জন্ম তারিখ: ১ ফেব্রুয়ারি, ২০০০
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৯ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা : গার্মেন্টস কর্মী, শাহাদাতের স্থান : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
সংগ্রাম যার নীতি, আমৃত্যু কষ্ট যার সঙ্গী, শহীদি মৃত্যু যার সত্যতা নাজমুল মিয়া ১ ফেব্রুয়ারি ২০০০ সালে গাইবান্ধা জেলার কামাড়পারা থানার সাদুল্লাপুর ইউনিয়নের নুরপুর গ্রামের মৃত হামিদুল ইসলাম ও গোলেভান বেগম দম্পত্তির অতি দরিদ্র ও সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হামিদুল ইসলাম ছিলেন একজন দিনমজুর। তিন ভাইবোনের মধ্যে নাজমুল ছিলেন সবার বড়। বড় বোন হিরামনি আর ছোট বোন আয়েশা ছিল তার চোখের মনি। নাজমুল ছিলো এক সপ্নদ্রষ্টা স্বাধীনচেতা ছেলে। নিজের দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত জীবন সে পরিবর্তন করতে চেয়েছিল। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। বসতভিটা ছাড়া আর কোনো জমিজমা না থাকায় বাবা মারা যাওয়ার পর যখন সংসারের ভার তার উপর এসে পড়ে তখন সেই ছোট্ট নাজমুল যেন অকুল পাথার দেখে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর নাজমুলকে বাধ্য হয়ে পরিবারকে সাহায্য করার জন্য পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়। তার নিজের ভবিষ্যতের স্বপ্ন ত্যাগ করে ঢাকার একটি গার্মেন্টসে (ক্যাপ ফেক্টরি) চাকরি নেন, যেখানে অমানবিক পরিশ্রমের বিনিময়ে সামান্য বেতনে কাজ করতেন। তার একমাত্র ইচ্ছা ছিল, পরিবারের দুঃখ-কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব করা, মা-বোনের মুখে হাসি ফোটানো। ঢাকার সাভারের আশুলিয়া থানার জামগড়া এলাকার শিমুলতলা মহল্লায় একটা ছোট বাসা ভাড়া নিয়ে থাকত। নিজের প্রয়োজনের তুলনায় পরিবারের জন্যই বেশি অর্থ পাঠাতেন। এই কঠিন জীবনের মধ্যেও শিক্ষার প্রতি তার ভালোবাসা অটুট ছিল। একজন কর্মী হিসেবে তার জীবন ছিল বাস্তবতার কষাঘাতে ভরা, কিন্তু তবু তিনি সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন লালন করতেন। দারিদ্র্যের কষ্ট, কঠোর পরিশ্রম, আর পরিবারের প্রতি গভীর ভালোবাসা তাকে একটি বাস্তবিক জীবন সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক করে তুলেছিল। বোনদের বিয়ে দিয়েছিল। কথা ছিল মায়ের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে নিজের সুখের নীড় গড়বেন। কিন্তু দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে তিনি ছাত্র-জনতার পক্ষে রাস্তায় না নেমে পারেননি। বাবার সঙ্গ সে বেশিদিন না পেলেও বাবা ছিলেন তার আদর্শ। বাবার কাছে থেকেই শিখেছিলেন অন্যায়ের কাছে কখন মাথা নত না করা। এই শিক্ষাই সে জীবনের শেষ পর্যন্ত কাজে লাগিয়েছেন। অবস্থা গাইবান্ধা জেলার সাদুল্লাপুর উপজেলার নুরপুর গ্রামের ২৪ বছর বয়সী নাজমুল, হতদরিদ্র পরিবারের তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন। তার বাবা হামিদুল ইসলাম, একজন দিনমজুর ছিলেন। বাবা মারা যাওয়ার পর সে ছিল সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি। তার উপার্জনের অর্থ দিয়েই সংসার চলত। বসতভিটার ৩ শতক জমি ছাড়া তাদের আর কোনো জমিজমা নেই। বাড়িতে যে টাকা পয়সা ছিল তার সবটাই তার চিকিৎসার পেছনে ব্যায় হয়েছে। বর্তমানে তার মা ও বয়ষ্ক দাদী খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ঘটনার প্রেক্ষাপট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থান বা জুলাই গণঅভ্যুত্থান বলতে বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন ২০২৪ ও অসহযোগ আন্দোলন ২০২৪-এর সমন্বিত আন্দোলনকে বোঝানো হয়। ২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারি করা পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণার পর কোটা সংস্কার আন্দোলন নতুন করে শুরু হয়, এই আন্দোলনে তৎকালীন শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার দমন নিপীড়ন শুরু করলে এটি অসহযোগ আন্দোলনে রূপ নেয়। কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা বিক্ষোভের পর ১৫ জুলাই বিক্ষোভকারী ও ছাত্রলীগের সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষের পর উত্তেজনা বেড়ে যায়। এর পরের দিনগুলোতে, পুলিশ , র্যাব , বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্র, যুব ও স্বেচ্ছাসেবক শাখার সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সহিংস সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এই সংঘর্ষের ফলে বিক্ষোভকারী এবং শিশু সহ অসংখ্য মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নথিসমূহ নির্দেশ করে যে বিক্ষোভ চলাকালীন ১৭০০ জনকে ভর্তি করা হয়েছিল, ৯৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। যাইহোক, চিকিৎসক এবং হাসপাতালের কর্মকর্তারা পরামর্শ দিয়েছেন যে হাসপাতালে ১০০ জনেরও বেশি লোক মারা গেছে, যার অনেক আনুষ্ঠানিকভাবে রেকর্ড করা হয়নি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীদের কোটা সংস্কারের জন্য যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সরকারের দমন-নিপীড়নের মুখে তা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে পরিণত হয়। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে তিন সপ্তাহের মধ্যে বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস ভূমিকার কারণে কয়েকশ নিরস্ত্র নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন হাজারো ছাত্র-জনতা। এক মাসের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। অবসান ঘটে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শোষণ ও নিপীড়ন। অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় ৪ আগস্ট ও সারা দেশে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নামে ও তাদের ওপর খুনী সরকারের বাহিনী অস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। সেদিন ২ টায় নাজমুলের কারখানা ছুটি হয়। বিকেল ৪ টার দিকে নাজমুল তার তিন বন্ধুর সঙ্গে মিলে আশুলিয়ার বাইপাইলে একটি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন। আন্দোলনের উত্তাল স্রোতে মিশে ছিল ন্যায়বিচারের দাবি, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু সেই স্রোত রক্তে রঞ্জিত হলো গুলির শব্দে। নাজমুল এবং তার এক বন্ধু গুলিবিদ্ধ হন। তাদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাদেরকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স অন্তত ৫ জায়গায় আটক করে তল্লাশি করা হয়। পরে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৪ আগস্ট মারা যায় তার বন্ধু। নাজমুল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৪ম তলায় ২১ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাকে ঐ ৫ তারিখ সকাল সাতটার দিকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয় ও তার বুকের নিচে লাগা গুলি বের করে সন্ধ্যা ৭ টার দিকে বের করা হয়। প্রথমে আইসিইউ ও পরে আইসিইউ থেকে পরের দিন বিকাল ৫টায় বেডে নেওয়া হয়। তার স্বজনের ভাষ্যমতে, নার্সদের বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও নাজমুলকে ঠিক মতো সেলাইন ও ওষুধ দেওয়া হয়নি। এমনকি ড্রেসিংও পরিবর্তন করা হয়নি ঠিকমতো। ডাক্তাররা তার সুস্থতা জন্য আশাবাদী হলেও ৯ আগস্ট সন্ধ্যায় সে মারা যায়। তখন তার স্বজনেরা লাশ নিতে গেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ টাকা না দিলে ছাড়তে রাজি হয়না। এ বিষয়ে ছাত্রদের অবগত করলে তারা এসে লাশ ছাড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে তাকে নিজ গ্রামে বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয়দের অনুভূতি শহীদের বয়োবৃদ্ধ দাদী কান্না জড়িত কণ্ঠে জানান, তার উপার্জনের অর্থে চলতো সংসার। বাড়িতে যে টাকা পয়সা ছিল তার সবটাই ব্যয় হয়েছে নাজমুলের চিকিৎসার পিছনে। বড় আশা ছিল আমার ছেলে মৃত্যুর পর নাতিটা সংসারের হাল ধরবে, তাকেও আল্লাহ কেড়ে নিলো, হামরা এখন কেমনে বাচমো। হামি অসুস্থ গত কয়েকদিন থেকে বাড়িতে খাবার নাই, হামার ওষুধ নাই। শহীদের ছোট বোন আয়েশা আবেগ তাড়িত হয়ে বলেন, ভাই মারা যাওয়ার পর আমরা নিঃস্ব হয়ে গেলাম। কীভাবে চলবে সংসার? শহীদের বড় বোন জামাই বলেন, নাজমুল ভাই খুবই স্পষ্টভাষী, ভদ্র ও সঠিক বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। বাড়ির বটগাছের মতো ছিলেন তিনি। তাকে আমি কখনো অন্যায় কাজে দেখিনি। প্রতিবেশীর বক্তব্য, গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে গরিব পরিবার তারাই। নাজমুলের বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে নাজমুলই সংসার চালাতো। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নাজমুল মারা যাওয়ার পর তাদের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। দেশের মানুষের জন্য তার আত্মত্যাগের প্রতিদান ফেলনা তার পরিবার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয় ও আন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা মণ্ডলীর নিকট আমাদের আকুল আবেদন আপনারা এই অসহায় পরিবারটির দিকে একটু তাকান। নাজমুল আমাদের গ্রামের অহংকার। আমাদের জোর দাবি তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদি মর্যাদা দেয়া হোক। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া হোক তার পরিবারের প্রতি। এক নজরে শহীদের ব্যক্তিগত তথ্য নাম : নাজমুল মিয়া জন্ম : ০১/০২/২০০০ পেশা : গার্মেন্টস কর্মী মাসিক আয় : ১০,০০০ স্হায়ী ঠিকানা : গ্রাম: নুরপুর, ইউনিয়ন : কামাড়পারা, থানা: সাদুল্লাপুর, জেলা: গাইবান্ধা বর্তমান ঠিকানা : বাসা/ মহল্লা: শিমুলতলা, এলাকা : জামগড়া, থানা: আশুলিয়া, জেলা: ঢাকা পিতার নাম : হামিদুল ইসলাম পেশা : মৃত মাতার নাম : গোলেভান বেগম পেশা : গৃহীনি বয়স : ৪০ পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ৩ জন, মা (গোলেভান বেগম, ৪০), দাদি (রাহেলা বেগম, ৭০) ঘটনার স্থান : আশুলিয়ার বাইপাইল আক্রমনকারী : পুলিশ আহত হওয়ার সময়কাল : তারিখ: ০৪/০৮/২৪ ইং, সময়: বিকেল: ৪:০০ ঘটিকা মৃত্যুর তারিখ ও সময় স্থান : ০৯/০৮/২৪ ইং, সময়: রাত: ৭:০০ ঘটিকা, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : নিজ গ্রামের গোরস্থান প্রস্তাবনা ১. শহীদের পরিবারকে এককালীন আর্থিক অনুদান প্রদান ২. নিয়মিত মাসিক ভাতা প্রদান ৩. বাসস্থান করে দেয়া ৪. পরিবারের চিকিৎসার যাবতীয় খরচ বহন করা