জন্ম তারিখ: ১ মার্চ, ১৯৯৪
শহীদ হওয়ার তারিখ: ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
বিভাগ: চট্টগ্রাম
পেশা : আইনজীবী, শাহাদাতের স্থান : চট্টগ্রাম কোর্ট, ইসকনের সদস্যরা কোপিয়ে ও গলা কাটে হত্যা করে।
অনাগত সন্তানের মুখ দেখে যেতে পারলেন না অ্যাডভোকেট আলিফ” ১৯৯৪ সালের মার্চের ১ তারিখ জন্যগ্রহণ করেন সাইফুল ইসলাম আলিফ। তার বাবার নাম মো: জামাল উদ্দিন ও মায়ের নাম হোসনে আরা বেগম। সম্প্রতি চট্টগ্রাম আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর নিযুক্ত হয়েছিলেন সাইফুল ইসলাম আলিফ (৩৫)। অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফের (৩৫) তাসকিয়া নামের তিন বছরের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। তার স্ত্রী ইসরাত জাহান তারিন চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। দ্বিতীয় সন্তানের অপেক্ষায় ছিলেন আলিফ এবং তারিন দম্পতি। বিন্তু চট্টগ্রামে সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিনায় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার সময় বাধাদানকারী ইসকন সর্মথকদের হামলায় ২৬ নভেম্বর মঙ্গলবার নিহত হন অ্যাডভোকেট আলিফ। ফলে অনাগত সন্তানের মুখ আর দেখে যেতে পারলেন না তিনি। সাত ভাইবোনের মধ্যে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ চতুর্থ। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি এলাকার বাসিন্দা ছিলেন নিহত সাইফুল ইসলাম আলিফ। ২০১৮ সাল থেকে চট্টগ্রামে প্রাকটিস শুরু করেন এবং পরবর্তী সময়ে হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে নিবন্ধিত হন। শাহাদাতের প্রেক্ষাপট জুলাই বিপ্লবের পরে শেখ হাসিনাসহ তার সন্ত্রাসী বাহিনী ভারতে পালিয়ে যায়। হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার সহযোগী সংগঠনগুলো দেশ বিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত বরাতে চেষ্টা করে। ইসকন ফুল ভারতের আশির্বাদপুষ্ট হিন্দুদের একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। শেখ হাসিনা ইসকনকে ব্যবহার করা শুরু করে। তারা রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়। তাদের একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অবমাননা করে। জাতীয় পতাকার অবমাননার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে কারাগারে নিয়ে যাওয়না সময় বাধাদানকারী ইসকন সমর্থকদের হামলায় নিহত হন সাইফুল ইসলাম আলিফ। মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে কোতোয়ালীর রঙ্গম সিনেমা হলের পাশের মেঘর পট্টি থেকে আহত অবস্থায় ওই আইনজীবীকে উদ্ধার করা হয়। পরে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। প্রত্যক্ষদর্শী মোঃ হাসান নামে এক আইনজীবী বলেন, পুলিশ ও আইনজীবীদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের মধ্যে আইনজীবী আলিফকে বিক্ষোভকারীরা কোপায়। পরে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। অথচ নিহত আলিফ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের মামলার সাথে যুক্তই ছিলেন না বলে নিশ্চিত করেছেন আইনজীবীরা। কাজ শেষে আদালত থেকে বাড়ি ফেরার পথে এ হত্যাকান্ডের শিকার হন সাইফুল ইসলাম। ইসকন সন্ত্রাসীরা তার গলা কেটে ফেলে। পরদিন সকালে চট্টগ্রামের আদালত প্রাঙ্গণে একটি জানাজা এবং জামিয়াতুল ফালাহ মসজিদে আরেকটি জানাজা হয়েছে নিহত আলিফের। পরে জামিয়াতুল ফালাহ মসজিদের দ্বিতীয় জানাজায় ভূমি উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ, চট্টগ্রামের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন, জামায়াতে ইসলামীর চট্টগ্রাম নগরীর আমীর শাহজাহান চৌধুরী এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমসহ প্রচুর মানুষ অংশ নেন। বিকেলে গ্রামের বাড়ি চুনতিতে দাফন করা হয় নিহত আলিফকে। চিন্ময়ের গ্রেফতারের পূর্ববর্তী ঘটনা কেন চিন্ময়কে গ্রেফতার করা হলো? অনেকের মনে প্রশ্ন। প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল-স্বৈরাচারী সরকার আওয়ামীলীগকে ব্যবহার করে যারা নানাবিধ অপকর্ম করেছিল, মুসলিমদের লাঞ্চনা ও নির্যাতন করেছিল, হামলা, মামলা, গুম, খুনের মাধ্যমে ঘর ছাড়া করেছিল, তাদের সম্পদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জমি, হাসপাতাল প্রভৃতি দখলের সাথে যে অংশ জড়িত ছিল তারা বাংলাদেশের কিছু সংখ্যক হিন্দু জনগোষ্ঠী। এরা আওয়ামীলীগকে ব্যবহার করে লাভবান হয়েছিল। তাই স্বাভাবিক ভাবে স্বৈরাচার সরকার পালিয়ে যাওয়ায় মজলুমরা তাদের নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে আসার পরে ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের আশ্রয়ে অপকর্ম করে বেড়ানো নির্যাতক স্থানীয় সন্ত্রাসীরা কোনঠাসা হয়ে পড়ে। অন্যায়ভাবে দখলকৃত সম্পদ ফেরত দিতে বাধ্য হয়। ভারতীয় মিডিয়া হিন্দু নির্যাতন করা হচ্ছে বলে এটাকে বাজেভাবে উপস্থাপন করা শুরু করে। ভারত ও আওয়ামীলীগ ইসকনকে ইশারা দেয় আন্দোলন শুরু করতে। ইসকন দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু নির্যাতন হচ্ছে আওয়াজ তুলে আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা করে। চিন্ময় এর নেতৃত্ব প্রদান করেন। ইসকন এর পরিচয় ও নানাবিধ বিতর্ক ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস (ইসকন), যা সাধারণভাবে হরে কৃষ্ণ আন্দোলন নামে পরিচিত। মূলত গৌড়ীয় বৈষ্ণব হিন্দু সংগঠন হিসেবে পরিচিত ইসকন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৬ সালের ১৩ জুলাই নিউইয়র্ক সিটিতে এ সিং ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের মাধ্যমে। এর লক্ষ্য ছিল বিশ্বব্যাপী কৃষ্ণ চেতনা ছড়িয়ে দেওয়া। তবে, ইসকনের কার্যক্রমগুলো সবসময় বিতর্কমুক্ত ছিল না। অভ্যন্তরীণ সমস্যা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ এবং হিন্দু ধর্মের শিক্ষার ভুল ব্যাখ্যা দেওয়ার অভিযোগ নানা সময়ে উঠে এসেছে, যা সংগঠনটির বিরুদ্ধে একটি জটিল এবং প্রায়শই বিতর্কিত জনমত তৈরি করেছে। বিতর্ক ও অভিযোগ ১। হিন্দু ধর্মগ্রন্থের ভুল ব্যাখ্যার অভিযোগ ইসকনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের। একটি সমালোচনা হলো তাদের দ্বারা হিন্দু ধর্মগ্রন্থের প্রচলিত ব্যাখ্যার পুনঃবিবেচনা করা হচ্ছে। সমালোচকরা দাবি করেন, ইসকনের গ্রন্থগুলোতে কৃষ্ণকে সর্বোচ্চ দেবতা হিসেবে তুলে ধরা হয়, যেখানে শিব ও দুর্গার মতো অন্যান্য দেবতার অবমূল্যায়ন করা হয় এবং তাদের 'অর্ধদেবতা' হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ২। যুক্তরাষ্ট্রে মানসিক প্রভাব বিস্তার ও আইনি মামলা: ১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকে, ইসকন যুক্তরাষ্ট্রে 'ব্রেনওয়াশিং' বা মানসিক প্রভাব বিস্তার, অবৈধভাবে কারাগারে রাখা এবং তরুণ ভক্তদের অপহরণের অভিযোগে বিভিন্ন আইনি জটিলতায় পড়ে। ১৯৭৬ সালের চবড়ঢ়ষব া. গঁৎঢ়যু মামলায় নিউ ইয়র্ক আদালত হরে কৃষ্ণকে একটি বৈধ ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তবে পরবর্তী মামলাগুলো, যেমন ১৯৮৪ সালের এবড়ৎমব া. ওঝকঈঙঘ, সংগঠনের অভ্যন্তরে কথিত মানসিক প্রভাবের অভিযোগ তুলে ধরে। এই মামলায় এক তরুণী ইসকনে যোগ দেয় এবং অভিযোগ ছিল যে, ইসকন তার অবস্থান নিয়ে তার বাবা-মাকে বিভ্রান্ত করেছিল। মামলাটি বিভিন্ন রায়ের দিকে নিয়ে যায়; কিছু অভিযোগ - খারিজ করা হলেও শেষ পর্যন্ত ইসকন পরিবারটির মানসিক দুর্দশার জন্য দায়ী বলে সাব্যস্ত হয়। ৩। শিশু নির্যাতনের অভিযোগ: ১৯৯০-এর দশকে, ইসকনের অধীনস্থ বোর্ডিং স্কুলগুলোতে শিশু নির্যাতনের ব্যাপক অভিযোগ সামনে আসে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের ইসকন পরিচালিত স্কুলগুলোতে ১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকে অনেক শিশু শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিল বলে তদন্তে প্রকাশ পায়। বাংলাদেশে ইসকনের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপ; সমালোচকরা অভিযোগ করছেন যে, ইসকন আধ্যাত্মিক কর্মকান্ডের বাইরে গিয়ে রাজনৈতিক বিষয়ে অংশ নিচ্ছে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসকন বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশন থেকে আর্থিক সহায়তা পায়, যা দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিস্থিতিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। সমালোচকদের মতে, ইসকন বাংলাদেশে, হিন্দু সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের একটি বানোয়াট চিত্র তুলে ধরছে। তারা মনে করেন, এই চিত্রটি আন্তর্জাতিক সহানুভূতি এবং সমর্থন লাভের জন্য অতিরঞ্জিত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের কথা তুলে ধরে ইসকন আন্তর্জাতিক মতামত প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে এবং দেশটির ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। (ইনকিলাব, ২৮ নভেম্বর ২০২৪) পরিবারের বক্তব্য আলিফের বড় বোন জান্নাত আরা বেগম টিবিএসকে বলেন, আমার ছোট ভাই আলিফের তিন বছরের একটি কন্যা সন্তান আছে। সে অকালে তার বাবাকে হারিয়েছে। অনাগত সন্তানও তার বাবার মুখ দেখবে না। আবার ভাইয়েরও তার দ্বিতীয় সন্তানকে দেখার সৌভাগ্য হলো না। এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে। জামাল উদ্দিন বলেন, "আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। যারা আমার ছেলেকে এমনভাবে মেরেছে আমি আল্লাহর কাছে তাদের বিচার দিলাম। আল্লাহ যেন তাদের বিচার করেন।" চট্টগ্রাম আদালতের সহকর্মীরা বলেন, অ্যাডভোকেট আলিফ পেশাগত জীবনে খুবই সৎ ছিলেন। তার এমন মৃত্যু আমরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারছি না। আলিফের ভাগিনা তাসলিমুল হাসান বলেন, আমার মামা খুবই ভালো ছিলেন। যখন আমার সাথে দেখা হতো পাড়াশোনা থেকে শুরু করে সব খোঁজ-খবর নিত। আমার মামাকে যারা হত্যা করেছে আমরা তাদের ফাঁসি চাই। শহীদ ব্যক্তিগত প্রোফাইল নাম : সাইফুল ইসলাম আলিফ পেশা : আইনজীবী বাবা : জামাল উদ্দিন মা : হোসনে আরা বেগম স্ত্রী : ইসরাত জাহান তারিন স্থায়ী ঠিকানা : ফারেঙ্গা, এম চর হাট, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম ঘটনার স্থান : চট্টগ্রাম কোর্ট আক্রমণকারী : ইসকন আহত হওয়ার সময় : ২৬ নভেম্বর, মঙ্গলবার, বিকাল আঘাতের ধরন : কোপানো ও গলা কাটা মৃত্যুর তারিখ ও সময়, স্থান : ২৬ নভেম্বর, মঙ্গলবার, বিকাল শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : চুনতি, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম প্রস্তাবনা : ১. সন্তানদের ভরণপোষণ ও লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা