জন্ম তারিখ: ২ জানুয়ারি, ২০০২
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: রাজশাহী
পেশা : ঢাকায় চাকরি করতেন, শাহাদাতের স্থান : শফিপুর আনসার একাডেমী, গাজীপুর
“ আমি যখন তাকে কবরে নামাই তখন আমার হাত রক্তে ভিজে যায়। তার মুখে অনেকগুলো গুলি লেগেছিল ” - শহীদের চাচাতো ভাই শহীদ মো: অন্তর ইসলাম সিরাজগঞ্জ জেলার কৈজুরী হাট ইউনিয়নের কৈজুরী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ২০০২ সালের ২ জানুয়ারি। পিতাঃ মো: আব্দুল হক (৬৫) এবং মাতা: মোছা: জয়নব খাতুন (৬০)। শহীদ অন্তর ছিলেন সংগ্রামী জীবনের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি। তিনি নিজের পড়াশোনা ও পরিবার চালানোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন। সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর থানার কৈজুরী গ্রামের মেধাবী ছাত্র মোঃ অন্তর ইসলাম যমুনা নদীর তীর ঘেঁষে বসবাস করতেন। নদী যেমন মানুষের জীবনে অনেক কিছু বয়ে আনে তেমনি কত শত মানুষের স্বপ্ন ও সম্ভাবনাও কেড়ে নেয়। ২০০৭ সালে যমুনা নদীর ভাঙ্গনে তাদের মূল বাড়ি ভেঙে যায় এবং পরিবারকে স্থানান্তরিত হতে হয় নতুন জায়গায়। কৃষি কাজের জন্য তাদের কোনো জমি ছিল না, ছিল না কোনো গবাদিপশুও। একমাত্র আয়ের উৎস ছিল অন্তর ইসলাম। শাহজাদপুর সরকারি কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হিসেবে পড়াশোনা করছিলেন। পরিবারের খরচ চালানোর জন্য তিনি ঢাকায় চাকরি করতেন। ঢাকা থেকে পরীক্ষার সময় এসে পরীক্ষা দিয়ে আবার ঢাকায় চলে যেতেন। পরিবারের খরচ ও নিজের পড়াশোনার খরচ তিনি নিজেই উপার্জন করতেন। দুই ভাই ও চার বোনের পরিবারে বড় ভাই আলাদা এবং বোনদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ৫ আগস্ট দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা অর্জন করে। বিজয় মিছিলের ওপর আনসার সদস্যরা গুলি করলে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। শাহাদতের প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ঘৃণিত খুনি হাসিনা সরকারের পতনের দাবিতে উত্তাল সারাদেশ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের ডাকে সমগ্র বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে আসে। মাদার অফ মাফিয়া খ্যাত খুনি হাসিনা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ক্রাকডাউন চালানোর নির্দেশ দেয় আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, পুলিশ, বিজিবিসহ সকল পর্যায়ের শৃংখলার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীকে। তবুও উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকাসহ পুরো দেশ। ৪ আগস্ট ২০২৪ সাল। আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া গুলিবর্ষণ শুরু করে। রাবার বুলেট, টিয়ারসেল নিক্ষেপ, স্নাইপার দিয়ে বহুতল ভবন এবং হেলিকপ্টার হতে গুলি বর্ষণ শুরু করে হাসিনার পেটুয়া বাহিনী। এদিন পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেটে আহত হন শহীদ অন্তর। ৫ই আগস্ট জনগণের চূড়ান্ত বিজয় সাধিত হয় এবং পতিত স্বৈরাচার তাদের আশ্রয়দাতা ভারতের দিল্লিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এদিন অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও বিজয় মিছিলে অংশগ্রহণ করেন শহীদ অন্তর ইসলাম। বিজয় মিছিল সফিপুর আনসার একাডেমির দিকে অগ্রসর হতে থাকলে আনসার সদস্যরা বিজয় মিছিলের ওপর এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। পুলিশের ছোড়া গুলি এবং রাবার বুলেট এসে লাগে অন্তর ইসলামের মাথায়, মুখে এবং গলায়। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে তার লাশের কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। পরবর্তীতে খোঁজ নিলে হাসপাতালে তার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়। শহীদের স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের প্রতিক্রিয়া সদাহাস্য ও বন্ধুপ্রিয় শহীদ অন্তর ইসলামের অকাল মৃত্যুতে আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবরা গভীরভাবে মর্মাহত। শহীদ অন্তর ইসলামের বন্ধু হাবিবুল বাশার বলেন, ”অন্তর খুব ভালো একটা ছেলে। যখন বাড়িতে থাকতো আমরা বিকালে একসাথে ঘুরতে বের হতাম। সে জীবিকার তাগিদে ঢাকা চলে গিয়েছিল। সেখানে সে নিয়মিত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করত। ৪ তারিখ রাতেও তার সাথে আমার অনেক কথা হয়েছে কিন্তু সে তো বলেনি যে তার রাবার বুলেট লেগেছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম তুমি কি আন্দোলনে যাও? সে বলল 'হ্যাঁ, যাই বললাম, আন্দোলনে গেলেও সাবধানে থেকো। শহীদ অন্তর আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল। আমরা তার হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই। চাচতো ভাই আসাদ আলী বলেন শহীদ অন্তর খুব ভালো ছেলে ছিল। কারো সাথে কোনো প্রকার ঝামেলা সে করত না। পাঁচ বছরের ছোট ভাগ্নে ফয়সাল আহাম্মেদ বলেন, মামার জন্য তার এখন অনেক কষ্ট লাগে। এক রাতে সে স্বপ্ন দেখেছিল তার মামা এসে তাকে বলছে, মামা, তুমি কষ্ট পেয়ো না, একদিন তোমার সাথে আমার দেখা হবে। সন্তানের মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর থেকে বৃদ্ধ বাবা দুই দু'বার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। শহীদের পরিবার সংক্রান্ত বিশেষ তথ্য শহীদ মো: অন্তর ইসলাম ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ৬৫ বছরের বৃদ্ধ বাবা পূর্বে গাছের ব্যবসা করলেও বর্তমানে পুরোপুরি বেকার। বৃদ্ধ মা মাসিক ৩০০ টাকা করে ৬ মাস অন্তর অন্তর বয়স্ক ভাতা পান। বৃদ্ধ বাবা-মা দুজনেই অসুস্থ এবং বৃদ্ধ পিতা কানে কম শোনেন। আর্থিক দৈন্যদশায় পতিত এই পরিবারটি শহীদ অন্তর ইসলামের আয়ের টাকাতে কোনোমতে চলতো। ২০০৭ সালের বন্যায় তাদের পুরাতন বাড়ি নদীতে ভেসে যায়। শত কষ্ট করে একটুকরো জমি কিনে নতুন বাড়ি তৈরি করেছেন এবং সেখানেই পরিবারসহ বসবাস করতেন শহীদ। উপার্জনক্ষম ব্যক্তি শহীদ হওয়ায় বৃদ্ধ পিতা-মাতা বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। উপার্জনহীন বৃদ্ধ বাবা মা অসুস্থ। তাদের জন্য নিয়মিত ভাতার ব্যবস্থা করা দরকার। ব্যক্তিগত প্রোফাইল নাম : মো: অন্তর ইসলাম পিতা : মো: আব্দুল হক (৬৫) মাতা : মোছা: জয়নব খাতুন (৬০) জন্ম তারিখ : ২রা জানুয়ারি ২০০২ স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম-কৈজুরী, ইউনিয়ন: কৈজুরী হাট, থানা: শাহজাদপুর জেলা: সিরাজগঞ্জ বর্তমান ঠিকানা : কৈজুরী ৪ নং ওয়ার্ড, শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ আহত হওয়ার স্থান : শফিপুর আনসার একাডেমী, গাজীপুর আহত হওয়ার সময় কাল : ৫ই আগস্ট, ২০২৪, বিকাল ৪টা ৩০ মিনিট শহীদ হওয়ার সময় ও স্থান : ৫ই আগস্ট, ২০২৪, বিকাল ৪টা ৩০ মিনিট। শফিপুর একাডেমী, গাজীপুর যাদের আঘাতে শহীদ : আনসার সদস্যের গুলিতে নিহত সর্বশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : শাহজাদপুর সরকারি কলেজ, সিরাজগঞ্জ, তৃতীয় বর্ষ, ইতিহাস কর্ম প্রতিষ্ঠান : পড়াশোনার পাশাপাশি অ্যাপেক্স কোম্পানিতে চাকরি করতেন পরামর্শ ১. বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জন্য নিয়মিত ভাতা প্রদান করা আবশ্যক ২. শহীদের বৃদ্ধ বাবা-মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা ৩. নিয়মিত খোঁজখবর রাখা দরকার