জন্ম তারিখ: ১১ ডিসেম্বর, ১৯৮৮
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৪ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: রাজশাহী
পেশা : দিনমজুর, শাহাদাতের স্থান : এনায়েতপুর, সিরাজগঞ্জ
ইয়াহিয়া আমার ভাতিজা। সে খুবই ভালো মানুষ ছিল। সে ভালোভাবে কাজ করে দিনাতিপাত করত। ৪ আগস্ট সে আমাদের সাথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে ” - শহীদের চাচা আলী আকবর শহীদ মো: ইয়াহিয়া আলী সিরাজগঞ্জ জেলার খুকনি এনায়েতপুরের খুকনি ঝাউপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৮৮ সালের ১১ ডিসেম্বর । পিতা মো: শাহজাহান আলী (৭২), মাতা মোছা: চামেলী খাতুন (৬২) এবং স্ত্রী শাহানা (৩০) । শহীদ মোঃ ইয়াহিয়া আলী এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। ছেলে সালমান ফারসি কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। মেয়ে তাইমা খাতুন নুরানী মাদ্রাসার তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। শহীদ ইয়াহিয়া বাবা ও ভাইয়ের সাথে তাঁতকলে তাঁত বুনতেন। বিগত প্রায় ২০ বছর যাবত তিনি কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। শহীদ ইয়াহিয়া আলী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ৪ আগস্ট এনায়েতপুর থানার সামনে তিনি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে অবস্থান করছিলেন। দুপুর ১টা ১৫ মিনিটের দিকে পুলিশের গুলি তার ডান পাঁজরে বিদ্ধ হলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। স্থানীয় লোকজন তাকে নিকটবর্তী হাসপাতালে ভর্তি করলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। শাহাদতের প্রেক্ষাপট আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের প্রত্যেকের জীবন কাহিনী যেন একটাই। নিঃস্ব, রিক্ত ভুখা, নাঙ্গা মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। ১৯৭১ সালে জালিমশাহীর বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিল একটু সুখের আশায়। কিন্তু মানুষ সেই কাঙ্ক্ষিত সুখ, ব্যক্তি স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা, বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা, কল্যাণরাষ্ট্র কোনো কিছুরই দেখা পাননি। এসবের পরিবর্তে তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে জুলুমতন্ত্র, পেশি শক্তির দাপট আর সীমাহীন দুর্নীতি-অবিচার-দুরাচার। এসবের জন্য এদেশের মানুষ পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। আর খুনি হাসিনার সরকার তো পাকিস্তানি হানাদারদেরও হারিয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষদের এ সরকার গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে ফেলেছিল। তাইতো সর্বস্তরের মানুষ মুক্তির জন্য পাগলপারা হয়ে ওঠে। এদেশের আপামর জনসাধারণের দীর্ঘশ্বাসের কারণ হয়ে উঠেছিল এই ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার। যেকোনো মূল্যে তারা এই সরকারের পতন কামনা করছিল। কিন্তু কোন পথে মিলবে মুক্তি তা তাদের জানা ছিল না। তাই যেখানেই ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের লক্ষণ দেখা দিত সেখানেই জনতা সমবেত হতো। আর এই সঙ্ঘবদ্ধ জনতাকে জমের মতো ভয় করত মাফিয়া সরকার। টিয়ারসেল, রাবার বুলেট, গুম, খুন,হত্যা সরকারের টিকে থাকার হাতিয়ার হয়ে উঠছিল। সঙ্ঘবদ্ধ জনতা যেন খুনি সরকারের আতঙ্কের কারণ হয়ে দেখা দেয়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন একেবারে শেষের দিকে চলে আসে। মুক্তিকামী জনতা যেমন উপলব্ধি করেছিল সরকারের সময় শেষ হয়ে আসছে, দখলদার ফ্যাসিস্ট সরকারও উপলব্ধি করে তাদের সময়ও শেষ হয়ে আসছে। তাই যেকোনো আন্দোলন দমাতে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করত। ৪ঠা আগস্ট ছাত্র জনতার অসহযোগ আন্দোলন তুঙ্গে। বৈষম্যের শিকার ছাত্রদের সাথে এদেশের মুক্তিকামী জনতা একাত্মতা প্রকাশ করে। সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরের বীর জনতাও ঘরে বসে ছিলেন না। এদিন সকালবেলা খেয়ে না খেয়ে তারা ঘর হতে বেরিয়ে পড়েন। তাদের সাথে সকাল ১০:০০টার পূর্বেই আন্দোলনে যুক্ত হন শহীদ ইয়াহিয়া আলী। একপর্যায়ে অতর্কিতভাবে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে হাসিনার অনুগত পুলিশ বাহিনী। রাজপথ পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। একের পর এক লোকজন গুলিবিদ্ধ হতে থাকে। দুপুর একটার দিকে এনায়েতপুর থানার সামনে পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। একটি বুলেট এসে লাগে ইয়াহিয়া আলীর পাজরে। সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। রক্তে চারপাশ ভেসে যায়। আন্দোলনকারীরা তাকে স্থানীয় খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। শহীদের পরিবার সংক্রান্ত বিশেষ তথ্য শহীদ ইয়াহিয়া আলী ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। দিন আনি দিন খাওয়া পরিবারের কর্তাব্যক্তিকে হারিয়ে পরিবারটি এখন দৈন্যদশায় উপনীত হয়েছে। জীবন বাঁচানোর তাগিদে তার স্ত্রী এখন তাঁতকলে বিভিন্ন কাজ শুরু করেছেন। মাসিকভাবে তিনি অনিয়মিতভাবে প্রায় ছয় হাজার টাকা ইনকাম করছেন। এই কাজ স্থায়ী নয়। তাই কাজ বন্ধ থাকলে মাসিক আয়ও বন্ধ হয়ে যায়। মাঝে মাঝে দুই তিন মাসের জন্যও কাজ বন্ধ থাকে। তাদের বসবাসের ঘরটিও একটি খুপড়ি ঘর। ছোট্ট একটি ঘর তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন, এখন সেটাও অর্থ অভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শহীদ ইয়াহিয়া ১৩ বছর বয়সী একটি ছেলে এবং আট বছর বয়সী একটা মেয়ে রেখে গিয়েছেন। ছেলে এতিমখানায় এবং মেয়ে স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে। অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল এই পরিবারটি এখন নিদারুণ কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। স্থানীয় মেম্বার বলেন, ”তার পরিবারটি খুবই অসচ্ছল। যদি তাদের জন্য কোনো ব্যবস্থা করা যায় তাহলে ভালো হয়।” ব্যক্তিগত প্রোফাইল নাম : মো: ইয়াহিয়া আলী স্ত্রী : শাহানা (৩০) পিতা : মো: শাহজাহান আলী (৭২) মাতা : মোছা: চামেলী খাতুন (৬২) সন্তান : ছেলে: সালমান ফারসি, মেয়ে:তাইমা খাতুন (৩য় শ্রেনি) জন্ম তারিখ : ১১ ডিসেম্বর ১৯৮৮ স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: খুকনী ঝাউপাড়া, ইউনিয়ন: খুকনী, থানা: এনায়েতপুর, জেলা: সিরাজগঞ্জ বর্তমান ঠিকানা : খুকনী ঝাউপাড়া ১ নং ওয়ার্ড, এনায়েতপুর, সিরাজগঞ্জ আহত হওয়ার স্থান : এনায়েতপুর থানার সামনে, সিরাজগঞ্জ আহত হওয়ার সময় কাল : ৪ আগস্ট ২০২৪, দুপুর ২টা ১৫ মিনিট শহীদ হওয়ার সময় ও স্থান : ৪ আগস্ট ২০২৪, দুপুর ১টা ১৫ মিনিট, এনায়েতপুর, সিরাজগঞ্জ যাদের আঘাতে শহীদ : পুলিশের গুলিতে শহীদ পরিবারের ব্যাপারে করণীয় ১. ইট গাথা বাড়িটি সম্পন্ন করতে সহায়তা করা ২. ছেলে মেয়ের জন্য স্কলারশিপের ব্যবস্থা করা ৩. আনুমানিক এক লক্ষ টাকা মূল্যের স্টিলের পাওয়ার লুমের ব্যবস্থা করা