জন্ম তারিখ: ২০ অক্টোবর, ১৯৯৭
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: রাজশাহী
পেশা : ছাত্র, শাহাদাতের স্থান : রাজশাহী মেডিকেল কলেজ
রায়হানের ছোট ভাই ইন্টারমিডিয়েট শেষ করা রানা ইসলাম বলেন, "ভাইয়া আমায় অনেক ভালোবাসতেন, খেয়াল রাখতেন। ভাইয়া সব সময় পড়ালেখার খোঁজ নিতেন। আজ আমার ভাই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আমি ভাই হত্যার সঠিক বিচার চাই" নেতৃত্বের গুণাবলী সম্পন্ন এক তরুণ তুর্কি ছিলেন শহীদ মোহাম্মদ রায়হান আলী। ছিলেন ইসলামী আদর্শের এক আদর্শ সৈনিক। অকুতোভয় নির্ভীক এই তরুণ একমাত্র আল্লাহ তায়ালাকে ছাড়া ভয় পেতেন না আর কারো। আল্লাহর এই সৈনিকের জন্ম ১৯৯৭ সালের ২০শে অক্টোবর। পাখি ডাকা ছায়া ঢাকা শান্ত সুনিবিড় একটি গ্রাম মঙ্গলপাড়া। এই গ্রামটি রাজশাহী জেলার পুঠিয়া থানার অন্তর্গত শিলমাড়িয়া ইউনিয়নে অবস্থিত। এই গ্রামের এক গরীব দম্পতি মো. মুসলেম উদ্দিন ও মোছা. রুকসানা বিবি। এই দম্পতির কোলজুড়ে আগমন ঘটে তাদের প্রথম সন্তান রায়হান আলীর। কৃষক পিতা ও গৃহিণী মায়ের সেদিন খুশির সীমা ছিল না। ছোটবেলা থেকেই রায়হান আলী ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। মেধার স্বাক্ষর রেখে একটার পর একটা ক্লাস টপকাতে থাকেন। সর্বশেষ তিনি রাজশাহী কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এমবিএ সম্পন্ন করেন। ছাত্রজীবনে তিনি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাইতো তার জীবনটা ছিল ইসলামের আলোয় উদ্ভাসিত, আলোকিত। নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন আল্লাহ ও রাসূল (সা.)-এর আদর্শ সৈনিক হিসেবে। শহীদ রায়হান আলীর পরিবারে বাবামা ছাড়াও রয়েছেন এক ভাই। নাম তার রানা ইসলাম। এইচএসসি শেষ করে তিনি এখন অনার্সে ভর্তিচ্ছু। শহীদ রায়হানের পিতা একজন গরীব কৃষক। নিজস্ব কোনো কৃষি জমি নেই তাদের। তার বাবা অন্যের জমি বর্গাচাষ করেন। যা আয় হয় তা দিয়ে পরিবারের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানো কঠিন হয়ে পড়ে। সংসার চালানোর জন্য তাদের প্রতিনিয়তই নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। কৃষি থেকে পাওয়া সামান্য আয় দিয়ে তাদের শিক্ষা, চিকিৎসা এবং দৈনন্দিন খরচ সামলানো দুরূহ। রায়হান আলীর শহীদ হওয়ার ঘটনা জুলাইয়ের শুরুর দিকের কথা। সবেমাত্র বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয় রাজশাহীতে। আন্দোলনকে জোরদার করতে কিছু সিনিয়র ভাইয়েরা ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে এগিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শহীদ রায়হান আলী। নেতৃত্বগুণে পারদর্শী রায়হান আলী শুরু থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনে সমন্বয়কদের গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শসহ সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করতেন। সাথে নিজেও থাকতেন মিছিলের সম্মুখভাগে। ক্রমেই