Image of মো: রায়হান আলী

নাম: মো: রায়হান আলী

জন্ম তারিখ: ১ মার্চ, ২০০৬

শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৮ জুলাই, ২০২৪

বিভাগ: রাজশাহী

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা :স্টুডিও দোকানের কাজ, শাহাদাতের স্থান :গাজীপুর বোর্ড বাজার।

শহীদের জীবনী

পাখি ডাকা প্রভাত রাঙা ছায়া সুনিবিড় স্নিগ্ধ একটি গ্রাম পানিশাইল। এই গ্রামটি নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলায় অবস্থিত। এই গ্রামে স্ত্রী মোছা: রাণী বেগমকে নিয়ে বাস করতেন মো: মামুন সরদার নামক একজন ভ্যানচালক। সুন্দর একটি দিনে এই দম্পত্তির ঘর আলো করে জন্ম হয় সুন্দর একটি ছেলে শিশুর। নাম রাখা হয় মো: রায়হান আলী। সেই দিনটি ছিল ২০০৬ সালের ১লা মার্চ। মায়ের কোল আলোকিত করে আসা রায়হান আলী একটু একটু করে বড় হতে থাকে চোখের সামনে। একসময় স্কুলে যাওয়া শুরু হয় তার। এক ক্লাস দুই ক্লাস করে উঠে যান দশম শ্রেণিতে। তার স্কুলের নাম ছিল অনুশীলন প্রি ক্যাডেট একাডেমী। ইতোমধ্যে রায়হান আলীর একটা বোনেরও জন্ম হয়। বাবা-মা আর ভাইয়ের আদরে সেও বড় হতে থাকে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে ভ্যানচালক বাপের আর্থিক দৈন্যদশায়। পরিবারের খরচ মিটিয়ে দুভাইবোনের পড়াশোনা করানোর মতো সাধ্য তার আর হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে রায়হান আলীর পড়াশোনা দশম শ্রেণিতেই ক্ষান্ত দিতে হয়। পরিবারের স্বচ্ছলতা আনতে এবং ছোট বোনটাকে পড়াশোনা করাতে কর্মের খোঁজে তাকে আসতে হয় গাজীপুর শহরে। এক বুক স্বপ্ন নিয়ে রায়হান আলী এসেছিলেন এই শহরে কিন্তু স্বৈরাচার খুনি হাসিনা তার ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে থাকার জন্য রায়হান আলীর মতো হাজারো নিরীহ প্রাণকে চিরজীবনের জন্য স্তব্ধ করে দিয়েছে। ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে দিয়েছে হাজারো পরিবারের আশা ভরসা। পাখি হয়ে যেভাবে উড়ে গেলেন রায়হান আলী ১৬ই জুলাই, ২০২৪ পুলিশের গুলিতে রংপুরের আবু সাঈদ নিহত হলে সারা দেশ তোলপাড় হয়ে যায়। সেই সাথে আন্দোলন পায় ভিন্নমাত্রা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রবাহিত হয় ভিন্ন খাতে। ক্রমান্বয়ে তা এগিয়ে যায় ছাত্রজনতার স্বৈরাচার পতনের এক দফা গণ দাবিতে। ওই দিনের পর থেকে প্রতিদিনই সারাদেশে অনেক ছাত্র জনতাকে খুনি হাসিনার নির্দেশে পাখির মতো গুলি করে মারছিল পুলিশ লীগ এবং ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। তেমনই একটি দিন ১৮ জুলাই ২০২৪। রায়হান আলী যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, সেই বাড়িওয়ালাকে বলে তিনি গাজীপুর বোর্ড বাজারের দিকে যান। সে সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি মিছিল গাজীপুর বোর্ড বাজারের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। রায়হান আলীও অংশগ্রহণ করেন সেই মিছিলে। ছাত্র জনতার সেই মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য নিরস্ত্র ছাত্র জনতার ওপর নির্বিচারে পুলিশ রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড এবং গুলি বর্ষণ শুরু করে। গুলিবিদ্ধ হন রায়হান আলী। তার মাথার পিছনে আঘাত করে একটি বুলেট। তৎক্ষণাৎ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। দুপুর ৩টা ৩০ মিনিটে রায়হান আলীর নাম্বার থেকে তার বাবার মোবাইলে ফোনকল যায় একটি। অপরিচিত একজন ব্যক্তি তার বাবাকে জানান, তার ছেলের রায়হান আলী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এ কথা শুনে আকাশ ভেঙ্গে পড়ে বাবা মামুন সরদারের মাথায়। বাবা অনুরোধ জানান রায়হান আলীর চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যত টাকার প্রয়োজন হোক না কেন, তিনি ম্যানেজ করবেন। এর ঠিক ১০ মিনিট পরে আরেকটি ফোনকলে তার বাবাকে জানানো হয়, রায়হান আলী আর বেঁচে নেই! ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার সাথে সাথে যেন হার্ট অ্যাটাকের মতো অবস্থা হয় বাবা মামুন সরদারের। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা বাবা নিরুপায় হয়ে ফোন করেন তার চাচাতো ভাই রেজাউল ও খালাতো ভাই নাজুকে। রায়হান আলীর মৃত্যুর খবর শুনে তার বাড়িওয়ালার ছেলে ছুটে যান হাসপাতালে। মরদেহ বুঝে পেলেও গাজীপুর থেকে নওগাঁ নেওয়ার জন্য কোনো অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছিল না। কোনোভাবে একটি অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া গেলেও ড্রাইভার দেখায় চরম অমানবিকতা। ৫০,০০০ টাকার কমে সে যেতে রাজি হয় না। অবশেষে স্থানীয়দের সমঝোতায় ২৫,০০০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। ১৮ তারিখ রাত ৩টায় শহীদ রায়হান আলীর মরদেহ তার গ্রামের বাড়িতে এসে পৌঁছায়। পরদিন ১৯ তারিখ সকাল ১১টায় জানাযা সম্পন্ন করার মাধ্যমে নিয়ামতপুর উপজেলার পানিশাইল গ্রামে শহীদ রায়হান আলীকে চির নিদ্রায় শায়িত করা হয়। এক হৃদয়বিদারক অবস্থা শহীদ রায়হান আলীর মৃত্যুতে তার এলাকায় তৈরি হয় এক হৃদয়বিদারক অবস্থা। পাড়াপড়শী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবার মাঝে হাহাকার পড়ে যায়। শোকে-কষ্টে কেঁদে কেঁদে ব্যাকুল হয়ে যায় স্বজনেরা। সন্তান হারানোর তীব্র যন্ত্রণা এবং অসহ্য বেদনা মেনে নিতে পারেন না দুঃখ-শোকে পাথর হয়ে যাওয়া বাবা-মা। মা রাণী বেগম বারবার ছুটে যান কবরস্থানে, যেখানে শুয়ে আছে তার নাড়িছেঁড়া ধন রায়হান আলী। কবরস্থানের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারলেও দূরে দাঁড়িয়ে থেকে বুক ভাসান অশ্রুজলে। সন্তানের রেখে যাওয়া বিভিন্ন স্মৃতির মধ্যে ডুবে থাকেন সারাদিন। তিনি জানান, তার উপার্জনের শেষ টাকা দিয়ে রায়হান আলীর ভবিষ্যৎ স্ত্রীর জন্য একটি শাড়ি কিনে রেখেছিলেন। অভাবের সংসারে একটু একটু করে টাকা জমান। বিয়ের পর তা দিয়ে যেন ছেলেকে আসবাবপত্র কিনে দেওয়া যায়। বাবা মো: মামুন সরদার দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণায় যেন স্তব্ধ হয়ে গেছেন। এক রুম থেকে অন্য রুমে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ান ছেলেকে। ঘরের বারান্দায় বসে থেকে কাটে মামুন সরদারের প্রত্যেকটি নির্ঘুম রাত। ছেলের মুখে বাবা ডাক শুনতে না পারার তীব্র যন্ত্রণায় কাটে তার প্রতিটি ক্ষণ। প্রতিটি সময়। ছোট বোন মোছা: তাসলিমা ভাইকে হারিয়ে হয়ে গেছেন বাকরুদ্ধ। তার ছোট্ট মনে যেন জমে আছে কতশত অভিমান। তাকে দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ না করেই চলে যাওয়ার অভিমান! পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়াপড়শি কেউ আর ফিরে পাবে না মোহাম্মদ রায়হান আলীকে। তবুও তিনি সারা জীবন রয়ে যাবেন আমাদের মাঝে। শহীদ রায়হান আলী সম্পর্কে আরো কিছু কথা একসময় বাবা-মায়ের কর্মের সুবাদে রায়হান আলী রা সপরিবারে থাকতেন গাজীপুর বোর্ড বাজারের একটি ভাড়া বাসায়। বাবা মামুন সরদার কাজ করতেন ইউনিক ডিজাইনে। আর মা রানী বেগম ছিলেন অনন্ত নামক এক গার্মেন্টসের কর্মী। কিন্তু শহরের এই কষ্টের জীবন তারা বয়ে বেড়াতে পারছিলেন না। তাইতো বছর তিনেক পূর্বে তারা সবাই নওগাঁয় তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যান। গ্রামে গিয়ে বাবা মামুন সরদার কিছুদিন দিনমজুরের কাজ করলেও সেই স্বল্প আয়ে দুই সন্তানের পড়াশোনার খরচ বহন করে সংসার চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। পরবর্তীতে ছেলে রায়হান আলীর পরামর্শে সাপ্তাহিক ১৩০০ টাকা কিস্তি পরিষদের শর্তে ৬৫,০০০ টাকা ঋণ নিয়ে একটি মোটরভ্যান ক্রয় করেন। পূর্বের তুলনায় আয় রোজগার কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও দরিদ্র্যতা যেন পিছু ছাড়ছল না রায়হান আলীদের পরিবারের। দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় নিজে থেকেই উপার্জনের দায়িত্ব কিছুটা কাঁধে তুলে নেন রায়হান আলী। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে গাজীপুর বোর্ড বাজারের পূর্বের সেই ঠিকানায় চলে আসেন তিনি। প্রথমদিকে বাসের হেলপারি করে, কখনোবা ভ্যান চালিয়ে আয় রোজগার করার চেষ্টা করেন তিনি। পরবর্তীতে ছাত্র স্টুডিও নামক একটি দোকানে মাসিক ৫০০০ টাকা বেতনে চাকরি পান। পাশাপাশি কম্পিউটারের কাজও শিখতে থাকেন তিনি। এভাবে চলতে চলতেই এগিয়ে আসে সেই কালো দিন ১৮ জুলাই ২০২৪, যেদিনে স্বৈরাচারী গণখুনি হাসিনা নিভিয়ে দেয় তার জীবনের সকল আলো। পাঠিয়ে দেয় এই পৃথিবী থেকে পরপারে। বর্তমানে শহীদ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হচ্ছেন তার বাবা মামুন সরদার। ভ্যান চালিয়ে উপার্জিত অর্থই হচ্ছে পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস। স্ত্রী ও কন্যা সন্তানকে নিয়ে অত্যন্ত টানাপোড়েনের সংসার তার। এই অসচ্ছল পরিবারটি একটি খাস জমিতে ২টি মাটির ঘরে বসবাস করছেন। শহীদের ব্যক্তিগত প্রোফাইল পূর্ণনাম : মো: রায়হান আলী জন্ম তারিখ : ০১.০৩.২০০৬ শহীদ হওয়ার তাং ও সময় : ১৮ জুলাই, ২০২৪; বিকাল ০৩:৩০টা শহীদ হওয়ার স্থান : গাজীপুর বোর্ড বাজার আঘাতের ধরন : মাথার পিছনে গুলিবিদ্ধ ঘাতক : পুলিশ সমাধিস্থল : গ্রামের বাড়ি পানিশাইল, নওগাঁ পেশা : স্টুডিও দোকানের কাজ পিতা : মো: মামুন সরদার মাতা : মোছা: রানী বেগম স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: পানিশাইল, ইউনিয়ন+থানা: নিয়ামতপুর, জেলা: নওগাঁ বাড়িঘর ও সম্পদ : গ্রামের বাড়িতে খাস জমির উপর মাত্র ২টি মাটির ঘর : ভ্যানচালক পিতার মাসিক ৫০০০ টাকা আয় বোন : মোসা: তাসলিমা, বয়স: ১০ বছর, শ্রেণি: ৪র্থ পানিশাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শহীদ পরিবারের জন্য সহযোগিতা সংক্রান্ত প্রস্তাবনা ১. শহীদের পিতা মামুন সরকারের জন্য একটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা ২. শহীদের পরিবারের বসবাসের জন্য একটি ঘর নির্মাণ করে দে

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of মো: রায়হান আলী
Image of মো: রায়হান আলী
Image of মো: রায়হান আলী
Image of মো: রায়হান আলী
Image of মো: রায়হান আলী
Image of মো: রায়হান আলী

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

মো: আব্দুল হান্নান খান

মো: রেজাউল হক সরকার

মো: জাহিদুল ইসলাম

 মো: মাহবুব হাসান নিলয়

মো. মেহেদী হাসান রবিন

মো: আবু রায়হান

আব্দুল আহাদ সৈকত

মো: সোহেল রানা

মো: মিনহাজ হোসেন

মো. শরিফুল ইসলাম মোহন

মো: রাসেল রানা

 ইয়াছিন

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo