Image of মো: মেহেদী হাসান

নাম: মো: মেহেদী হাসান

জন্ম তারিখ: ১৪ জুলাই, ২০০৭

শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪

বিভাগ: ঢাকা_সিটি

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা: শ্রমিক (গাড়ির চাকা মেরামত কারখানা) শাহাদাতের স্থান :কুতুবখালী পকেট গেট, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা

শহীদের জীবনী

‘মা, আমি আছিতো, তোমার কোনো ভয় নেই।’ যেখানে রঙিন স্বপ্ন বড়োই বেমানান বাল্যকাল থেকে লেখাপড়ায় খুব মনোযোগী ছিল মো: মেহেদী হাসান। তাকে নিয়ে জনাব মেহের আলির আকাশ চুম্বী স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য সন্তানকে একটি ভালো মানের স্কুলেও ভর্তি করিয়ে ছিলেন। তবে আর্থিক সংগতি না থাকায় তার স্বপ্ন যেন অংকুরেই ঝরে যায়। কয়েকমাস সন্তানের স্কুল ফিস বকেয়া পড়ে। নিরুপায় হয়ে ছুটে বেড়ান পারভিন বেগম। একপর্যায়ে আর্থিক দৈন্যতায় স্কুল ছাড়তে হয় শহীদ মেহেদীর। মাত্র তৃতীয় শ্রেণিতে এসে থেমে যায় তার স্কুল জীবন। সোনালী স্বপ্ন যেন মুহূর্তে বিলীন হয়ে যায় মেহের আলীর। অতঃপর নয় বছর বয়সে একটি মেরামত কারখানায় কাজ শুরু করেন মেহেদী। যে হাতে এতদিন কলম ছিল সে হাতে আজ হাতুড়ী। গাড়ীর চাকা মেরামত করার শক্তি না থাকলেও থেমে যায়নি সে। পরিবারের মুখে দু-মুঠো খাবার তুলে দিতে যেন চির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যাত্রাবাড়ী, দক্ষিণ কুতুবখালি, বড় মাদরাসা সংলগ্ন এলাকায় পরিবারের সাথে বসবাস ছিল মেহেদীর। তার বাবা একজন অস্থায়ী পরিচ্ছন্ন কর্মী। এলাকাবাসীর সহযোগিতায় নামমাত্র ৯০০০ টাকা বেতনে ময়লার গাড়ী চালান তিনি। সুখ-দুঃখের যোগফল ধীরে ধীরে বড় হন মেহেদী। পরিবারের দায়িত্বও বুঝে নিতে শুরু করেণ। মা-বাবা, দুই ভাই রমজান ও ইয়াসিন, একমাত্র বোন শ্রাবণী, নানা এবং দাদীকে নিয়ে বেশ বড় একটি পরিবার তাদের। সারাদিন পুরাতন গাড়ির মেরামত কারখানায় কাজ করে বাসায় আসেন শহীদ মেহেদী। সামান্য সময় হাতে থাকলেও তা নষ্ট হতে দেন না। বাবার ময়লার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। মনে মনে ভাবেন, সামান্য অর্থ উপার্জন করতে পারলে প্যারালাইসিস নানার জন্য ঔষধ কিনতে পারবেন। এই ভঙ্গুর পরিবারের হাল ধরতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন মেহেদী। তিন বছর আগেও মেহেদীর মা গৃহ কর্মীর কাজ করতেন। ডায়াবেটিস, বাত ব্যথায় জর্জরিত হয়ে কাজ ছাড়তে হয়েছে তাকে। জীবন যেন কাটছে বেশ মেহেদীর বাবা সারাক্ষণ হতাশায় ডুবে থাকেন। একদিকে সামান্য উপার্জন অন্যদিকে পরিবারে বাড়তি সদস্য সংখ্যা। যার ফলে সন্তানদের মুখে তিনবেলা খাবার জোগান দিতে পারেন না তিনি। অভাবের তাড়নায় অনেক আগে পৈতৃক ভিটে মাটি বিক্রি করেছেন। বর্তমানে স্ব-পরিবারে ২২৬ দক্ষিণ কুতুবখালী বাইতুল আমান রোডে বসবাস করছেন তিনি। তবে যেখানে তারা আছেন সেখানে কোনো সুস্থ মানুষ বসবাস করতে পারে না। সারাক্ষণ দেয়ালের নোনা-চুন খসে পড়তে থাকে। মেঝে