আন্দোলন জোরালো হতে থাকে এবং রায়হান আলী সার্বক্ষণিক আন্দোলনকারীদের পাশে থেকে ভূমিকা রাখতে থাকেন। দিনটি ছিল সোমবার, আগস্টের ৫ তারিখ। স্বৈরাচার পতনের কিছুক্ষণ আগে। রুয়েট গেইট সংলগ্ন নগরীর তালাইমারি মোড়ে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে সাহেব বাজারের দিকে রওনা দেয়। কিন্তু আলুপট্টি নামক জায়গায় শিক্ষার্থীদের মিছিলটি গেলে রাজশাহীর আওয়ামী লীগ নেতা ডাবলু সরকার এবং তৎকালীন সিটি কর্পোরেশনের মেয়র খাইরুজ্জামান লিটনের ক্যাডার বাহিনী শিক্ষার্থীদের ওপর মুহুর্মুহু গুলি চালায়। সময় তখন দুপুর ১:৩০। আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ছোঁড়া একটি গুলি এসে রায়হান আলীর ঠিক মাথায় আঘাত করে। সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন রায়হান আলী। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তাৎক্ষণিক তাকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। তার গুরুতর অবস্থা দেখে ডাক্তাররা তাকে ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দেন। পরামর্শ মোতাবেক ঢাকায় রওনা দিয়েও আন্দোলনের ভয়াবহ পরিস্থিতির কারণে সামনে আগানো সম্ভব হয়নি। উপায়ান্তর না দেখে পুনরায় গুলিবিদ্ধ রায়হান আলীকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই ভর্তি করানো হয়। রায়হান আলীকে তৎক্ষণাৎ অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয় এবং সন্ধ্যা ০৭:৩০টায় অপারেশন শেষ হয়। ডাক্তারদের ভাষ্যে, অপারেশন সফল হয়। পরের দিন ৬ আগস্ট রায়হান আলী হাত পা নাড়াচ্ছিলেন, যা সবাইকে আশান্বিত করে। সবার প্রিয় রায়হান হয়তো ফিরে আসবেন! কিন্তু বিকাল সাড়ে ৪টার পরে তার ব্লিডিং হতে থাকে এবং জিসিএস স্কোর কমতে থাকে। আবার রাত ১০টার দিকে তার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। ৭ আগস্ট সকালে জিসিএস স্কোর ৬-এ নেমে আসে। রাত ১০টার দিকে তা আবার জিসিএস স্কোর ৮-এ উন্নীত হয়। পরের দিন ৮ আগস্ট সকালে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তাকে ঢাকায় নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সেদিন সকাল থেকেই রায়হান আলীর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। জিসিএস স্কোর ১-এ নেমে আসে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। এভাবে চলতে চলতে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় রায়হান আলী সকলকে কাঁদিয়ে চির বিদায় নেন। নিভে যায় দেশে ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে চাওয়া মহান আল্লাহর একজন সৈনিকের জীবন প্রদীপ। ৯ আগস্ট রাজশাহী কলেজে বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর শহীদ রায়হান আলীর মরদেহ নেওয়া হয় গ্রামের বাড়ি পুঠিয়ার মঙ্গলপাড়া গ্রামে। সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত হন সকলের প্রিয় শহীদ রায়হান আলী। শহীদ রায়হানের শোকাহত পরিবার রায়হান আলীর শহীদ হওয়ার খবরে এক গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে তার পরিবারে। পরোপকারী নিরহংকার তরতাজা যুবক ছেলের মৃত্যু যেন সইতে পারে না পরিবারটি। ২৭ বছর বয়সী শহীদ রায়হান আলী ছিলেন অমায়িক একজন মানুষ। ছোট থেকেই ছিলেন বিনয়ী, নম্রভদ্র, সচ্চরিত্রবান ও মেধাবী। রায়হানের ছোট ভাই ইন্টারমিডিয়েট শেষ করা রানা ইসলাম বলেন, "ভাইয়া আমায় অনেক ভালোবাসতেন, খেয়াল রাখতেন। ভাইয়া সব সময় পড়ালেখার খোঁজ নিতেন। আজ আমার ভাই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আমি ভাই হত্যার সঠিক বিচার চাই।" "আমার কোনো মেয়ে নাই। কিন্তু আমার বড় ছেলেটা মেয়ের অভাব পূরণ করত। রায়হান বাড়িতে আসলেই আমার জামাকাপড় পরিষ্কার করে দিত। হাতের নখগুলো কেটে দিত। আমার সোনার ছেলেকে ওরা কীভাবে গুলি করতে পারলো?" কান্না জড়িত কন্ঠে কথাগুলো বলছিলেন শহীদ রায়হান আলীর পিতা মোঃ মোসলেম উদ্দিন। বাড়ির ১৩ শতক জমি ছাড়া আর তেমন কিছু নেই তার। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করেন। দরিদ্র কৃষক, বয়সটাও ৫৫ পার হয়ে গিয়েছে। দুই ছেলেকে নিয়ে তার কতই না স্বপ্ন। বড় ছেলে পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করবে, সংসারে সচ্ছলতা আসবে, তাকে আর এত রোদে পুড়ে কাজ করতে হবে না! কিন্তু সন্ত্রাসীদের একটি বুলেট কৃষক মোসলেম উদ্দিনের সমস্ত স্বপ্ন কেড়ে নিল। ছেলে হারানোর শোকে কাতর-বিধ্বস্ত শহীদ রায়হান আলীর মা রুকসানা বিবি বলেন, "যেদিন আমার রায়হান ফোন করে বলতো, 'মা আমি বাড়িতে আসবো।' ওইদিন সকালেই আমি রান্না করে বসে থাকতাম আর অপেক্ষা করতাম আমার রায়হান কখন বাড়িতে এসে মা বলে ডাক দিবে। আমার ছেলে রায়হান ছিল আমার শান্তি। ও বাড়িতে আসলে আমাদের হৃদয় ঠান্ডা হয়ে যেত। পড়াশোনার জন্য শহরে থাকতো, সেজন্য আমার বেটা অনেকদিন পর পর বাড়িতে আসতো। আমার রায়হান বাড়িতে এসে আর কখনো মা বলে ডাক দিবে না। আমি রান্না করে ওর জন্য খাবার নিয়ে বসে থাকলেও ওকে আর কখনো পাবো না।" এভাবেই ছেলে হারানোর শোক বুকে নিয়ে দিন কাটে শহীদ রায়হান আলীর বাবা-মায়ের। অসহায় বয়স্ক মা-বাবা আজও রায়হানের রুমে গিয়ে ছেলেকে না পেয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকেন। কাঁদতে থাকে শহীদ রায়হান আলীর পোষা বিড়ালটাও। এরুম থেকে ওরুমে খুঁজে বেড়ায় রায়হানকে। শহীদ রায়হান আলী আজও আমাদের হৃদয়ে জীবিত, কিন্তু বাস্তবতার নির্মমতায় আমরা তাকে আর কোনদিন ফিরে পাবোনা। শহীদ রায়হান সম্পর্কে অন্যান্য জনের বক্তব্য শহীদ রায়হান আলীর রুমমেট হাসিবুর রহমান বলেন, "রায়হান আলী ভাই খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। রুমমেট হিসেবে আমরা দীর্ঘদিন একসাথে ছিলাম। তার স্মৃতি আমার প্রতিনিয়ত মনে পড়ে। তিনি আল্লাহভীরু একজন মানুষ ছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে মসজিদে গিয়ে আদায় করার চেষ্টা করতেন। জুমার দিন তিনি খুব দ্রুত মসজিদে চলে যেতেন। আল্লাহতায়ালা ভাইকে শহীদ হিসেবে কবুল করুন।" অন্য এক রায়হান শহীদ রায়হান আলী ছিলেন ইসলামী ছাত্র শিবিরের একজন জনপ্রিয় নেতা। তার নেতৃত্বের গুণ ছিল অত্যন্ত প্রখর। তাই সহজেই সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন তিনি। তিনি তার শাখার শিবিরকে নিয়ে গিয়েছিলেন এক অনন্য উচ্চতায়। শিবিরের বিভিন্ন মিছিল, মিটিং প্রোগ্রামের নেতৃত্ব ভাগে থাকতেন তিনি। তার নেতৃত্বে চলতো সব আয়োজন। শিবিরের কেউ যাতে কখনো কোনো অন্যায়, অপকর্মে, অশ্লীলতায় লিপ্ত হতে না পারে, সে দিকে ছিল তার সজাগ দৃষ্টি। তিনি শিবিরকে সবসময় কলুষতা মুক্ত রাখতে নিজের জীবন বাজি রাখতেন। শিবিরের প্রতিটি সদস্যকে ইসলামের সঠিক আদর্শে গড়ে তুলতে নিরলস প্রচেষ্টা চালাতেন। তিনি নিজে কখনো কোনো অন্যায়-অপকর্মে লিপ্ত হতেন না এবং তার সাথীদেরকেও লিপ্ত হতে দিতেন না। তিনি চাইতেন আল্লাহ ও রাসূল (সা)-এর ভালোবাসায় নিজেকে, নিজের বন্ধুবান্ধব, নিজের সংগঠনের সদস্যদেরকে সিক্ত করতে। চাইতেন নিজের সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নীতি ও আদর্শের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত করতে। এজন্য ছিল তার নিরলস প্রচেষ্টা। তাইতো সব সময় ইসলামের আদর্শ পথে অবিচল থাকতেন।। অন্যায়ের সাথে কখনো আপস করতেন না। তিনি এই সংগঠনের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে এমন অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন যে, ৯ই আগস্ট তার জানাযায় তুমুল বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাজশাহী কলেজ প্রাঙ্গনে হাজার হাজার মানুষের স্থিতি তার প্রমাণ। ইসলামের মহান আদর্শের এই সৈনিককে ওপারে আল্লাহ জান্নাতুল ফেরদাউসের মেহমান বানিয়েছেন-সেই আশা এবং দোয়া আমাদের সকলের। শহীদ রায়হানের ব্যক্তিগত প্রোফাইল নাম : মো: রায়হান আলী জন্ম তারিখ : ২০.১০.১৯৯৭ শহীদ হওয়ার তাং ও সময় : ৮ আগস্ট, ২০২৪; সন্ধ্যা ৬:৩০টা শহীদ হওয়ার স্থান : রাজশাহী মেডিকেল কলেজ আঘাতের ধরন : মাথায় গুলিবিদ্ধ গুলিবিদ্ধের তাং ও সময় : ৫ আগস্ট ২০২৪; দুপুর ০১:৩০টা গুলিবিদ্ধের স্থান : আলুপট্টি, রাজশাহী হত্যাকারী : সন্ত্রাসী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী সমাধিস্থল : মঙ্গলপাড়া, পুঠিয়া, রাজশাহী পেশা : ছাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী শিক্ষাগত যোগ্যতা : এমবিএ (উত্তীর্ণ) পিতা : মো: মুসলেম উদ্দিন মাতা : মোছা: রুকসানা বিবি স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: মঙ্গলপাড়া, ইউনিয়না: শিলমাড়িয়া, থানা: পুঠিয়া, জেলা: রাজশাহী বাড়িঘর ও সম্পদ : ১৩ শতক জমিতে একটি বাড়ি। পিতার কৃষিকাজ ভাইবোন : ১ ভাই। রানা ইসলাম। বয়স ২১। ছাত্র শহীদ পরিবারের জন্য সহযোগিতা সংক্রান্ত প্রস্তাবনা ১. তার বাবার জন্য নিজস্ব কৃষি জমির ব্যবস্থা করা ২. তার ছোট ভাইয়ের পড়াশোনার ব্যবস্থার পাশাপাশি একটি চাকরির ব্যবস্থা করা ৩. শহীদ পরিবারকে নিয়মিত আর্থিক সহযোগিতা করা