জন্ম তারিখ: ২০ জুলাই, ২০০৮
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: রাজশাহী
পেশা : শিক্ষার্থী,অবসরে একটি মোবাইল সার্ভিসিং-এর দোকানে কাজ শিখতো, শাহাদাতের স্থান : গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
“মা, তুমি গ্রামে চলে যাও, আমি টাকা পাঠাব” "আব্বা, আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে, আমাকে খাবার দাও!" শহীদ মো: খোকন সরদারের গ্রামের বাড়ি পাবনার নেউলাইপাড়া। পিতামাতার স্বপ্ন ছিল তাকে পবিত্র কুরআনের হাফেজ বানাবেন। তাই শহীদ খোকনকে ভর্তি করানো হয়েছিল মানিকনগর হাফিজিয়া মাদ্রাসায়। অবসরে একটি মোবাইল সার্ভিসিং-এর দোকানে কাজ শিখতো। ২০ পারা কুরআন মুখস্ত করতে পেরেছিল সম্ভাবনাময় এই কিশোর। বোন ও কাজিনদের মধ্যে একমাত্র ছেলে খোকনকে সবাই ভালোবাসতো। এজন্যই নাম রাখা হয়েছিল খোকন।খোকনের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ছিল সংকটাপন্ন। সরকারি খাস জমিতে ছোট্ট বাড়ি। তাঁর পিতা-মাতা দুজনেই আশুলিয়ায় গার্মেন্টসে কাজ করতেন। খোকনের ছোটো দুই বোন আজমিন (৮) ও হুমায়রা (৬), ঢাকায় থাকতো। বৃদ্ধা দাদি থাকেন গ্রামে। পরিবারটি শহীদ খোকনকে একজন প্রখ্যাত আলেম বানানোর স্বপ্ন দেখতেন। বর্তমানে শহীদের পিতা-মাতার কর্মস্থল বন্ধ অবস্থায় আছে। এখন তাদের কোনো আয়ের উৎস নেই। চাকরি হারিয়ে স্বপরিবারে পাবনায় গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন শহীদের পিতা-মাতা। তাদের দুটি ছোটো মেয়ে আছে, যারা ঢাকায় একটি স্কুলে পড়তো। কিন্তু গ্রামে ফিরে আসার পর এখনো তাদের কোনো স্কুলে ভর্তি করানো সম্ভব হয়নি। ঘটনার বিবরণ জুলাই মাস থেকেই চলছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ছাত্র-জনতার স্লোগানে উচ্চারিত হচ্ছিল অধিকারের কথা। কেউ অধিকার চাইতে গিয়ে কেউ জীবিকার তাগিদে বাইরে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরছিল। ছাত্র, শিক্ষক, আলেম, শ্রমিক, রিকশাচালক, ভিক্ষুক, শিশু-বৃদ্ধ কেউই বাদ যায়নি এ লাশের মিছিল থেকে। ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘লং মার্চ টু ঢাকা’-র ডাক দেয়। সকালে মসজিদের মাইক থেকে বারবার লং মার্চে অংশ নিতে ডাকা হচ্ছিল। প্রতিদিনের মতো এ দিনও মাদ্রাসার ছাত্ররা আন্দোলনে যোগ দেয়। খোকনও মাদ্রাসার ছাত্র। মাদ্রাসার সহপাঠীদের সঙ্গে ছিল নিবিড় সম্পর্ক। তাই এ আন্দোলন দেখে সে ঘরে বসে থাকতে পারেনি। খোকন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সাথে আন্দোলনে যোগ দেয়। শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বাইপাইল মোড়ে অবস্থান নেয়। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার দলীয় পুলিশ আন্দোলন ভণ্ডুল করতে বিনা উস্কানিতে নির্বিচারে গুলি চালায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মরণঘাতী একটি বুলেট খোকনের পেটে ঢুকে পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ১৬ বছরের এই নির্ভীক তরুণ। ততক্ষণাৎ শিক্ষার্থীরা খোকনকে হাবিব হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তাররা তাকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে স্থানান্তর করেন। সেখানে প্রথমে তাকে স্যালাইন দেওয়া হয়। স্যালাইন দেওয়ার সময় খোকন বাবাকে বলেছিল, "আব্বা, আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে, আমাকে