জন্ম তারিখ: ২ মে, ১৯৯৯
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা_সিটি
পেশা: শ্রমিক (রাবার কারখানা) শাহাদাতের স্থান : রায়ের বাগ, ফুট ওভার ব্রীজ, ঢাকা
একদিন বড় বস্থায় আব্বুকে কবর থেকে তুলে আনব - ইরফান শহীদের পরিচয় অল্প বয়সে বাবাকে হারান শহীদ মো: ইমন (২৫)। তার বাবা জনাব ইসমত আলী দুরারোগ্য ক্যান্সার ব্যাধিতে ভুগে মৃত্যুবরণ করেছেন। শহীদের পিতা পেশায় দিনমজুর ছিলেন। জীবিত থাকাকালীন তার পরিবার চিকিৎসার জন্য পৈতৃক ভিটা-মাটি বিক্রি করেছেন। এরপরও তাদের পক্ষে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব হয়নি। বাধ্য হয়ে আত্মীয়-স্বজনের দ্বারস্থ হয় পরিবারটি। একপর্যায়ে তারা ঋণ করেন। তবুও ইসমত আলীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, তিন সন্তান, সোহাগ (৩৫), সজিব (৩২), ও ইমনকে রেখে চির বিদায় নিয়েছেন। অতঃপর বড় দুই ছেলে রিক্সা চালিয়ে সংসারের হাল ধরেন। পরবর্তীতে সংসার জীবন শুরু করলে তারা আলাদা হয়ে যান। সংসারের বাড়তি খরচ চালাতে না পেরে হিমশিম খায় পরিবার দুটি। এমনকি বৃদ্ধা মায়ের দেখাশোনা করতেও তারা অপারগতা প্রকাশ করেন। খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওঠে তার পরিবার মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে কর্মজীবনে পদার্পণ করেন ইমন। যাত্রাবাড়ী গরিবে নেওয়াজ রাবার কারখানায় পাঁচ হাজার টাকা বেতনে চাকরি নিয়ে শিশু বয়সেই সংসারের হাল ধরেন। এর মধ্যে আবার জনকের রেখে যাওয়া ঋণ পরিশোধ করতে পরিবারের উপর আত্মীয়-স্বজনের চাপ আসতে শুরু করে। বাধ্য হয়ে কারখানার ডিউটি শেষে বিকালে অটো রিক্সা চালিয়ে বাড়তি উপার্জন শুরু করতে হয় তাকে। ক্রমান্বয়ে ঋণের বোঝা কমতে থাকে। আবারও হাসি ফিরে পায় শহীদ পরিবার। কিছুদিন পর ইমন বিয়ে করেন। ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয় ইরফান। সংসারে উৎসব মুখর পরিবেশ বিরাজ করে। ধীরেধীরে শহীদের উপার্জন বৃদ্ধি পায়। ঝুপড়ি ঘর ছেড়ে স্ত্রী, সন্তান ও মাকে নিয়ে মাতুয়াইল কবরস্থান রোডের একটি ভাড়া বাড়িতে ওঠেন। আবারও সন্তানসম্ভবা হন মুলছুমা আক্তার। খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওঠেন শহীদ ইমন। পরিবারে নতুন অতিথির আগমনী সুসংবাদ পেয়ে শহীদ জননী আপ্লুত হয়ে পড়েন। “সাপ্তাহিক পারিশ্রমিক আনতে কারখানায় যাচ্ছি।” আন্দোলন ও শাহাদাত শুক্রবার, ১৯ জুলাই ২০২৪। নিজ বাসা থেকে বের হন ইমন। উদ্দেশ্য গরিবে নেওয়াজ রাবার কারখানা। বের হওয়ার সময় স্ত্রীকে বলে যান,“সাপ্তাহিক পারিশ্রমিক আনতে কারখানায় যাচ্ছি।” অতঃপর যাত্রাবাড়ী রায়েরবাগ ফুট ওভার ব্রীজ পার হয়ে রাবার কারখানায় পৌঁছান তিনি। সেখান থেকে সাপ্তাহিক বেতন সংগ্রহ করেন। যাওয়ার সময় খেয়াল করেন চারিদিক লোকে লোকারণ্য। জানতে পারেন সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলছে। যার কারণে সাধারণ ছাত্ররা দাবি আদায়ে রাস্তা অবরোধ করে রেখেছে। তাই সাবধানে রাস্তার এক পাশ দিয়ে চালাচল করতে থাকেন তিনি। চারিদিকে ছাত্রদেরকে লক্ষ্য করে খুনি হাসিনার ঘাতক নরপিশাচ পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনী গুলি ছুড়তে থাকে। পুলিশ নাকি জনগণের মিত্র। অথচ সেদিন নিজের বিবেক, দেশ, ও পোশাকের সম্মানের সাথে গাদ্দারি করে তারা। সারা দেশে এক নাগাড়ে টিয়ার শেল, রাবার বুলেট, ছররা গুলি চালায় স্বৈরাচারী হাসিনার পালিত গুন্ডা সদৃশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গুম, খুন, নির্যাতন, মামলা করে ছাত্র-জনতাকে হয়রানি শুরু করে তারা। একপর্যায়ে হাসিনার মদদ পেয়ে হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালায় ঘাতক র্যাব। টহলের নামে বিজিবি বাহিনী সাধারণ মানুষদেরকে হত্যা করে। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা দেশীয় অস্ত্র ও রাইফেল নিয়ে সাধারণ ছাত্রদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। এ যেন মানুষ নামের রক্তখেকো হায়েনার দল। ভয়ভীতি দেখিয়ে ছাত্রদেরকে ছত্রভঙ্গ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করার পরও জনতাকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি খুনি হাসিনা ও তার দলবল। বারবার তার হাত ধরে ইমন বলতে থাকে ‘আমাকে বাঁচান ভাই।’ সেদিন পুলিশের গুলিতে রায়ের বাগ ফুট ওভার ব্রীজ সংলগ্ন এলাকা যেন মৃত্যুপুরী হয়ে ওঠে। ভয়ে গা শিউরে ওঠে ইমনের। সন্ধ্যা সাতটা, জোর পায়ে হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। হঠাৎ হাসিনার লেলিয়ে দেয়া পুলিশ সদস্যের একটি বুলেট শহীদের বুকে এসে আঘাত করে। মুহূর্তেই রক্তে ভেসে যায় তার শরীর। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ইমন। প্রচণ্ড আওয়াজ করে বলতে থাকে ‘আমাকে বাঁচান, ভাই’। ছাত্ররা ছুটে আসে। খবর পেয়ে ঘটনা স্থলে আসে ইমনের বাল্য বন্ধু সজিব (২৫)। দুজনে একই কারখানায় কাজ করেন। ভাই সমতুল্য বন্ধুকে দ্রুত সিএনজিতে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান তিনি। বারবার তার হাত ধরে ইমন বলতে থাকে ‘আমাকে বাঁচা ভাই।’ দ্রুত তাকে জরুরী বিভাগে ভর্তি করা হয়। অক্সিজেন দেয়ার পরও ছটফট করতে থাকে ইমন। কিছুক্ষণ পর সেখানেই তার মৃত্যু হয়। ঘাতকের গুলিতে মাত্র ২৫ বছর বয়সে ঝরে যায় এক সম্ভাবনাময় তরুণের জীবন। তার মৃত্যুতে মাতৃগর্ভে থাকা অনাগত সন্তান ও চার বছরের ইরফান চিরদিনের জন্য এতিম হয়ে যায়। মাত্র তেইশ বছর বয়সে বিধবা হয় মুলছুমা আক্তার। লাশ নিয়েও বাধে আপত্তি। পুলিশ ইমনের লাশ দিতে অস্বীকার করে। স্বামীর লাশ নিতে অনেক অনুনয়-বিনয় ও হাত জোড় করে মুলছুমা আক্তার। থানায় গিয়ে পুলিশের হাতে-পায়ে ধরে শহীদ জননী। একপর্যায়ে পুলিশ শহীদের লাশ ফেরত দেয়। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও মায়ের আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। অবশেষে মাতুয়াইল দোতালা মসজিদ প্রান্তরে ইমনের জানাজা সম্পন্ন হয়। জানাজা শেষে মাতুয়াইল কবরস্থানে শহীদ ইমনের লাশ চিরদিনের জন্য শায়িত করা হয়। “আমার ছেলের একটা ভবিষ্যৎ আছে। তার জন্য কিছু একটা করতে হবে।” বন্ধুর অনুভূতি: শহীদের বাল্যবন্ধু সজিব বলেন- “আমার বন্ধু ইমন খুব ন্যায়পরায়ণ ছিল। কাজকর্মে ছিল খুবই সুশৃংখল। মহাজন তাকে খুব পছন্দ করত। কখনও একা থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত না ইমন। তাকে কখনও সময় অপচয় করতে দেখিনি আমি। ছুটির দিনে বা ডিউটি শেষে রোজ অটো রিক্সা নিয়ে বের হত। বারবার বলত, ‘আমার ছেলের একটা ভবিষ্যৎ আছে। তার জন্য কিছু একটা করতে হবে।’ খুব ভাল মানুষ ছিল ইমন। আমি আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুকে হারিয়েছি। তাকে হারিয়ে আমার বুকটা এখন শুন্য। আল্লাহ তায়ালা আমার বন্ধুকে জান্নাত দান করুন। (আমিন)” বসবাস করার মতো নিজস্ব এক খন্ড জমিও নেই শহীদ স্ত্রীর কর্তার বিদায়ে করুণ পরিণতি পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন শহীদ ইমন। তার আকস্মিক মৃত্যুতে পরিবারে নেমে এসেছে চরম অর্থনৈতিক মন্দা। অবস্থা শোচনীয় দেখে বাধ্য হয়ে তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী স্বল্প বেতনে গার্মেন্টস কর্মী হিসেবে চাকরি নিয়েছেন। ইমনের বড় দুই ভাই রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। ইচ্ছে থাকলেও তাদের পক্ষে সংসারের দায়িত্ব নেয়া সম্ভব নয়। শহীদ ইমন পরিবারকে স্বপ্ন দেখালেন ঠিকই, কিন্তু তা আর বাস্তবায়ন করতে পারলেন না। মুহূর্তে তার তাজা প্রাণ কেড়ে নিল রক্ত চোষা পুলিশ বাহিনী। সন্তানের মৃত্যুতে নাতী ও পুত্রবধূকে নিয়ে যেন ঘোর বিপাকে পড়েছেন জোছনা বেগম। আবারও তার সংসারে নেমে এসেছে দৈন্যদশা। সদ্য এতিম হওয়া সন্তানদের ভবিষ্যত কিভাবে সুগম করবে তা জানেন না মুলছুমা আক্তার। বাড়িতে বৃদ্ধ মায়ের ঔষধ কেনার মতো টাকাও অবশিষ্ট নেই। তার ওপর বাড়তি ঋণের বোঝা। বাড়ি ভাড়ার চাপ। যেন স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলার উপায়টুকু নেই। বসবাস করার মতো নিজস্ব এক খন্ড জমিও নেই শহীদ স্ত্রীর। যান্ত্রিক এই শহরে বর্তমানে উদ্বাস্তু হয়ে বসবাস করছে ইমনের পরিবার। ইরফান বারবার আব্বুর জন্য চিৎকার করে কাঁদে। বাবাকে কবর ভেঙ্গে উঠাতে চায় সে। মায়ের কাছে বায়না করে,বাবার মুখে চুমু খাবে এবং মাকে জানায়-‘একদিন বড় বস্তায় বাবাকে কবর থেকে তুলে আনবে সে।’ কী মর্মান্তিক! কী হৃদয় বিদারক! এক নজরে শহীদের ব্যক্তিগত তথ্য নাম : শহীদ মো: ইমন পেশা : রাবার কারখানার শ্রমিক জন্ম তারিখ ও বয়স : ২ মে ১৯৯৯, ২৫ বছর শহীদ হওয়ার তারিখ : ১৯ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার, আনুমানিক সন্ধ্যা ৭ টা শাহাদাত বরণের স্থান : রায়ের বাগ, ফুট ওভার ব্রীজ, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা দাফন করা হয় : মাতুয়াইল কবরস্থান স্থায়ী ঠিকানা : স্থায়ী নিবাস নেই পিতা : মরহুম মো: ইসমত আলী মাতা : মোছা জোছনা বেগম ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : জায়গা জমি নেই স্ত্রী : মুলছুমা আক্তার, পেশা: গার্মেন্টস কর্মী, বয়স: ২৩ বছর ভাইবোন ও সন্তানের বিবরণ ১. মো: ইরফান, সম্পর্ক: ছেলে, বয়স: ০৪ ২. সোহাগ, সম্পর্ক: বড় ভাই, বয়স: ৩৫, পেশা: রিকশা চালক ৩. সজিব, সম্পর্ক: মেজ ভাই, বয়স: ৩২, পেশা: রিকশা চালক প্রস্তাবনা ১. শহীদ পরিবারকে এককালীন সহযোগিতা করা যেতে পারে। ২. শহীদ স্ত্রীর নিজস্ব কোনো ঘর নেই। তিনি এতিম সন্তানদের জন্য স্থায়ী একটি নিবাস চেয়েছেন। ৩. শহীদ সন্তানের লালন পালনে মাসিক ও এককালীন আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন।
তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ও সন্তুষ্টি লাভ করবে এবং তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী জান্নাত। (সুরা আল-ইমরান ৩:১৫)
হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে শহীদ হতে চায়, আল্লাহ তাকে শহীদের সাওয়াব দেন।” (সহীহ মুসলিম ১৮৮৮)







