জন্ম তারিখ: ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮০
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৬ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা :পোল্ট্রী ব্যবসায়ী, শাহাদাতের স্থান: এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
মো. লাল মিয়া, জন্ম ৭ই ফেব্রুয়ারি ১৯৮০। টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর থানার মাঝিরা গ্রামের নিবাসী এই মানুষটি পেশায় পোল্ট্রি ব্যবসায়ী। জীবনের প্রতিটি ধাপে সংগ্রাম, ছোট্ট মুরগির দোকানের আয় দিয়ে অভাবের সংসার চালান তিনি। পিতা মৃত জুলহাস মিয়ার রেখে যাওয়া সংসারের হাল ধরেছেন। মা, আম্বিয়া বেগম, বৃদ্ধা, তার সংসারে যেন নীরব সাক্ষী হয়ে আছেন। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ লাল মিয়ার মনে সমাজের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। অভাব-অনটনের মধ্যেও তিনি গ্রামের প্রতিটি মানুষের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করেন। গ্রামের সবুজ মাঠে তার নিয়মিত পদচারণা যেন প্রকৃতির সঙ্গে তার অটুট সম্পর্কের প্রতীক। সেই চির সবুজ মাঠই যেন তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় আশ্রয়। গ্রামের প্রতিটি গাছ, প্রতিটি ধূলিকণা তাকে ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধে রেখেছে। তিনি জানেন, এই মাটির সঙ্গেই তার জীবনের রচনা। সাধারণ মানুষের জীবনে অসাধারণ গল্প থাকে। লাল মিয়ার জীবনের গল্প তেমনই। যে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি এগিয়ে চলেছেন, তা জীবনের প্রতি তার অদম্য ভালোবাসা এবং সমাজের প্রতি তার গভীর মমতারই প্রতিচ্ছবি। শহীদ পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা শহীদ মোঃ লাল মিয়ার পরিবার এখন চরম দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন। আবাদযোগ্য কৃষি জমির অভাবে, তিনি বিভিন্ন গ্রাম থেকে মুরগি ক্রয় করে ঢাকার বাজারে বিক্রি করতেন। এই সামান্য আয়ের মাধ্যমেই তিনি তাঁর ৬ সদস্যের পরিবারের ভরণ-পোষণ করতেন। কিন্তু তাঁর শাহাদাতের পর, পুরো পরিবার যেন এক অন্ধকারের মধ্যে ডুবে গেছে। লাল মিয়ার স্ত্রী আলপনা এখন দুই মেয়ে, এক ছেলে এবং ৭০ বছরের বৃদ্ধ শাশুড়িকে নিয়ে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু তাদের জীবন থেকে সমস্ত নির্ভরতা কেড়ে নিয়েছে। আলপনা শারীরিকভাবে অসুস্থ, তাই পরিবারের দায়িত্ব পালন করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বৃদ্ধা শাশুড়ি একা হয়ে গেছেন, তাঁকে দেখাশোনা করার কেউ নেই। সন্তানদের ভবিষ্যৎও আজ অনিশ্চিত। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে প্রতিদিনের খাবারও যেন দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। একদিকে সন্তানেরা ক্ষুধার্ত, অন্যদিকে বৃদ্ধা মায়ের দুঃসহ কষ্ট; সবকিছু মিলিয়ে আলপনার জীবনে যেন এক অমানিশার অন্ধকার নেমে এসেছে। তাদের এই দুর্দশা কারো সহানুভূতি না পেলে খুব শিগগিরই হয়তো বেঁচে থাকা দুরূহ হয়ে পড়বে। শহীদ লাল মিয়া সম্পকে অনুভতি: শহীদ লাল মিয়াকে ঘিরে যে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বিরাজমান, তা কেবল তার পরিবার বা বন্ধুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ছড়িয়ে পড়েছে এলাকাবাসীর হৃদয়ে। লাল মিয়া ছিলেন এক শান্ত, সদালাপী ও পরিশ্রমী, যার প্রতিটি কাজ এবং আচরণ তাকে সবার কাছে প্রিয় করে তুলেছিল। পরিবারের প্রতি তার দায়বদ্ধতা এবং সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তাকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ছোট্ট একটি ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করলেও, লাল মিয়া সবসময়ই বৃহত্তর কল্যাণ এবং সামাজিক ন্যায়ের প্রতি নিজের দায়িত্ব অনুভব করতেন। এই দায়িত্ববোধ থেকেই তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেন, যার কারণে তার জীবন থমকে গেল। কিন্তু তার আত্মত্যাগ একদিকে যেমন পরিবারকে শোকাহত করেছে, অন্যদিকে অনুপ্রাণিত করেছে সমাজকে। পরিবারের এই গভীর শোকের মাঝে লাল মিয়ার আত্মত্যাগের মূল্য তাদের কাছে এক অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। লাল মিয়ার বন্ধুরা স্মরণ করে বলেছেন, তিনি ছিলেন এক আদর্শবান মানুষ, যার মূল্যবোধ এবং কাজকর্ম সকলকে অনুপ্রাণিত করেছে। তার এই শাহাদাত শুধু তাদের ব্যক্তিগত জীবনে নয়, বরং তাদের নৈতিকতাকেও দৃঢ় করেছে। এলাকার মানুষের চোখে লাল মিয়ার আত্মত্যাগ দেশের জন্য এক মহান ত্যাগ। তাদের বিশ্বাস, লাল মিয়ার মতো বীর সমাজের পরিবর্তনের সূচনা করেন। তাদের সাহসিকতা এবং আত্মত্যাগ সমাজকে একটি নতুন দিকনির্দেশনা দেয়। মধ্যবয়স্ক লাল মিয়ার প্রতিবেশী, গভীর শ্রদ্ধায় বলেন, “লাল মিয়া নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন, এবং সকলকে নামাযে ডাকতেন। তিনি শান্ত, ভদ্র এবং সহযোগিতাপূর্ণ ছিলেন। কখনো কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করতেন না। লাল মিয়ার মৃত্যুতে এলাকাবাসী যেমন শোকাহত, তেমনি তার এই আত্মত্যাগে তারা গর্বিত। তারা মনে করে, লাল মিয়ার মতো সাহসী ত্যাগেই সমাজে সত্যিকার পরিবর্তন আসে, আর তাদের এই বলিদানই ভবিষ্যতের আলো হয়ে জ্বলবে। যেভাবে শহীদ হলেন শহীদ মোঃ লাল মিয়ার জীবন ছিল সংগ্রামের প্রতীক। যার শেষ অধ্যায়টি লেখা হলো এক নির্মম বিদায়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন দেশে বিক্ষোভের আগুন জ্বালালো, লাল মিয়া তাতে শরিক হন শুধুমাত্র একজন ব্যবসায়ী হিসেবে নয়, বরং একজন ন্যায়পরায়ণ নাগরিক হিসেবে। দুর্নীতি, অপশাসন, গুম-খুনের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠ ছিল বলিষ্ঠ। তিনি স্বাধীন দেশের জন্য লড়াই করেছিলেন, অথচ স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ বুঝে ওঠার আগেই তাঁকে এই পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিতে হলো। ২০২৪ সালের ৪ঠা আগস্ট, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অসহযোগ কর্মসূচি চলছিল দেশব্যাপী। সাভারের বাইপাইল মোড়ে আন্দোলনকারীরা যখন প্রতিরোধের বুলন্দ আওয়াজ তুলছিল, তখন লাল মিয়া তাঁর দৈনন্দিন দায়িত্ব পালন করে ঢাকার বাজার থেকে মুরগি বিক্রি শেষে টাঙ্গাইলের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় পায়ে হেঁটে বাইপাইল মোড়ে পৌঁছালে, হঠাৎ করেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলির শব্দে মুহূর্তেই সবকিছু থমকে যায়। লাল মিয়া তখন বুঝতে পারেননি, এটাই হবে তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত। বিকাল ৪টার দিকে একটি গুলি তাঁর তলপেটে আঘাত করলে তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সবুজ ঘাস রঞ্জিত হলো লাল রক্তে। সেখানকার স্থানীয় লোকজন তাকে তৎক্ষণাৎ সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা অন্য কিছু ছিল। দুইদিন পর, ৬ আগস্ট ২০২৪ সালে বিকাল ৫টায়, তিনি চিকিৎসাধীন। অবস্থায় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেন। লাল মিয়ার মৃত্যু শুধু তাঁর পরিবারের জন্য নয় বরং পুরো জাতির জন্য এক অশ্রুসিক্ত বেদনার গল্প। যাঁর কণ্ঠস্বর ছিল দুর্নীতি, গুম, এবং হত্যার বিরুদ্ধে, যিনি ছিলেন এক দফা আন্দোলনের এক বলিষ্ঠ সৈনিক, সেই কণ্ঠস্বর আজ চিরতরে নীরব হয়ে গেছে। এই নীরবতা এক অশুভ সময়ের প্রতীক, যেখানে স্বপ্ন দেখার আগেই স্বপ্নচুর্ণ হলো, যেখানে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে চাওয়া মানুষটিও আর ফিরলো না তাঁর গ্রামে। লাল মিয়ার মৃত্যুতে তাঁর স্ত্রী আলপনা, দুই মেয়ে, এক ছেলে এবং বৃদ্ধা মায়ের জীবনে যেন এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হলো। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো দেশের দুর্নীতির অন্ধকারেও আলোর দ্বীপ জ্বালাতে পারতেন, কিন্তু তিনি শহীদের মর্যাদা নিয়ে অমর হয়ে থাকলেন ইতিহাসের পাতায়। এক নজরে শহীদ মো: লাল মিয়া নাম : মো: লাল মিয়া জন্মসাল : ০৭-০২-১৯৮০ পেশা : পোল্ট্রী ব্যবসায়ী স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা : গ্রাম: মাঝিরা, ইউনিয়ন: মাঝিরা, থানা: মধুপুর, জেলা: টাঙ্গাইল পিতার নাম : মৃত জুলহাস মিয়া মাতার নাম : আম্বিয়া বেগম, বৃদ্ধা মাসিক আয় : ১০০০০/- আয়ের উৎস : মুরগীর দোকান পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ০৫ ছেলেমেয়ের সংখ্যা : ০৩ ১) লামিয়া আক্তার, বয়স: ২০ বছর, বিবাহিতা, সম্পর্ক-মেয়ে ২) ননিয়া আক্তার, বয়স: ১৫, শিক্ষার্থী-হেদায়া, সম্পর্ক-মেয়ে ৩) মো: আহাদ, বয়স: ১২, শিক্ষার্থী-নূরানী, সম্পর্ক-ছেলে ঘটনার স্থান : সাভার বাইপাইল মোড় আক্রমণকারী : ঘাতক পুলিশ আহত হওয়ার সময়কাল : তারিখ: ০৪ আগস্ট ২০২৪, বিকাল ০৪ টা নিহত হওয়ার সময়কাল : ০৬ আগস্ট ২০২৪ বিকাল ৫ টা, এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কবরস্থান : পারিবারিক কবরস্থান, টাঙাইল প্রস্তাবনা ১. ছোট ছেলে-মেয়ের লেখা-পড়ার খরচ এবং বৃদ্ধা মায়ের ভরণ পোষণ যোগানে সহযোগিতা করা যেতে পারে