়া। এই চাওয়াকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের সূচনা। স্বৈরশাসক তরুণদের এই চাওয়াকে মূল্যায়ন করেননি। বরং কটাক্ষ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতির সাথে। শুরু হলো আন্দোলন। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত ঢাবি ক্যাম্পাস। শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে; চেয়েছিলাম অধিকার/ হয়ে গেলাম রাজাকার; আমি কে? তুমি কে?/ রাজাকার, রাজাকার। কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার! স্বৈরাচার!! গত পনেরো বছরের দুঃশাসনে ‘রাজাকার’ শব্দটি ছিল ফ্যাসিবাদ ও এর সহযোগীদের প্রধান অস্ত্র। ঢাবির শিক্ষার্থীদের পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের চক্ষুশূল হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে এতোদিনের ফ্যাসিবাদের অস্ত্রকে অকেজো করে ফেলে। মুহূর্তে ভেঙে পড়ে ফ্যাসিবাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। কতোটা কষ্ট, রাগ ও হতাশা থেকে এসেছিলো এই শব্দ। জুলাই গণ-অভুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ইতিহাস সৃষ্টি করে। যেভাবে শহীদ হলেন ১৯ জুলাই ২০২৪ সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবী আদায়ে ছাত্ররা যখন রাজপথে কর্মসূচী পালনে ব্যস্ত তখন আইনের পোশাক পরিহিত পুলিশ বাহিনি তাদের উপর মারাত্মকভাবে চড়াও হয়। মানুষকে ন্যায় দেয়ার কাজে নিয়োজিত সৈনিক নির্বিচারে এলোপাথাড়ি গুলি বর্ষণ করতে থাকে। এ সময় অসংখ্য ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয় এবং অনেকেই মারাত্মকভাবে জখম হয়। দুলাল আন্দোলনের শুরু থেকেই ছাত্রদের পাশে ছিলেন। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে সংগ্রামী দুলাল জানতেন তার মতো শতশত তরুণেরা আজ এতোগুলো বছর ধরে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। হয় কোটা নয় টাকা। এ দুটো যাদের নেই তাদের মনে হয় বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও নেই। কি নির্মম পরিহাস! এখানেই প্রশ্ন আসে এমন দিন দেখার জন্যই কি ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হয়েছিল! দুলাল অন্যান্য দিনের মতো ১৯ তারিখে আনুমানিক বিকেল ৫টায় ব্যাংক থেকে বের হয়ে বাসায় যাবার পথ ধরেন। তিনি আজিমপুর কলোনীতে এসে পৌঁছার পথে চারিদেকে কেবলই গুলির শব্দ। দ্রুত পথচলা দুলালের বুকের বাম পাশে একটি গুলি এসে বিদ্ধ হয়ে পেছন হয়ে বেরিয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। চারিদিকে তখনো গোলাগুলি চলছে। বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছাত্র-ছাত্রীরা দৌড়াদৌড়িতে ব্যস্ত। মাটিতে অনাদরে পড়ে থাকা দুলালের শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে থাকে। আশে-পাশের ছাত্ররা তার এ অবস্থা দেখে তাকে আরো জনতার সাহায্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তাকে দেখে কর্তব্যরত ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। তিনি শহীদ হবার গৌরব অর্জন করেন। শহীদ পরিবার শহীদ মো: দুলালের চলে যাওয়ায় তার পরিবারের সদস্যগণ আর্থিক সমস্যায় পড়েছেন। তিনি পরিবারের মধ্যে একমাত্র স্বাবলম্বী ব্যক্তি ছিলেন। তার রেখে যাওয়া দুই সন্তানের মধ্যে ছেলের বয়স ৭ বছর আর মেয়ের বয়স ৩ বছর। তাঁর স্ত্রী কর্মজীবী নারী। আয়ের সিংহভাগ খরচ হয়ে যায় বাড়ি ভাড়ায়। তবুও তার বৃদ্ধ বাবা-মাসহ তার সন্তানদের ভবিষৎ হুমকির সম্মুখীন। তার গরিব ভাই-বোন একমাত্র তাকে অবলম্বন করেই চলছিলেন। কিন্তু তাকে হারিয়ে আজ তারা দিশেহারা। পুলিশের একটি গুলি কেড়ে নিল সন্তানের কাছ থেকে তার পিতা, একজন স্ত্রীর কাছ থেকে তার স্বামী, অসহায় বৃদ্ধ বাবা-মায়ের শেষ বয়সের সম্বল। শহীদ পরিবারের একটাই চাওয়া যে জন্য তার ভাইকে এভাবে খুন করা হলো তাদের খুঁজে এনে আইনের মাধ্যমে বিচার নিশ্চিত করা। যারা তাদের দিয়ে এসব করিয়েছে তাদেরও যেনো বাংলাদেশের মাটিতেই শাস্তি হয়। এ দেশের জনগণ যেন এসব দেখে বুঝে নেয় অন্যায় করার শস্তি কতোটা ভয়াবহ। এক নজরে শহীদ মো: দুলাল নাম : মো: দুলাল পেশা : ব্যাংক কর্মকর্তা (এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, স্টান্ডার্ড ব্যাংক) পিতা : ছিদ্দিক খালাশী মাতা : জোলেখা বেগম ছেলের বয়স : ৭ বছর মেয়ের বয়স : ৩ বছর জন্ম তারিখ ও বয়স : ১৮ জুলাই ১৯৮৪ স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: চরখাগুটিয়া, ইউনিয়ন: রুপবাবুর হাট, থানা: জাজিরা, জেলা: শরীয়তপুর আহত হওয়ার তারিখ ও স্থান : ১৯ জুলাই ২০২৪, বিকেল ৪:০০টা, আজিমপুর কলোনী, ঢাকা-এর সামনে রাস্তায় শহীদ হওয়ার তারিখ : ১৯ জুলাই ২০২৪ বিকেল ৫:০০টা আক্রমণকারী : পুলিশ শাহাদাত বরণের স্থান : ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল দাফন করা হয় : গ্রামের বাড়ি চরখাগুটিয়ায় পারিবারিক গোরস্থানে ভাইবোনের বিবরণ : ৫ ভাই পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ৭ জন শহীদের জন্য আার্থিক সহযোগিতার প্রস্তাবনা ১. ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার দায়িত্বভার গ্রহণ করা একান্ত জরুরি ২. স্থায়ীভাবে ভাতার ব্যবস্থা করলে পরিবারটি স্বচ্ছলভাবে জীবনযাপন করতে পারবেন