জন্ম তারিখ: ১২ এপ্রিল, ২০০৫
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা :ছাত্র, শাহাদাতের স্থান :আশুলিয়া থানার সামনে।
যেদিন তুমি এসেছিলে ভবে, কেঁদেছিলে তুমি হেসেছিলো সবে। এমন জীবন তুমি করিও গঠন মরিয়া হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভূবন। -কাজী নজরুল ইসলাম বাবা মায়ের মুখ আলোকিত করে ২০০৫ সালের ১২ এপ্রিল গাইবান্ধা জেলার আশুলিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত শ্যামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন একটি নবজাতক। প্রথম সন্তান এবং পুত্র হওয়ায় বাবা খুশিতে আত্মহারা হয়ে নাম রাখেন সাজ্জাদ হোসেন সজল। বাবা খলিলুর রহমান এবং মমতাময়ী মা শাহীনা বেগম গভীর যত্নে লালন পালন করেন তাদের ৩ সন্তানকে। তারা সকলেই পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী। বড়ছেলে সজল সিটি ইউনিভার্সিটির টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রথম র্বষের শিক্ষার্থী ছিলেন। সে খুবই নম্র ভদ্র এবং পরোপকারী ছেলে। সমাজের সবার বিপদে আপদে আগে ছুটে যেতেন তিনি। তাছাড়া সজল ছিলেন খুবই ধর্মপ্রাণ এবং নিয়মিত নামাজ পড়তেন। যেভাবে শহীদ হলেন জুলাই, ২০২৪ জুড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সারাদেশ ছিল উত্তাল। আর এই আন্দোলনে শুরু থেকেই সাজ্জাদ হোসেন সজল ছিলেন সরব। তিনি মুখ বুঝে বসে না থেকে আন্দোলনের শুরু থেকে নানাভাবে সাহায্য করতেন। তিনি ভাবতেন, সরকার যেন এই কোটা সংস্কারের মাধ্যমে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মেধাবীদের চাকরি পাওয়ার পথ সুগম করেন। তারও ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা শেষ করে বড় সরকারী কর্মকর্তা হওয়ার, যাতে তিনি দেশের মানুষের সেবা করতে পারেন। পরবর্তীতে এই আন্দোলন যখন সরকার পতনের দিকে ধাবিত হলো তখন সজল আরো সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে যুক্ত হলেন দেশের মানুষকে স্বৈরাচারী সরকার থেকে বাঁচাতে। এই আন্দোলনের জের ধরেই ৪ আগস্ট রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ছাত্র জনতার বিক্ষোভ মিছিলে হামলা চালায় আওয়ামী সন্ত্রাসী। এদিন পুলিশের সাথে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ছাত্রদের গুলি করে। কিন্তু হাজার হাজার ছাত্র ইট-পাটকেল দিয়ে সন্ত্রাসী ও হানাদার পুলিশ বিজিবিকে প্রতিরোধ করে। এরমধ্যে কয়েকটি স্থানে সেনাবাহিনীও গুলি করে। একইসাথে এইদিনে সারাদেশে ১৩০ জন খুন হন। এর মধ্যে ছাত্রলীগ, পুলিশ ও যুবলীগেরও কিছু সদস্য রয়েছে। লাখো ছাত্ররা এদিন সন্ত্রাসীদের অনেককে ভালোভাবে উত্তম-মধ্যম দেয়। পরদিনই ঢাকামুখী লং-মার্চের কর্মসূচি দেয় ছাত্র-জনতা। অত:পর আসে সেই কালজয়ী ৫ আগস্ট। এইদিন সকল দেশবাসীর কাছে খুশির হলেও সজল পরিবারের কাছে এটি একটি অভিশপ্ত দিন। এদিন সকাল থেকেই ব্যাপক মারমুখী অবস্থান নেয় পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় খন্ড খন্ড যুদ্ধ শুরু হয় ছাত্র জনতার সাথে। একইসাথে সকাল সাড়ে দশটার পর সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে স্বৈরাচার হাসিনা পালিয়ে যায় ভারতে। কিন্ত কর্মরত পুলিশরা এই খবর না জানিয়ে তারা সাধারণ জনতার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। অবিচারে অনেক মানুষকে তারা খুন করতে থাকে। এই ৫ আগস্ট সকাল ১১টায় বাসা থেকে বের হয় সজল। তার মা সেদিন হাসপাতালে ডিউটিতে ছিল। জরুরী বিভাগে যখন অনবরত গুলিবিদ্ধ রোগী আসছিল, তখন বারবার সজলকে ফোন করে ঘরে ফিরে যেতে বলছিলেন তিনি । সজল মাকে বলে, আম্মু, তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? অন্য ছেলেমেয়েদের তোমার নিজের সন্তান মনে হয় না? আমাদের এখানে তিন-চারজন অলরেডি মারা গেছে। তুমি কেন স্বার্থপরের মতো আমাকে বাসায় ডাকো? এক সন্তান মারা গেলে তোমার পাশে হাজার সন্তান দাঁড়াবে।' ছেলে হারানোর চাপা বেদনা নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন নিহত সাজ্জাদ হোসেন সজলের মা শাহিনা বেগম।তিনি বলেন, 'সর্বশেষ বিকেল পৌনে ৩ টার দিকে সজলের সঙ্গে কথা হয়। তখন সজল জানায়, আম্মু এখানকার (আশুলিয়ার বাইপাইল) পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আমি যদি শহীদ হই, তাহলে আমার প্যান্টের পকেটে ইউনিভার্সিটির কার্ড আছে, কার্ড দেখে আমার লাশটি চিনে নিয়ে যেও। আল্লাহ সজলের সেই কথাটাই কবুল করলেন। তারপর প্রায় ১টার দিকে মানুষ জেনে যায়, হাসিনা পালিয়ে গেছে। শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে শোনার পর সজলকে ফোন দিয়েছিলেন মা শাহিনা বেগম। কিন্তু তখন তিনি ফোন কেটে দেয়। এরপর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। রাতে সজলের মা-বাবা সাভার ও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজাখুঁজি করেও ছেলের সন্ধান পাননি। রাত ৩ টার দিকে কেউ সাজ্জাদ হোসেন সজলের সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে। এরপর একজন খবর দেয় আশুলিয়া থানার সামনে সাত-আটজন আন্দোলনকারীর লাশ পুড়িয়ে দিয়েছে পুলিশ। পরদিন (৬ আগস্ট) সকালে আশুলিয়া থানার সামনে যান সজলের মা-বাবা। সেনাবাহিনীর সদস্যরা তখন সজলের আইডি কার্ড হাতে নিয়ে পরিবারের সদস্যদের খোঁজ করছেন। পরে আইডি কার্ড দেখে তাঁর লাশ শনাক্ত করা হয়। ছেলের পোড়া অঙ্গার দেহ দেখে মা বিলাপ করতে থাকেন। সারাদেশের বিশেষভাবে রাজধানীর মানুষ সব রাস্তায় নেমে নেচে গেয়ে উদযাপন করতে থাকে। গলিতে গলিতে মিষ্টি বিতরণ ও ঈদ মোবারক বলে কোলাকুলি করতে থাকে মানুষ। রাস্তায় রাস্তায় মানুষ সিজদা দিয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করতে থাকে। কিন্তু সেই মুক্ত দেশের মুক্তির আনন্দ উপভোগ করতে পারেননি শহীদ সাজ্জাদ হোসেন সজল। তারই জন্য কবি হয়তো লিখেছিল- "উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই নিঃশেষে প্রান যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।" -কাজী নজরুল ইসলাম কেমন আছে শহীদের পরিবার শহীদ সাজ্জাদ হোসেন সজলের পরিবারের সাভারের জামগড়ায় ১৮ শতক জমির উপর টিনশেড বাড়ি আছে। অর্থনৈতিক অবস্থা মোটামুটি ভালো। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে মা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে এবং বার বার মুর্ছা যাচ্ছে। কেননা প্রথম মা ডাক যে তার কাছে থেকেই শোনা। শোকে কাতর তার ছোট বোন দুটোও। বাড়ির সমস্ত আঙ্গিনা জুড়ে তারা সজলের স্মৃতি দেখতে পায়। পাড়াপড়শিরা তাদের বিপদে পাশে থাকার বন্ধুকে হারিয়ে শোকে কাতর। জীবন শুরু হওয়ার আগেই হারিয়ে গেলো সম্ভাবনাময় একটি নিষ্পাপ প্রাণ। এজন্যই ইংরেজ কবি হয়তো লিখেছিলেন “গধহু ধ ৎড়ংব রং নড়ৎহ ঃড় নষঁংয ঁহংববহ” প্রতিবেশি ও স্বজনদের অনুভুতি কর্মের কারণে পৃথিবীতে মানুষ অমর হয়। মানুষ চলে গেলে ও থেকে যার তার কর্ম। তেমনি মৃত্যুর পরেও শহীদ সাজ্জাদ হোসেন সজল অমর। এলাকাবাসীর মুখে মুখে আজও তার সম্পর্কে বন্দনা। শহীদ সজল সম্পর্কে তার এক প্রতিবেশী শেখ নেয়াজ বলেন- “খুব মানবিক, ভদ্র ও নম্র ছিলো সে। পরিবারে বড় সন্তান হিসেবে অনেক দায়িত্বশীল ছিল। সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে পছন্দ করতো সে।” তার ফুফাতো ভাই বলেন-“সজল নামাজী ছিলেন এবং সে অত্যন্ত নম্র ভদ্র একটা ছেলে ছিলেন।” সজল সম্পর্কে জানতে চাইলে তার আরেক প্রতিবেশী ভাই আরও বলেন- “তার ভেতরে প্রবল মনুষত্ব্য ছিলো। সে অন্যের বিপদকে নিজের মনে করে সবার আগে ছুটে যেতো।” সর্বোপরি মহৎ হৃদয়ের মানুষেরা বুঝি এমনই হয়, মহাকাল তাদেরকে অমর করে রাখে। তেমনি সাজ্জাদ হোসেন সজলের মতো মহৎ মানুষেরা পৃথিবীতে আসে স্বল্প সময়ের জন্য কিন্তু ফেলে রেখে যায় দীর্ঘ পদচিহ্ন। দেশের ক্রান্তিলগ্নে তাঁর এই অবদান জাতি আজীবন মনে রাখবেন। মহান আল্লাহ তাঁর শাহাদাতকে কবুল করে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন (আমিন)। এক নজরে শহীদ সাজ্জাদ হোসেন সজল নাম : সাজ্জাদ হোসেন সজল পেশা : ছাত্র জন্ম তারিখ ও বয়স : ১২/০৪/২০০৫, ১৯ বছর প্রায় আহত ও শহীদ হওয়ার তারিখ : ৫ আগস্ট ২০২৪, সোমবার শাহাদাত বরণের স্থান : আশুলিয়া থানার সামনে স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: শ্যামপুর, থানা/উপজেলা: , জেলা: গাইবান্ধা পিতা : খলিলুর রহমান মাতা : শাহিনা বেগম ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবস্থা : সাভারে জামগড়ে ১৮ শতক জমির উপর টিনশেড বাড়ি আছে। মোটামুটি সচ্ছল পরিবার ভাইবোনের বিবরণ : ছোট দুই বোন রয়েছে বড় বোন : খাদিজা ফেরদাউসী (বয়স-১৩, অষ্টম) ছোট বোন : আদিবা আশ দিয়া (বয়স-১) শহীদ পরিবারকে সাহায্যের প্রস্তাবনা ১. বাবার জন্য কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করে দিলে উপকার হবে। ২. ছোট বোনদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দেয়া যেতে পারে। ৩. মানসম্মত বাসস্থানের ব্যাবস্থা করা যেতে পারে।