খাবার দাও!" কিন্তু স্যালাইন থাকার কারণে তাকে খাবার দেওয়া সম্ভব হয়নি। এরপর মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যেই শহীদ খোকনের জীবন প্রদীপ নিভে যায়। শহীদ খোকন শেষ ক্ষুধাটাও নিবারণ করতে পারেনি। তার আগেই মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়েছে। হাফেজ এই কিশোর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে দুপুর ১২:৩০ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শহীন হন। শহীদের লাশ গ্রামের বাড়ি নেওলাইপাড়া দারুল বাকি কবরস্থানে দাফন করা হয়। খোকনের বাবা আজিজুল হক সরদার বলেন, "আল্লাহ আমাকে ধৈর্য দিয়েছিলেন। আমার ছেলের শেষ কথা ছিল, 'আব্বু, আমার ক্ষুধা লেগেছে।' আমি একজনকে দোকান থেকে খাবার আনতে বললাম, কিন্তু নার্স বলল, স্যালাইন লাগানো আছে, খাবার দেওয়া যাবে না। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার আমাকে বললেন, 'আপনার ছেলে মারা গেছে।' আমি হাত তুলে দোয়া করলাম- 'আল্লাহ, তোমার দেওয়া জিনিস তুমি নিয়ে গেছো, আমার কিছু করার নেই।” খোকনের মা খুশি খাতুন প্রতিদিন ছেলের কথা মনে করে কাঁদেন। তিনি বলেন, "আমি অসুস্থ ছিলাম, আর কাজ করতে পারছিলাম না। খোকন আমাকে বলতো, 'মা, তুমি গ্রামে চলে যাও, আমি টাকা পাঠাব।' কিন্তু আজ আমার ছেলেই নেই।" এভাবেই শহীদ হলো খোকন, চলেন গেল চিরতরে, রেখে গেলো পরিবার অশ্রু আর বেদনার দীর্ঘ গল্প। শহীদ খোকনের দাদা আব্দুল হাই সরদার বলেন, “খোকন আমার বংশের একমাত্র নাতি, ওর মৃত্যুর কথা শুনে আমি ওখানেই বেহুশ হয়ে পড়ে যাই। ভাবতাম আমি মারা গেলে আমার নাতি আমার জানাজা পড়াবে, আমার জন্য দোয়া করবে। কিন্তু ওর জানাজাই এখন আমার পড়তে হলো। আমি একজন শহীদের দাদা, এজন্য গর্ববোধ করি। কিন্তু ওর কথা মনে হলে তো ঠিক থাকতে পারি না, এ কষ্টের কথা ক্যামনে বুঝায়ে বলবো?” শহীদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নাম : মো: খোকন সরদার জন্ম তারিখ : ২০. ০৭. ২০০৮ জন্মস্থান : নেওলাইপাড়া, বেড়া, পাবনা পেশা : শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : মানিকনগর হাফিজিয়া মাদ্রাসায় আহত হবার স্থান : সাভার বাইপাইল মোড় (আশুলিয়া থানার সামনে) শহীদ হবার স্থান : গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আঘাতের ধরণ : গুলিতে জখম আক্রমণকারী : ঘাতক পুলিশ আহত হবার সময় ও তারিখ : সকাল ১০.৩০ মিনিট; ৫ আগস্ট ২০২৪ শহীদ হবার সময় ও তারিখ : দুপুর ১২.৩০ মিনিট; ৫ আগস্ট ২০২৪ শহীদের কবরস্থান : নেওলাপাড়া দারুল বাকি গোরস্থান, পাবনা স্থায়ী ঠিকানা ও বর্তমান ঠিকানা : গ্রাম: নেওলাইপাড়া, ইউনিয়ন: নতুন ভারেঙ্গা, থানা: বেড়া, জেলা: পাবনা পরিবারসংক্রান্ত তথ্য পিতা : মো: আজিজুল সরদার পিতার পেশা ও বয়স : বেকার, ৩৯ বছর মাতা : মোছা: খুশি খাতুন মাতার পেশা ও বয়স : গৃহিণী, ৩২ বছর শহীদের সাথে সম্পর্ক : পিতা পরিবারের বর্তমান সদস্য সংখ্যা : ৫ জন পরিবারের অন্যান্য সদস্য বোন: আজমিন, বয়স ও পেশা: ৯ বছর, শিক্ষার্থী (১ম শ্রেণি) বোন: হুমায়রা, বয়স ও পেশা : ৬, শিক্ষার্থী (প্লে) পরামর্শ ১. শহীদের বাবার জন্য একটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা ২. পরিবারের জন্য একটি ঘর নির্মাণ করে দেওয়া ৩. শহীদের ছোটো দুই বোনের পড়ালেখার ব্যবস্থা করা ৪. শহীদের মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা