Image of মো: রাসেল রানা

নাম: মো: রাসেল রানা

জন্ম তারিখ: ২ মার্চ, ২০০৪

শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪

বিভাগ: রাজশাহী

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা :দর্জি, শাহাদাতের স্থান :ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল |

শহীদের জীবনী

মা অঞ্জনা বেগম পাগলপ্রায়। তিনি রাসেলের রক্তমাখা জামাটি বুকে চেপে ধরে কাঁদতে থাকেন। সেই কান্নায় পুরো গ্রাম শোকের সাগরে ডুবে যায়। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই কত কষ্ট করেছে! যেটুকু উপার্জন করত, তার অর্ধেক বাবাকে দিত। প্রতি ঈদে নতুন কাপড় নিয়ে আসতো। তার বোনটার চিকিৎসা করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। অথচ সেই ছেলেটা আজ আর নেই। নওগাঁ জেলার মান্দা থানার কসব ইউনিয়নের এক শান্ত সবুজে ঘেরা গ্রাম ভোলাগাড়ি। সেই গ্রামের পিন্টু রহমান আর অঞ্জনা বেগমের ঘরে একটি মাত্র ছেলে রাসেল রানার জন্ম হয়। তার জন্মের দিনটি ছিল ২রা মার্চ, ২০০৪ সাল। মাঘ মাসের শীতল হাওয়া তখনও পুরোপুরি বিদায় নেয়নি। পিন্টু আর অঞ্জনার তিন মেয়ের মধ্যে একমাত্র ছেলে ছিল রাসেল। পিতা মো: পিন্টু রহমান পেশায় রিক্সাচালক ও দিনমজুর। মাতা মোছা: অঞ্জনা বেগম পেশায় গৃহিণী ও অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। তিন বোনের বড়জন মোছা: শারমিন খাতুন বিবাহিতা। থাকেন শ্বশুর বাড়ি। মেজবোন মোছা: শাকিলা খাতুন তালাকপ্রাপ্তা। আর সবার ছোট বোন ১৩ বছর বয়সী মোছা: বৈশাখী খাতুন জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী।। পিতার রিক্সা চালনা আর মায়ের অন্যের বাসাবাড়িতে কাজের বিনিময়ে পাওয়া অর্থে চলতো এই অসহায় পরিবারের দিনকাল। পিতার আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হওয়ায় ভাইবোনের কারো হয়নি পড়ালেখা করার সৌভাগ্য। বালক বয়সেই রাসেল রানা চলে যান নারায়ণগঞ্জে তার এক প্রতিবেশী চাচার কাছে। সেখানেই ২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিনা মজুরিতে শেখেন দর্জির কাজ। তারপর ২০২২ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত মাসিক ১৫০০ টাকা বেতনে কাজ করতে থাকেন। রাসেল যেভাবে শহীদ হন জুলাই ২০২৪; বৈষম্যের বিরুদ্ধে মানুষের চেতনা জেগে উঠেছিল দেশে। ততদিনে রাসেল হয়ে উঠেছে একজন সাহসী প্রতিবাদী তরুণ। অন্যায় না মানা অকুতোভয় প্রাণ। ১৯ জুলাই ২০২৪; নারায়ণগঞ্জে ছাত্ররা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নামলো। রাসেলও ছিল তাদের সঙ্গে। তার চোখে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার। সেই আন্দোলনে পুলিশ আর ছাত্রদের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ বাঁধে। হঠাৎ করেই পুলিশ গুলি ছোড়ে ছাত্রদের দিকে। এক মুহূর্তে সব স্বপ্ন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, যখন একটি গুলি রাসেলের বুকে এসে বিদ্ধ হয়। রাসেল মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সময় তখন বিকেল ৫:৩০মিনিট। অথচ ৩০ মিনিট পূর্বে বিকাল ৫টায় বাবার সাথে কথা হয় শহীদ রাসেলের। অজ্ঞাত নাম্বার থেকে রাসেলের বাবার ফোনে কল যায়। তিনি খবর পান রাসেলের বুকে গুলি লেগেছে। ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য রাসেলের বাবা নারায়ণগঞ্জে রাসেলের সেই প্রতিবেশী চাচার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি কিছুই বলতে পারেন না। অবশেষে পিন্টু ছুটে যান ঢাকায়। ২১ শে জুলাই তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজে রাসেলকে খুঁজে পায়। এদিকে গুলিবিদ্ধ রাসেলকে স্থানীয় লোকজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ডাক্তার জানান, রাসেলের প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাকে বাঁচাতে রক্তের প্রয়োজন। কিন্তু কে জোগাড় করবে রক্ত! কে দেবে রক্ত! আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হলেও রাসেলকে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে হাসপাতালের বেডে কাতরাতে কাতরাতে তিনদিন পর ২২ শে জুলাই, ২০২৪ সোমবার ভোর ৩টা ৩০ মিনিটে শহীদ হন রাসেল রানা। শহীদ রাসেলের আরো কিছু তথ্য শহীদ মো: রাসেল রানাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। তার পিতা মোহাম্মদ পিন্টু রহমানই পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস ব্যক্তি। তিনি ফসলের মৌসুমে দিনমজুরের কাজ করেন এবং বছরের বাকি সময় ঢাকা শহরে রিকশা চালান। মা অন্যের বাসাবাড়িতে কাজ করেন। বর্তমানে মা-বাবা, দাদী ও দুই বোনসহ মোট ৫ জনের পরিবার রাসেল রানাদের। বাবা মো: পিন্টুর রহমানের চাচাতো শ্বশুর থেকে পাওয়া ১ শতক জমি ও তার সাথে কিছু খাস জমির উপর দুই রুমের ছোট্ট একটি মাটির ঘরে বসবাস তাদের। রাসেল রানার তিন বোনের মধ্যে বড় বোন শারমিনের বিয়ে হয় পাশের গ্রামে। মেজ বোন শাকিলার জীবন সুখের ছিল না। বিয়ের মাত্র তিন মাসের মাথায় স্বামী তালাক দিয়ে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। আর ছোট বোন জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী। হাঁটতে পারে না, চলাফেরা তো দূরের কথা। সেই বোন এখনো শয্যাশায়ী। অনেক স্বপ্ন নিয়ে রাসেল শহরে আসে। একদিন বড় কিছু করবে সে। বাবাকে রিক্সা চালাতে হবে না, মা আর অন্যের বাড়িতে কাজ করবে না, ছোট বোনের চিকিৎসা হবে, আরো কত কী! কিন্তু স্বপ্নবাজ সেই বালকের জীবনকে থমকে দেয় স্বৈরাচারের একটি বুলেট। আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নেওয়া হলে ডাক্তাররা বলেছিল, সে প্রচুর রক্ত হারিয়েছে। তাকে ইমার্জেন্সি রক্ত দিতে হবে। কিন্তু তার পাশে তো কেউ ছিল না! কে দিবে রক্ত? কে ব্যবস্থা করবে রক্ত? ক্ষুধায় পিপাসায় চিৎকার করেছিল রাসেল! কিন্তু একফোঁটা পানি পর্যন্ত কেউ তাকে দেয়নি। তারা রাসেলকে চিকিৎসা না করে নিঃশব্দে মেরে ফেলেছিল। ২২শে জুলাই ভোর ৩ টা ৩০ মিনিটে রাসেল শাহাদাত বরণ করেন। সেই সন্ধ্যায় তার মরদেহ গ্রামের বাড়ি ভোলা গাড়িতে আনা হয়। মা অঞ্জনা বেগম পাগলপ্রায়। তিনি রাসেলের রক্তমাখা জামাটি বুকে চেপে ধরে কাঁদতে থাকেন। সেই কান্নায় পুরো গ্রাম শোকের সাগরে ডুবে যায়। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই কত কষ্ট করেছে! যেটুকু উপার্জন করত, তার অর্ধেক বাবাকে দিত। প্রতি ঈদে নতুন কাপড় নিয়ে আসতো। তার বোনটার চিকিৎসা করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। অথচ সেই ছেলেটা আজ আর নেই। রাসেলের বাবা পিন্টু রহমান কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, "আমার ছেলেটা তো কোনো অপরাধ করেনি। সে তো শুধু অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। কেন তারা আমার ছেলেকে মেরে ফেলল? আমার একমাত্র ছেলেটা চলে গেল। আমার জীবন তো শেষ হয়ে গেল।" রাসেলের প্রতিবন্ধী বোনের জন্য তার মা একটানা এক বছর রোজা রেখেছিলেন। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, মেয়েকে সুস্থ করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আল্লাহ তার পরীক্ষা নিলেন অন্যভাবে। ছোট বোনের চিকিৎসার স্বপ্ন দেখা সেই রাসেলকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। রাসেলের দাদি বলেন, "রাসেল ফোন দিয়ে বলতো, 'দাদি, আর ঢাকায় ভালো লাগে না। একটা দোকান দিলে বাড়িতে চলে আসব।' আমার নাতি তো বাড়িতে ফিরল, কিন্তু সাদা কাপড়ে মোড়ানো অবস্থায়। তারা আমার নাতিকে হত্যা করেছে।" গ্রামের সবাই কাঁদছে। প্রতিবেশীরাও শোকাহত। তারা চায় রাসেলের হত্যার বিচার। বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সেই সাহসী ছেলেটিকে এভাবে নির্মমভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হবে, কেউ কল্পনাও করেনি। তার পরিবার এখন শূন্য, অভাবের ভেতরে ডুবে গেছে। তার বাবা আর রিকশা চালায় না, তার মা কাঁদে, আর বোনটি অসুস্থতায় কাতর! কিন্তু এই শোকের মধ্যে তারা একটি স্বপ্ন দেখে— একদিন যেন শহীদ রাসেল রানার মৃত্যুর ন্যায়বিচার হয়। যেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে তার লড়াই বৃথা না যায়। যেন আর কোনো মায়ের কোল খালি না হয়। এক নজরে শহীদের প্রোফাইল নাম : মো: রাসেল রানা জন্ম তারিখ : ০২.০৩.২০০৪ জন্মস্থান : ভোলাগাড়ি, নওগাঁ পেশা : দর্জি কর্মস্থল : নারায়ণগঞ্জ পিতা : মো: পিন্টু রহমান মাতা : মোছা: অঞ্জনা বেগম বর্তমান ঠিকানা : নারায়ণগঞ্জ স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: ভোলাগাড়ি, ইউনিয়ন: কসব, থানা: মান্দা, জেলা: নওগাঁ পরিবারের সদস্য : ৫ জন আঘাতের ধরন : গুলিবিদ্ধ গুলিবিদ্ধের স্থান : নারায়ণগঞ্জ ঘাতক : পুলিশ গুলিবিদ্ধ হওয়ার তাং ও সময় : ১৯শে জুলাই, ২০২৪; বিকাল ০৫:৩০টা শহীদ হওয়ার তাং ও সময় : ২২শে জুলাই, ২০২৪ ভোর ৩:৩০টা শহীদ হওয়ার স্থান : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সমাধিস্থল : গ্রামের কবরস্থান, ভোলাগাড়ি শহীদ পরিবারের জন্য সহযোগিতা সংক্রান্ত প্রস্তাবনা ১. শহীদ রাসেল রানার পরিবারকে বসবাসের জন্য একটি গৃহ নির্মাণ করে দেওয়া ২. পিতা পিন্টু রহমানের জন্য একটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা ৩. প্রতিবন্ধী বোন মোছা. বৈশাখী খাতুনের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা ৪। নিয়মিত ভাতার ব্যবস্থা করা।

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of মো: রাসেল রানা
Image of মো: রাসেল রানা
Image of মো: রাসেল রানা
Image of মো: রাসেল রানা
Image of মো: রাসেল রানা
Image of মো: রাসেল রানা
Image of মো: রাসেল রানা
Image of মো: রাসেল রানা

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

মো. শরিফুল ইসলাম মোহন

মো: খোকন সরদার

 মো: মাহবুব হাসান নিলয়

মো: কমর উদ্দিন খাঁ

বায়েজিদ বোস্তামী

মো: সুজন মাহমুদ

মো: জিল্লুর সরদার

মো. মেহেদী হাসান রবিন

মো: ইয়াহিয়া আলী

মো: নজিবুল সরকার

মো: সুমন সেখ

মো: সাকিব আনজুম

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo