জন্ম তারিখ: ১ জুন, ২০০৬
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৯ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: রাজশাহী
পেশা : কাঠমিস্ত্রী, শাহাদাতের স্থান : সোহরাওয়ারদী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
’’শহীদ মো: তারিক বাবাকে বলতো বাবা অনেক ভালো ভালো ছাত্র মারা যাচ্ছে, তুমিও আন্দোলনে যোগ দাও'’ শহীদ তারিক হোসেন ২০০৬ সালের ১লা জুন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর থানার চৌডালা ইউনিয়নের দক্ষিণ ইসলামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পিতা মো. আশাদুল ইসলাম ও মাতা ফিদুশি খাতুনের দ্বিতীয় সন্তান। তার বড় ভাই আসমাউল (২২) রিকশাচালক। ছোট বোন আছরিফা খাতুন (১৪) শিক্ষার্থী। পেশায় তারিক হোসেন ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। মাত্র ১১ বছর বয়সে ১৫০০ টাকা বেতনে কাঠমিস্ত্রির কাজে নিযুক্ত হয়ে সততা, দক্ষতা এবং যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে মাত্র ৭ বছরের ব্যবধানে তার পারিশ্রমিক ২৪ হাজার টাকায় উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শহীদ তারিক হোসেন কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন অন্যের ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে। তিনি বিগত ৭ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। থাকতেন ঢাকার শেরেবাংলা নগর এলাকায় উজ্জলের বস্তিতে। তারিক হোসেনের পিতা আশাদুল ইসলাম পেশায় রিক্সাচালক। তার মা ফিদুশি খাতুন গৃহিণী। বর্তমানে তার পিতা ও বড়ভাইয়ের রিকশা চালানো আয়ের ওপর তার পরিবারের ব্যয় নির্বাহ হচ্ছে। শহীদ তারিক যেভাবে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেন তারিক হোসেন নিয়মিত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতেন। তার বাবা জানান, তারিক তাকে বলতো, 'অনেক ভালো ভালো ছাত্র মারা যাচ্ছে, তুমিও আন্দোলনে যোগ দাও।' ছেলের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে তার বাবা দুই/একদিন আন্দোলনে অংশ নেন। ৫ই আগস্ট তারিক বিজয় মিছিলে অংশ নেয় এবং বিকাল তিনটা পর্যন্ত গণভবনের সামনে অবস্থান করে। পরে বন্ধুদের সঙ্গে বাসায় ফিরে আসে। কিন্তু সন্ধ্যার পর আবার বাসার সামনে শেরেবাংলা নগর থানার পাশে বন্ধুদের সঙ্গে একত্রিত হয়। সেখানে কিছু পুলিশ থানার ভেতরে আটকা পড়েছিল। বাইরে ৩০ থেকে ৪০ জন শিক্ষার্থী নানারকম স্লোগান দিচ্ছিল। পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠলে পুলিশ শিক্ষার্থীদের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং থানা থেকে তাদের বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ চায়। মানবিকতাবশত ছাত্ররা তাদের দাবি মেনে নেয়। পুলিশ থানার বাইরে বের হয়, কিন্তু একটু সামনে চৌরাস্তা মোড়ে পৌঁছানোর পর শিক্ষার্থীরা স্লোগান দেয়া শুরু করলে তারা হঠাৎ পেছনে ঘুরে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করে। ঘটনাস্থলেই গুলিবিদ্ধ হন ৫ জন। তারিকের নাভির নিচে চারটি গুলি এবং হাতের কব্জিতে একটি গুলি লাগে। দ্রুত তাকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে টানা ৪ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ৯ই আগস্ট শুক্রবার বিকেল ৪টায় তারিক হাসান শাহাদাত বরণ করেন। পরিবারের কাছে তারিক ছিলেন একজন আদর্শ সন্তান ;সমাজের কাছে ছিলেন একজন সাহসী তরুণ, যিনি ন্যায় বিচারের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। বন্ধুর মুখে শহীদ হওয়ার নির্মম বর্ণনা তারিকের শহীদ হওয়া সম্পর্কে তার বন্ধু লিমন বলেন, "আমি এবং তারিক ঘটনাস্থলে একসাথে ছিলাম। যখন পুলিশ চলে যাচ্ছিল, তখন আমরা পিছন থেকে স্লোগান দিচ্ছিলাম। হঠাৎ করেই পুলিশ পিছনে ফিরে গুলি করতে শুরু করে। সাথে সাথে তারিক রাস্তায় বসে পড়ে এবং বলে, 'আমার গুলি লেগেছে।' আমি প্রথমে বিশ্বাস করছিলাম না। মনে হচ্ছিল সে হয়তো মজা করছে। কিন্তু পরক্ষণে তার হাত এবং পেটে রক্ত দেখে আমি হতবাক হয়ে যাই। আমার মাথা ঘুরে ওঠে। মুহূর্তকাল পর লোকজনের সাহায্যে আমরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেই মুহূর্তটি আমার জীবন থেকে কখনো মুছে যাবে না। বিভীষিকাময় সেই কালো সন্ধ্যা আমি কখনোই ভুলবো না। আমার প্রিয় বন্ধুর শাহাদাতের এই নির্মম ঘটনা আমার মনে জেগে থাকবে অনন্তকাল।" শহীদ তারিক সম্পর্কে আরো কিছু কথা শহীদ তারিকের পরিবার একটি দরিদ্র্য পরিবার। পরিবারের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে খুব অল্প বয়সেই পড়াশোনার ইতি টানতে হয় তাকে। মাত্র ১১ বছর বয়সে ১৫০০ টাকা বেতনে কাঠমিস্ত্রীর কাজে নিযুক্ত হন তিনি। তারিক অল্প সময়ের মধ্যে তার দক্ষতা, যোগ্যতা এবং বিশ্বস্ততার পরিচয় দিতে শুরু করেন। মালিকও তার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ধীরে ধীরে তার বেতন বাড়াতে থাকেন। শেষ মাসে ১৮ বছরের তরুণ তারিকের বেতন হয়েছিল ২৪,০০০ টাকা। তার মা কখনো কোনো কাজে যুক্ত হতে চাইলে তিনি অনুমতি দিতেন না। প্রতিবেশীদের যেকোনো বিপদ আপদে তিনি সদা এগিয়ে আসতেন। তার মা ফিদুশি খাতুন বলেন, "করোনার সময় একজন ডায়রিয়া আক্রান্ত ব্যক্তি পড়ে ছিলেন। ভয়ে কেউ কাছে না গেলেও তারিক তার পাশে থেকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছিলেন।" তারিকের বাবা বলেন, "আমার ছোট ছেলে আমাকে যতটুকু ডাকতো এবং খোঁজখবর নিত, বড় ছেলে তা করত না। পুরো পরিবারকে নিয়ে সে ভাবতো।" তারিকের মৃত্যুর খবর তার পুরো পরিবারকে ভেঙে দেয়। তার মা-বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, "আমাদের ছেলে আন্দোলনে অংশ নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। সে আমাদের জন্য গর্বের কারণ ছিল।" শহীদ তারিক হাসানের জীবন ও সংগ্রাম মনে করিয়ে দেয় সেই সময়ের বাস্তবতা, যেখানে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে সাহসী ছাত্ররা প্রতিবাদ করেছিল। তার সাহসিকতা এবং অসাধারণ মানবিক গুণাবলি আজও আমাদের প্রেরণা দেয়। আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, মানবতার জন্য সংগ্রাম কখনো বৃথা যায় না। ঋণে জর্জরিত শহীদ পরিবার শহীদ তারিক হোসেনের পরিবার বর্তমানে কঠিন এক বাস্তবতার মুখোমুখি। তার বাবা-মা, বড় ভাই এবং ছোট বোন সবাই মিলে ঢাকায় একটি বস্তিতে ছোট্ট টিনের ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন। জীবনের সংগ্রাম যেন তাদের প্রতিদিনের সঙ্গী। আট বছর আগে তার পিতা ৩ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে একটি ট্রলার কিনেছিলেন। আশায় ছিলেন জীবনের সচ্ছলতা ফিরবে। কিন্তু মাত্র ১১ দিন চলার পর সেই ট্রলার ডুবে যায়। এরপর তিনি কাপড়ের ব্যবসায় হাত দেন, কিন্তু সেখানেও ক্ষতির সম্মুখীন হন। তারিক হাসানের চিকিৎসা চালাতে আরো ২ লক্ষ টাকা ঋণ করতে বাধ্য হন তিনি। সব মিলিয়ে এখন তার ঋণের পরিমাণ ৫ লক্ষ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। পরিবারটির দিন গুজরানের জন্য বড় ছেলেসহ পিতা বর্তমানে রিকশা চালাচ্ছেন। কিন্তু শহীদ তারিকের মৃত্যুর পর তাদের জীবনে নতুন দুঃখের অধ্যায় যোগ হয়েছে। পরিবারটি এখন ঢাকার কষ্টের জীবন ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেখানে শহীদের দাদির শোয়া দুই কাঠা জমি তাদের শেষ আশ্রয়স্থল। শহীদের ব্যক্তিগত প্রোফাইল নাম : মো: তারিক হোসেন জন্ম তারিখ : ০১.০৬.২০০৬ শহীদ হওয়ার তাং ও সময় : ৯ই আগস্ট, ২০২৪; বিকাল ৪টা শহীদ হওয়ার স্থান : সোহরাওয়ারদী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা আঘাতের ধরন : মাথার পিছনে গুলিবিদ্ধ গুলিবিদ্ধের স্থান : শেরেবাংলা নগর থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হওয়ার তাং ও সময় : ৫ই আগস্ট, ২০২৪; সন্ধ্যা ৭টা ঘাতক : পুলিশ সমাধিস্থল : দক্ষিণ ইসলামপুর গোরস্থান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ পেশা : কাঠমিস্ত্রী পিতা : মো: আশাদুল ইসলাম মাতা : মোছা: ফিদুশি খাতুন স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: দক্ষিণ ইসলামপুর, ইউনিয়ন: চৌডালা, থানা: গোমস্তাপুর, জেলা: চাঁপাইনবাবগঞ্জ বাড়িঘর ও সম্পদ : গ্রামে দাদির দুই কাঠা জমি। বাপ ও ভাইয়ের রিকশাচালনার আয় ভাইবোন : ১ ভাই ও ১ বোন। বড় ভাই আসমাউল (২২) রিক্সাচালক। ছোটবোন আছরিফা খাতুন (১৪) শিক্ষার্থী শহীদ পরিবারের জন্য সহযোগিতা সংক্রান্ত প্রস্তাবনা ১. শহীদের পিতা এবং ভাই রিকশাচালক, তাদেরকে একটি রিকশা প্রদান করা যেতে পারে ২. গ্রামের বাড়িতে একটি ঘর তৈরি করে দেওয়া যেতে পারে ৩. পাঁচ লক্ষ টাকা ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করে দেওয়া যেতে পারে