Image of মো: মেহেদী হাসান

নাম: মো: মেহেদী হাসান

জন্ম তারিখ: ১০ জানুয়ারি, ২০০১

শহীদ হওয়ার তারিখ: ২০ জুলাই, ২০২৪

বিভাগ: ঢাকা

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা : রাজমিস্ত্রী, শাহাদাতের স্থান : এনাম মেডিকেল হাসপাতাল

শহীদের জীবনী

একজন মুসলিম, একজন সন্তান, একজন পিতা, একজন শহীদ মো: মেহেদী হাসান এর জীবন যোগ্য ও অসাধারণ এক সন্তানের এক অতি সাধারণ গল্প। এমন এক সন্তান যার কথা মনে হতেই বাবার বুক প্রশান্তিতে ভরে যায়। চোখে সন্তান হারানোর বেদনা, মুখে সন্তানের শহীদি মৃত্যু পাওয়ার আনন্দের হাসি। শত কষ্টের মাঝেও যে হাসি অমলিন। এই কৃতি সন্তান ২০০১ সালের ১০ জানুয়ারি নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা থানার রংছাতি ইউনিয়নের সন্ন্যাসীপাড়া গ্রামে বাচ্চু সরকার ও জাহানারা বেগম দম্পত্তির এক অতি দরিদ্র কিন্তু প্রশান্তিময় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নদীর পাড়ে ছিলো তাদের শান্তির নীড়। কিন্তু বাংলাদেশের আরো অনেক নদীর মতো মহাদেও নদীর বাঁধ মানে না। পাতলাবন মহাদেও নদী, রংছাতি, কলমাকান্দা। মহাদেও নদীটি ভারতের মেঘালয় রাজ্য হতে প্রবাহিত। অত্যন্ত খরস্রোতা এই নদী। সে তার নিজের ইচ্ছা মত যেদিক দিয়ে খুশি সেদিক দিয়েই প্রবাহিত হয়। বর্ষার স্রোতে পাড়ে ভাঙন ধরে। সেই ভাঙনে বাচ্চু সরকার ও জাহানারা দম্পতির বাড়ি ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে যায়। ততদিনে তাদের ঘর আলো করে আরো দুই ছেলে মিজানুর রহমান ও রাকিবের জন্ম হয়। পেটের তাগিদে তারা সপরিবারে ঢাকায় পাড়ি জমান। সেখানে বাচ্চু সরকার একটা ছোট চায়ের দোকান দেন। বাচ্চু সরকার ছিলেন প্রচণ্ড আল্লাহ ভীরু। তাই ছোট থেকে তার তিন ছেলেকে রাসূল (সা:) এর আদর্শে বড় করতে থাকেন। মানুষের মতো মানুষ করে গড়তে থাকেন তিন সন্তানকে। সবার বড় ছিলেন মেহেদী হাসান। তাকে হাফেজি পড়ান। পরবর্তীতে তাকে মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাসকৃত ঝর্ণার সাথে বিবাহ দেন। সেই ঘরে তাদের কোল আলো করে এক ছেলের জন্ম হয়। যার নাম রাখেন তারা আবু হুজাইফা। আবু হুজাইফার বয়স বর্তমানে ২.৫ বছর। মেহেদী হাসান তার বাবার যোগ্য সন্তান। বাবার কাছে থেকে যে জ্ঞান বুদ্ধি পেয়েছেন, জীবনের যে শিক্ষা পেয়েছেন তা অতুলনীয়। বাবার সাথে বেড়ে ওঠার ফলে সেখান থেকেই নৈতিক ভিত্তি গড়ে ওঠে। মানুষের আনন্দে আনন্দিত হওয়া, অন্যের দুঃখে ব্যথিত হওয়া এসব মানবিক দিক গুলো তার ভেতর গড়ে ওঠে। তার আদর্শ বাবার কাছে তাই আজ সেও এক আদর্শ। সে সুধু তার ভাই বা ছেলের কাছে এখন আদর্শ নয়, সে গোটা জাতির কাছে এক শ্রদ্ধার পাত্র। অর্থনৈতিক অবস্থা মেহেদী হাসান হিফজ পড়াশোনা করেন। কিন্তু দারিদ্রের কষাঘাতে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারেননি। বাবার চায়ের ছোট্ট দোকানের পাশাপাশি সংসার চালানোর জন্যে তাকে রাজমিস্ত্রী কাজ শুরু করতে হয়। তাদের মূল বাস্তুভিটা ময়মনসিংহের কলমাকান্দা থানার সন্ন্যাসীপাড়া গ্রামে মহাদেও নদীর স্রোতের তোড়ে বিলীন হয়ে যায়। সেখানে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। করোনাকালীন সময়ে আর্থিক অস্বচ্ছলতার জন্য তার মেজো ভাই মিজানুর রহমানকে সপ্তম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়ে পড়ালেখা ছেড়ে বাবার সাথে দোকানের হাল ধরতে হয়। ছোট ভাই রাকিব বর্তমানে প্রাইমারিতে পড়াশোনা করেন। তার বয়স ১৪ বছর। মেহেদী হাসান বিবাহিত ছিলেন এবং তার ২.৫ বছর বয়সী একটা ছেলে সন্তান আছে। স্বামীর অবর্তমানে স্ত্রী ঝর্ণা খুব কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। বাচ্চু সরকারের একার পক্ষে এত বড় সংসার চালানো অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে উঠেছে। না তারা সন্তানের শোক ঠিকমতো পালন করতে পারছে, না তারা সংসার চালাতে পারছে। ঘটনার প্রেক্ষাপট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থান বা জুলাই গণঅভ্যুত্থান বলতে বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন ২০২৪ ও অসহযোগ আন্দোলন ২০২৪-এর সমন্বিত আন্দোলনকে বোঝানো হয়। ২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারি করা পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণার পর কোটা সংস্কার আন্দোলন নতুন করে শুরু হয়, এই আন্দোলনে তৎকালীন শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার দমন নিপীড়ন শুরু করলে এটি অসহযোগ আন্দোলনে রূপ নেয়। কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা বিক্ষোভের পর ১৫ জুলাই বিক্ষোভকারী ও ছাত্রলীগের সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষের পর উত্তেজনা বেড়ে যায়। এর পরের দিনগুলোতে, পুলিশ , র‌্যাব , বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্র, যুব ও স্বেচ্ছাসেবক শাখার সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সহিংস সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এই সংঘর্ষের ফলে বিক্ষোভকারী এবং শিশু সহ অসংখ্য মৃত্যু হয়েছে। এমনি এক আন্দোলনকারী ছিলেন মেহেদী হাসান। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে তার বিবেক তাকে ঘরে বসে থাকতে দেয়নি। হাজারো পিছুটান থাকা সত্ত্বেও তিনি তার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের সাথে ছাত্র জনতার পক্ষে রাস্তায় নামেন। ১৮ জুলাই ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করার পর দেশে তীব্র ‘ক্র্যাক ডাউন’ শুরু হয়। পুলিশ, র‌্যাব, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং হাসিনা সরকারের দোসর বাহিনী সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্র জনতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২০ জুলাই, শনিবার দেশজুড়ে কারফিউ, সেনা মোতায়েনের মধ্যেও যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, বাড্ডা ও মিরপুর এলাকায় চলে সংঘর্ষ, ধাওয়া ও গোলাগুলি। সোমবার ২০ জুলাই সকালে কারফিউ চলাকালীন সময়ে কাজে যোগ দিতে বাসা থেকে বের হয় মেহেদী হাসান। কাজ শেষে ফেরার পথে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হয় ও এলোপাথারি গুলিবর্ষণের মাঝে পড়ে যায়। সেখানে তার গালে একটা গুলি লাগে। তার বন্ধু আরও কয়েকজনকে ডেকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নেওয়ার উদ্দেশ্যে রিকশা খুঁজতে খুঁজতে আমিন টাওয়ারের সামনে আসে। সেখানে তারা আবার পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের যৌথ গোলাগুলির সম্মুখীন হয়। তাই তাকে সেখানে রেখেই বাকিরা নিরাপদ দূরত্বে জীবন নিয়ে পালান। সেখানে মেহেদীকে আবার নড়াচড়া করতে দেখে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী আবার দুই রাউন্ড গুলি করে যার একটা তার মাথায় আর আরেকটা তার ঘাড়ে লাগে। তারপর পরিবেশ কিছুটা শান্ত হলে তার বন্ধু দ্রুত এনাম মেডিকেলে নিয়ে যায় তাকে। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার ইসিজি করে রাত ৭:৪৫ টায় তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তাকে দ্রুত কবর দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের লোকজন চাপ দেয় ও তাদেরকে জামায়াত শিবিরের ট্যাগ লাগিয়ে নিজ এলাকা নেত্রকোনা নিতে ও কবর দিতে দেয় না। ফলে তাকে তার বাবা বাড্ডা কবরস্থানে দাফন করেন। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়দের অনুভূতি শহীদের পিতা: আমার ছেলে আজ পর্যন্ত আমার মুখের উপর একটা কথাও বলেনি। এমন সন্তান আল্লাহ আমাকে দিয়েছিলেন যা মানুষ চেয়ে পায় না। আমার তেমন কিছুই নেই। কিন্তু আমার ছেলের মুখের দিকে তাকালে, কথা বললে যে শান্তি পেতাম তার তুলনা নেই। ছেলে আমার স্বল্পভাষী, কখনো কোনো বাজে ছেলেদের সাথে মিশতো না। তার কোন খারাপ রিপোর্ট কেউ দিতে পারবে না। কোনো বাজে নেশা ছিল না। আমার তিন ছেলের মধ্যে খুব মিল। আমাকে বলত "আব্বু আমাদের জন্য তো অনেক করেছেন। আপনার ছেলে এখন বড় হয়েছে। আমিই এখন থেকে সংসারের দেখাশোনা করবো। আপনাকে আরামে রাখবো।" আমি বেঁচে থাকতে আমার এরকম জোয়ান ছেলে মারা গেলো। অন্তর তো শান্ত হয়না বাবা। এটুকুই শান্তনা যে আমার ছেলেটা আল্লাহর ইচ্ছায় তার রাস্তায় মারা গেছে। আমি নাতিটার সামনে দাঁড়াতে পারি না। বাবাকে চায়। শেষবার ওর বাবাকে খাটিয়াতে দেখেছিল। তাই মনে করে বাবা খাটিয়াতে থাকে। আমাকে নিয়ে যেতে বলে। কয়েকদিন আগে আমাদের কলোনীর একজন মারা গেছে। তাকে খাটিয়াতে দেখে বাবা মনে করেছে। সবাইকে কেঁদে কেঁদে বলেছে ওর বাবার কাছে দিয়ে আসতে। আমি এগুলো কিভাবে মেনে নেব। এতটুকু ছেলে কয়েকদিনে দুনিয়া বুঝে গেছে। সব বোঝে এখন। শহীদের ভাই: আমার ভাই আমাদের জান ছিল। আমাদের যে কত ভালবাসতো বোঝাতে পারবো না। আব্বার পরেই আমরা ওনাকে দেখতাম। আমাদের যাতে একটু কম কষ্ট হয় এটা চেষ্টা করতেন। কখনো তার সঙ্গে মনমালিন্য হত না। এখন তার অবর্তমানে সবকিছু খালি খালি লাগে। শহীদের স্ত্রী: উনি কখনও আমার সঙ্গে উচ্চবাচ্য করতেন না। তার মতো মানুষ খুব কমই হয়। ইচ্ছা করলেও তার খারাপ বের করা কঠিন। আমার সুখের সংসারটা আজ শেষ হয়ে গেছে। আমার এই ছেলেই এখন আমার সম্বল। এক নজরে শহীদের ব্যক্তিগত তথ্য নাম : মো: মেহেদী হাসান জন্ম : ১০/০১/২০০১ পেশা : রাজমিস্ত্রী মাসিক আয় : ১০,০০০ স্হায়ী ঠিকানা : গ্রাম: সন্নাসীপাড়া, ইউনিয়ন: রংছাতি, থানা:কলমাকান্দা, জেলা: নেত্রকোনা বর্তমান ঠিকানা : বাসা/ মহল্লা: ডি/৩১,সিতার নোয়াদ্দা, এলাকা: সাভার, থানা: সাভার, জেলা: ঢাকা পিতার নাম : মো: বাচ্চু সরকার পেশা : দোকানদার মাতার নাম : জাহানারা বেগম পেশা : গৃহীনি পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ৬ জন বাবা (বাচ্চু সরকার), মা (জাহানারা বেগম), মেজ ভাই (মিজানুর রহমান, ১৮), ছোট ভাই (রাকিব, ১৪), স্ত্রী (ঝর্ণা), ছেলে (আবু হুজাইফা, ২.৫) ঘটনার স্থান : সাভার আক্রমনকারী : পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ আহত হওয়ার সময়কাল : তারিখ : ২০/০৭/২৪ ইং, সময় : বিকেল :৬:০০ ঘটিকা মৃত্যুর তারিখ ও সময় স্থান : ২০/০৭/২৪ ইং, সময়: রাত: ৭:৪৫ ঘটিকা, এনাম মেডিকেল হাসপাতাল শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : বাড্ডা কবরস্থান প্রস্তাবনা ১. শহীদের পরিবারকে এককালীন আর্থিক অনুদান প্রদান ২. নিয়মিত মাসিক ভাতা প্রদান ৩. বাসস্থান করে দেয়া ৪. শহীদের ভাইয়ের পড়াশুনার খরচ চালিয়ে যাওয়া ৫. পরিবারের চিকিৎসার যাবতীয় খরচ বহন করা

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of মো: মেহেদী হাসান
Image of মো: মেহেদী হাসান
Image of মো: মেহেদী হাসান
Image of মো: মেহেদী হাসান

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

আব্দুল গণি

তাওহিদ  সন্যামাত

শফিকুল ইসলাম

হযরত বিল্লাল

একরামুল হক সাজিদ

আহনাফ আবির আশরাফুল্লাহ

মো: রাসেল মাহমুদ

মাহবুবুর রহমান সোহেল

মো: সাগর আহম্মেদ

 মো: তাজুল ইসলাম

মো: অহিদ মিয়া

মো: কবির

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo