জন্ম তারিখ: ২ আগস্ট, ২০০৭
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা : ছাত্র , শাহাদাতের স্থান : ইটাখোলা পুলিশ ফাড়ি শিবপুর, নরসিংদী
জুলাই ২০২৪ এর আন্দোলন ছিল তরুণদের আন্দোলন। এটি ছিল অধিকারের লড়াই। একটি যৌক্তিক চাওয়াকে কেন্দ্র করে ঝরে গেল তাজা শতশত প্রাণ। জীবনের চেয়ে মূল্যবান কি আছে? ছিল না শাসক শ্রেণীর সঠিক ভূমিকা। দীর্ঘ সময় ক্ষমতা তাদের হৃদয়কে পাথর বানিয়ে দিয়েছিল। ন্যায়ের প্রতি ছিল না কোনো শ্রদ্ধা সম্মান। মানুষের অধিকার ছিল যেন একটি খেলনাতুল্য। অথচ আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা তরুণের শক্তি সাহসকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছিল। আল্লাহ তাআলা তরুণদের মাধ্যমে দেখিয়েছেন পৃথিবীর ক্ষমতা যত দীর্ঘই হোক তার ভিত্তি ততটোই দুর্বল। অসহায়ের চোখের পানির মূল্য অনেক। মাত্র একটি কোটা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসকে পাল্টে দিয়েছে। স্বৈরশাসনের পিষ্টে নিষ্পেষিত জাতি অন্ধকারের অতল গহ্বরে যখন নিমজ্জিত ঠিক সেই সময়ে তরুনরা নিজের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশকে একটি নতুন পথের দিকে আহ্বান জানায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের সাথে হাজির হয় স্কুল কলেজ মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীরা। অভিভাবকগণও ছিল তাদের পাশে। তাদের পদচারনায় বাংলাদেশের চিত্র বদলে যায়। আপামর জনসাধারণ উপলব্ধি করে পরিবর্তনের সময় এখনই। দেশকে বাঁচাতে হবে। বাঁচাতে হবে দেশের যুব সম্প্রদায়কে। হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আজকের এই বাংলাদেশ। একমাত্র তরুণদের দিয়েই সম্ভব আগামীর আলোকিত বাংলাদেশ গড়া। তাদের ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়েই অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা ২০২৪। পরিচয় শহীদ তামিন হৃদয়। তামিন নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলায় দক্ষিণ সাধারচর গ্রামে ২ আগস্ট ২০০৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা তমিজ উদ্দিন মীর ও মাতা রুমি বেগম। অল্প বয়সেই তার মা ইন্তেকাল করেন। দাদীর কাছেই তমিন বড় হয়ে ওঠে। তামিন হরিন্দ পশ্চিমপাড়া আল আহেলিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার ছাত্র। তিনি নযরানা শেষ করে হাফিজিয়া পড়ছিলেন। মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তার নয় পারা মুখস্ত ছিল। মা হারা ভাইদের মধ্যে বাবা ও দাদীর তামিনকে নিয়েই ছিল অনেক স্বপ্ন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের স্বীকার হয়ে ১৯ জুলাই ২০২৪ আনুমানিক সন্ধ্যা ৬টায় তিনি শহীদের রক্তে রঞ্জিত হন। পারিবারিক অবস্থা শহীদ তামিনরা ছিল চার ভাই। তার মেজো ভাই রিহান মীর সৈয়দেরখোলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র। সেজো ভাই রিয়াদ মীর হরিন্দা মাদরাসায় নাযরানা পড়ছে। ছোট ভাই সিয়াম দক্ষিণবাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২য় শ্রেণীর ছাত্র। ভাইদের মধ্যে তামিনই ছিল বড়। মায়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সে দাদির নিকটই বড় হয়ে ওঠে। তাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছয়। তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তার বাবা। তিনি কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাদের বর্তমান বাড়িটি পাকা কিন্তু অনেক পুরনো। কৃষিকাজ করার জন্য তাদের রয়েছে ১.৫ বিঘা জমি। খুবই অল্প বয়সে এই মেধাবী তরুণের মৃত্যুতে পুরো পরিবার গভীরভাবে শোকাহত। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা ও দাদীর কাছে তারা চার ভাই ছিল বেঁচে থাকার প্রেরণা। তামিন একদিন হাফেজ হবে বাবা ও দাদীর সব আশা আকাঙক্ষাকে শেষ করে তামিন শহীদের অমীয় সুধা পান করেন। তার সব স্মৃতি স্মরণ করেই দিন কাটছে তামিনের পরিবারের। আন্দোলনের প্রেক্ষিত তরুনদের কোটা নয় মেধা এই একটি দাবী হয়ে উঠেছিল জুলাই ২৪ এর গণ বিষ্ফোরণ। স্বৈরাচার হাসিনা সরকার তরুণদের এই চাওয়াকে গুরুত্বের সাথে নেয়নি। তাদের যৌক্তিক দাবিকে যেভাবে কটাক্ষ করেছিল তাতে টগবগে তরুণদের রক্তে আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছিল। তখনো ঈদুল আযহার রেশ কাটেনি। ঈদের আনন্দ শেষে মানুষ তার কর্মস্থলে ফিরছে। ছাত্ররা ফিরছে তাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠানে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে শিক্ষকদের কর্মবিরতি। শেখ হাসিনা তার ক্ষমতায় এতোটাই অহংকারী হয়ে উঠেছিল শিক্ষকদেরও অসম্মান করতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করেননি। বলা হয় অহংকারই পতনের মূল। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তার মুখ থেকে তরুণদের উদ্দেশ্যে যে কটাক্ষবাণী তিনি দিয়েছেন তার বিনিময়ে তরুন সমাজ স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করেছে বাংলাদেশ। শুরু হয় আন্দোলন। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত ঢাবি ক্যাম্পাস। শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে; চেয়েছিলাম অধিকার/ হয়ে গেলাম রাজাকার। কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার; স্বৈরাচার। ঢাবির শিক্ষার্থীদের পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের চক্ষুশূল হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে এতোদিনের ফ্যাসিবাদের অস্ত্রকে অকেজো করে ফেলে। মুহূর্তে ভেঙে পড়ে ফ্যাসিবাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। জুলাই গণ-অভুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ইতিহাস সৃষ্টি করে। যেভাবে শহীদ হলেন হাফেজি পড়া একটি ছাত্র জানে শহীদের মর্যাদা কতোটা। যৌক্তিক আন্দোলনে সমর্থন ছিল মাদ্রাসার ছাত্রদের। তামিনও ছিল সমর্থনদের অন্যতম। হরিন্দা পশ্চিম পাড়া আলিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার হাফিজিয়া ছাত্র শিক্ষক সকলেই ১৯ জুলাই শুক্রবার জুমআর নামাযের পর আন্দোলনে যোগ দেয়। শহীদ তামিন হৃদয়ও এই আন্দোলনে ছিল সক্রিয়। সেদিন নরসিংদী জেলার শিবপুর থানার ইটাখোলা পুলিশ ফাঁড়ি এলাকায় আসলে পুলিশ ছাত্র জনতার উপর অতর্কিত হামলা করে। পুলিশের লাঠি, টিয়ারসেল নিক্ষেপের সাথে চলে গুলির বহর। দিকবিদকশূন্য হয়ে সবাই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ঠিক এমনই একটা সময়ে পুলিশের গুলি এসে তামিনের বুকে এবং পায়ে বিদ্ধ হয়। সেখানেই তামিন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মাগরিবের আজানের পর গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখা যায় শহীদ তামিনকে। এশার ওয়াক্ত হয়ে গেলেও যখন তামিন বাড়ি ফিরল না। পরিবারের সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর যখন তাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিল না তখন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে তার মৃতদেহ উদ্ধার করে। প্রিয় সন্তানের মৃতদেহ পেয়ে বাবা বাকরুদ্ধ। কিছুই যেন বলার নেই। কার কাছে অভিযোগ করবে। কারন এতো পুলিশের গুলিতেই শহীদ হয়েছে। নিজ গ্রামে তামিনের জানাজার নামাজ শেষে সামাজিক কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। এক নজরে শহীদ তামিন হৃদয় নাম : তামিন হৃদয় পেশা : ছাত্র পিতা : তমিজ উদ্দিন মীর মাতা : রুমি বেগম জন্ম তারিখ ও বয়স : ০২ আগস্ট ২০০৭। বয়স ১৭ বছর স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: দক্ষিণ সাধারচর, থানা/উপজেলা: শিবপুর, জেলা: নরসিংদী শহীদ হওয়ার তারিখ : ১৯ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার আনুমানিক সন্ধ্যা ৬.৩০টা আক্রমণকারী : পুলিশ শাহাদাত বরণের স্থান : ইটাখোলা পুলিশ ফাড়ি শিবপুর, নরসিংদী দাফন করা হয় : সামাজিক কবরস্থান, সাধারচর কবরের জিপিএস লোকেশন : সামাজিক কবরস্থান, সাধারচর, নরসিংদী ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : ১.৫ বিঘা কৃষি জমি। একটি পাকা বাড়ি যা অনেক পুরোনো ভাইবোনের বিবরণ : ৪ ভাই পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ৫ জন