জন্ম তারিখ: ১৫ জানুয়ারি, ১৯৯৭
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা : রিকশা চালক , শাহাদাতের স্থান : মিরপুর ১০ (মিরপুর আইডিয়াল কলেজ)
শহীদ মো: জোনায়েদ ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি নরসিংদী জেলার হাসনাবাদ রায়পুরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পেশায় তিনি একজন অটোরিক্সা চালক ছিলেন। তাঁর পিতার নাম আনোয়ার হোসেন এবং মাতার নাম হালিমা। তিনি একজন গৃহিনী। পারিবারিক জীবন শহীদ জোনায়েদ ছিল পরিবারের বড় ছেলে। তাঁর বাবার একটা পাকা বাড়ি আছে কিন্তু কোন আয় নেই। জোনায়েদ মিরপুর এলাকায় ৪/৫ বছর ধরে অটো রিক্সা চালাতো এবং পরিবার নিয়ে মিরপুর জল্লাদ থানার এলাকায় থাকত। তাঁর বাবা কিছু করতে অক্ষম। তার পিতা আনোয়ার হোসেন জানান,তার তিন পুত্র সন্তান এবং এক কন্যা সন্তান ছিল। জোনায়েদ সবার বড়। তারপরে কারিমা খাতুন নামে এক কন্যা সন্তান ছিল। গত করোনা মহামারির সময় পিত্ততলিতে পাথর হয়ে সে মারা যায়। অপর দুই পুত্র সন্তানের নাম আরিফুল ইসলাম ও আশরাফুল ইসলাম। অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় তার ভাগ্যে পড়ালেখার সুযোগ হয়নি। কোন রকমে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে জীবন জীবিকার তাগিদে রাজধানী ঢাকা শহরে অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালাতো। ছোটভাই,আরিফুল ও ট্রাকের হেলপার হিসাবে কাজ করে। জোনায়েদ ২০২০ সালে নরসিংদী, চালাকচর গ্রামের হাফছা খাতুনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তির অকাল মৃত্যুতে বর্তমানে নিদারুন কষ্টে দিনাতিপাত করছে স্ত্রী হাফছা খাতুন সহ গোটা পরিবার। আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে জনগণ নানান অন্যায়, শোষণ, নিপীড়ন ও জুলুমের নির্মম ভুক্তভোগী। এদেশের মুক্তিকামী জনতা সময়ের দাবিতে সাড়া দিয়ে এহেন অত্যাচারের বিরুদ্ধে বারংবার রুখে দাঁড়িয়েছে। সেই সাথে হুংকার দিয়ে সংগ্রামী জনতার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে ছাত্রবৃন্দ। উপরুন্তু গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সাক্ষী, দেশের ক্রান্তিকালে বরাবরই ছাত্রদের মাধ্যমে আন্দোলন সংগ্রামের সূত্রপাত ঘটে। দীর্ঘ ১৫ বছরে আওয়ামী দুঃশাসন, ভোটচুরি, দুর্নীতি, খুন, অন্যায়, অত্যাচার জনমনে ফেলেছিল বিরূপ প্রতিক্রিয়া। কোটা প্রথা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আবার ষড়যন্ত্র শুরু করে আওয়ামী সরকার। ২০১৮ সালে ছাত্রছাত্রীদের প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সকল দাবী মেনে নিলেও তার অন্তরে ছিল হিংসার অগ্নিগিরি। তাই ২০২৪ তালে একটি বিরোধী দলহীন নির্বাচনে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর আবার কোটা ফিরিয়ে আনতে চাইল হাসিনা সরকার। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা আন্দোলন শুরু হয়েছিল গত ১ জুলাই থেকে। অহিংস এই আন্দোলন ১৫ জুলাই থেকে সহিংস হয়। আন্দলোনে নিরস্ত্র ছাত্র জনতার ওপর সশস্ত্র ঘাতক ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও পুলিশ সদস্যরা হামলা চালাতে থাকে। রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের শাহাদাতের পর থেকেই আন্দোলন গণমানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন ক্রমেই জনসাধারণের আন্দোলনে রূপ নেয়। এটি বৈষম্যবিরধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন হিসেবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে সাধারণ ছাত্রদের অহিংস আন্দোলন ধীরে ধীরে ফ্যাসিস্ট সরকার বিরোধী অভ্যুত্থানের দিকে ধাবিত হতে থাকে। পর্যায়ক্রমে এ আন্দোলন শুধু ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; হয়ে উঠে দেশের আপামর জনতার এক বিশাল গণঅভ্যুত্থান। জাতি,ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এ অভ্যুত্থানে একাত্মতা প্রকাশ করে রাজপথে বেরিয়ে আসে। ক্ষুব্ধ জনতার তোপের মুখে স্বৈরাচার সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু পদত্যাগের পূর্বে তিনি রেখে যান তার ঘৃণ্য ও বিকৃত মস্তিষ্কের অজস্র কুকীর্তি। এরই অংশ হিসেবে আন্দোলনকারী সহ অনেক নিরীহ জনতার উপর লেলিয়ে দেয়া হয় সশস্ত্র