থেকে ময়লা পানি নির্গত হয় অবিরত। চারিদিকের দুর্গন্ধে যেন প্রাণ নাশ হওয়ার উপক্রম। তারপরও জীবন তাদের থেমে নেই। মেহেদীর বয়োবৃদ্ধ দাদী রোজ আড়তের পড়ে থাকা সবজী কুড়াতে যান। যা দিয়ে সংসারের দশা না কাটলেও জীবন যেন কাটছে বেশ! অনন্তকালের যাত্রা শুক্রবার, ১৯ জুলাই ২০২৪,দেশে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবী ওঠে। সারাদেশে ছাত্র জনতার ঢল নামে। মুখে মুখে আন্দোলিত হয় স্বৈরাচারের পতনধ্বনি। পরিবারের বাঁধা মাড়িয়ে পরপর দুইদিন আন্দোলনে যোগ দেন মেহেদী। অতঃপর তার বাবা বিষয়টি জানতে পারলে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেন। 'যে আমাদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে তার লাশ আমরা দেব না।' তারপরও মেহেদী নাছোড়বান্দা। বারবার মাকে জানান-ছাত্র ভাইদেরকে পানি খাওয়াতে যাব। তার মা রাজী হন নাই। বাধ্য হয়ে ঘরবন্দী করে রাখার চেষ্টা করেন তার বাবা। তারপরও থামিয়ে রাখা যায়না শহীদ মেহেদীকে। তিনি এই আন্দোলনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তাতে কিছু যায় আসে না। কেননা অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার এই অনুভূতি সার্বজনীন। অবশেষে ছাত্র-জনতাকে পানি খাওয়াতে বের হন মেহেদী। ধীরে ধীরে কুতুবখালী পকেট গেটের দিকে অগ্রসর হন। চারিদিকে পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতারা ব্যাপক গুলি ছুড়তে থাকে। বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা। সময় ‘আনুমানিক সাতটা।’ আচমকা ঘাতকের কয়েকটি গুলি মেহেদীর শরীরে এসে বিদ্ধ হয়। একটি গুলি বুকের বাম পাশ এবং দুইটি গুলি পেট ভেদ করে বের হয়ে যায়। মুহূর্তেই নিথর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। খবর পেয়ে শহীদের বন্ধুদ্বয় নয়ন ও হৃদয় তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। জরুরী বিভাগে পোঁছাতে পৌছাতে ঘড়ির কাটা আটটা-পাঁচ। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক শহীদের নিথর দেহে দ্রুত হৃৎস্পন্দন ও অক্সিজেনের মাত্রা পরিমাপ করে জানায়-“আপনাদের রোগী আর বেঁচে নেই।” তবে লাশ বাসায় আনতে বাঁধে আপত্তি। পুলিশের রোষানলে পড়েন তারা। পুলিশ জানায়-“যে আমাদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে তার লাশ আমরা দেব না”। অনেক অনুনয় বিনয় করে অবশেষে শহীদের লাশ বাড়িতে আনতে সক্ষম হয়। জানাজা শেষে পরবর্তীতে শহীদ মেহেদীকে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। শোকের মাতমে ভাসে পুরো পরিবার। আর বিয়োগান্ত এ-অধ্যায়ের শুরুতো সেখান থেকেই! সামান্য সে পাথেয়’র আশায় বেদনাকাতর অনুভূতি মেহেদীর শাহাদাতে ফলে তার বাবা নিরুপায় হয়ে পড়েন। বাধ্য হয়ে সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যায়নরত মেজ ছেলে রমজানের স্কুল জীবন থামিয়ে দেন। মাত্র পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে আদরের সন্তানকে কারখানায় পাঠান