বাহিনী। তাদের গুলিতে শহীদ হয় নিরস্ত্র নিপীড়িত জনতা। আন্দোলনে যোগদান বাংলাদেশ নামক গাড়িটা যখন এমনভাবে ব্রেক ফেইল করলো আর বাংলাদেশী নামক যাত্রীরা যখন আতঙ্কিত; চারদিকে যখন কষ্ট, বেদনা, চিৎকার, আহাজারি আর নিশ্চিত ধ্বংসের সুস্পষ্ট লক্ষণ, তখন শহীদ জোনায়েদের মত রিকশা চালকও কি বসে থাকতে পারে? তার হৃদয়ে কি দাগ কাটতে পারেনা? পেশায় রিকশা চালক হলেও রাষ্ট্রযন্ত্রের এমন বর্বরতা দেখে সমাজ সচেতন একজন জোনায়েদের মনেও আঁচড় কাটতে পারে। কেননা সবকিছু তো তার সামনেই ঘটছে। তিনি নিজের কানেই শুনছেন মানুষের নিদারুণ আর্তনাদ; ব্যথিত মনের হাহাকার। নিজের চোখে দেখছেন কিভাবে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে শাসক নামধারী শোষক গোষ্ঠী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে, ২০২৪ সালের ৪ আগষ্ট রবিবার, দুপুরে জোনায়েদ তাঁর বন্ধুদের সাথে আন্দোলনে যোগ দেয়। যেভাবে শহীদ হন শহীদ জুনায়েদ এই আন্দোলন মিছিলে দু,বার গুলি বিদ্ধ হয়।প্রথম বার বেঁচে গেলেও দ্বিতীয়বার তার শেষ রক্ষা হয়নি। গত ২৫ জুলাই মিছিলে থাকাকালীন কল্যানপুর এলাকায় তার ডান পায়ে রাবার বুলেটের ২ টি গুলি লাগে। তারপর পা থেকে প্রথম বার রাবার বুলেট বের করতে সক্ষম হলেও দ্বিতীয়বার মাথায় আঘাত করা রাইফেল এর গুলিতেই জুনায়েদ শাহাদাত বরণ করে। প্রথম বার তার পা থেকে গুলি বের করার পর কিছুটা সুস্থ্য হলে আবারো ৪ আগস্ট রাজধানী ঢাকা শহর যখন হাসিনা সরকারের অপসারণ দাবিতে মিছিলের জনসমুদ্রে পতিণত হয়। জুনায়েদ তখন সেই মিছিলের অগ্রভাগে থাকায় মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে সরকারের পুলিশ বাহিনী যখন বেপরোয়া ভাবে মিছিলকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকে তখন জুনায়েদ এর মিছিলটি দুপুর ২ ঘটিকায় মিরপুর আইডিয়াল কলেজ অতিক্রম করার সময় ঘাতক পুলিশের রাইফেল থেকে ছোঁড়া ২টি বুলেট তার মাথায় আঘাত হানে এবং মস্তক ভেদ করে পিছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। অন্যান্য সাথীরা তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় আগারগাঁও নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে ভর্তি করার পর তাঁর মাথা থেকে প্রচুর রক্ত ক্ষরনের ফলে রাত ১২ টা ৩০ মিনিটে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। রচিত হয় দ্বিতীয় স্বাধীনতার রক্তক্ষয়ী ইতিহাস। জানাযা ও দাফন ৫ আগস্ট শহীদ মোঃ জোনায়েদ এর মরদেহ বাড়িতে আনার পর বাদ যোহর নামাজের পর তাঁকে দক্ষিণ মির্জানগর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। শহীদ সম্পর্কে প্রতিবেশীর বক্তব্য জুনায়েদ এর অকাল মৃত্যুতে তার পরিবারের বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে দক্ষিন মির্জানগরের বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী, সংগঠক, প্রতিভা টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট নরসিংদীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক শর্ট কোর্স ঐক্য পরিষদ বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের প্রধান সমন্বয়ক মো: নাসিরুদ্দিন ভুঁইয়া বলেন, এই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জুনায়েদ তাঁর বুকের তাজা রক্ত দিয়ে লিখে গেছে দ্বিতীয় স্বাধীনতার ইতিহাস।এই তরুন শহীদ বীর কে আমি স্যালুট জানাই। প্রস্তাবনা ১. পরিবারকে এককালীন আর্থিক অনুদান প্রদান ও নিয়মিত মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করা। ২. সন্তানদের ভবিষ্যতের ভরণপোষণ নিশ্চিত করা। ৩. শহীদের ছোট ভাইয়ের ভালো চাকুরীর ব্যবস্থা করা। একনজরে শহীদের ব্যগতিগত তথ্যাবলি নাম : মো: জোনায়েদ পেশা : রিকশা চালক জন্ম : ১৫-০১-১৯৯৭ ঠিকানা : গ্রাম : পূর্ব পাড়া, ইউনিয়ন : আমিরগঞ্জ, থানা: রায়পুর জেলা : নরসিংদী পিতা : আনোয়ার হোসেন মাতা : হালিমা, পেশা : গৃহিণী ঘটনার স্থান : মিরপুর ১০ (মিরপুর আইডিয়াল কলেজ) আক্রমণকারী : স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সন্ত্রাসী পুলিশ বাহিনী আহত হওয়ার সময়কাল : ৪ আগস্ট ২০২৪ দুপুর ২.০০ টা মৃত্যুর তারিখ ও সময় : ৫ আগস্ট ২০২৪ রাত ১২.৩০ টা শহীদের কবরের অবস্থান : হাসনাবাদ পূর্বপাড়া (পারিবারিক কবরস্থান)