তিনি। একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারিয়ে যেন সব হারিয়েছে পরিবারটি। শহীদ মেহেদীর কথা মনে পড়তেই দুচোখ ভিজে ওঠে মেহের আলীর। মেরুদণ্ডের ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে আবারও ময়লার ভ্যান নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন সামান্য উপার্জনের আশায়। আর্থিক টানাপোড়েনের হিসেব আর কিভাবে কষবে শহীদের দুঃখিনী মা! যেন সর্বদা তার কানে একটি কণ্ঠ ভেসে আসে- ‘মা, আমি আছিতো, তোমার কোনো ভয় নেই।’ হয়তো এই বাক্যটি চিরদিন পরিবারের কাছে স্মৃতিতে অম্লান হয়ে রইবে। শহীদের মামা বলেন- “মেহেদীর সাথে যখন দেখা হত, সবসময় আমাকে সম্মান দিয়ে কথা বলত। নামাজের সময় হলে মসজিদে যেতে বিলম্ব করত না। কারখানার সবাই মেহেদীকে অনেক পছন্দ করত। আফসোস! আমার ভালোবাসার ভাগ্নের জন্য আমি কিছুই করতে পারলাম না। সে আমাকে ছেড়ে চলে গেল। কোনো আত্মীয়-স্বজনের বাসায় যেত না মেহেদী। একবার জোর করে আমার বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। এতটা লাজুক ছিল আমার ভাগ্নে, যে মামীর দিকে তাকিয়েও কথা বলেনি।” শহীদের বন্ধু বলেন- “আমরা অবসরে একসাথে আড্ডা দিতাম। চলাফেরা করতাম। কিন্তু কখনও অন্যায় কাজে মেহেদী আমাদেরকে সাপোর্ট করত না। ও খুব শান্ত স্বভাবের এবং ভালো ছেলে ছিল। আমি সবসময় আমার বন্ধুকে মিস করব।” এক নজরে শহীদের ব্যক্তিগত প্রোফাইল নাম : শহীদ মো: মেহেদী হাসান পেশা : শ্রমিক (গাড়ির চাকা মেরামত কারখানা) জন্ম তারিখ ও বয়স : ১৪ জুলাই ২০০৭, ১৭ বছর শহীদ হওয়ার তারিখ : ১৯ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার, আনুমানিক সন্ধ্যা ৭টা শাহাদাত বরণের স্থান : কুতুবখালী পকেট গেট, যাত্রাবাড়ী দাফন করা হয় : জুরাইন কবরস্থান স্থায়ী ঠিকানা : স্থায়ী নিবাস নেই পিতা : মেহের আলী মাতা : মোসা: পারভীন বেগম ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : জায়গা জমি নেই ভাইবোনের বিবরণ : ১. রমজান, সম্পর্ক: ভাই, বয়স: ১৩ পেশা: শ্রমিক : ২. ইয়াসিন, সম্পর্ক: ভাই, বয়স: ০৯, পেশা: ছাত্র প্রতিষ্ঠান: জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া মাদ্রাসা : ৩. শ্রাবণী আক্তার, সম্পর্ক: বোন, বয়স: ২২ বছর প্রস্তাবনা : ১. শহীদ পরিবারে স্থায়ী নিবাস নেই। পরিবারের বাসস্থান প্রয়োজন । : ২. শহীদের পিতার জন্য কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করে দিলে উপকার হবে । : ৩. শহীদের ছোট ভাইকে লেখা পড়ার খরচ জোগানে সহযোগীতা করা যেতে পারে ।

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of মো: মেহেদী হাসান
Image of মো: মেহেদী হাসান

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

মো: হোসেন

মো: সুমন সিকদার

রাসেল মিয়া

আনোয়ার হোসেন পাটোয়ারী

আবু বকর রিফাত

মো: সোহাগ

হাসিব আহসান

মারুফ হোসেন

আব্দুর রহমান জিসান

মো: নাঈম

আবদুল রাকিব

মো: সাকিল

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo