জন্ম তারিখ: ২৭ মার্চ, ২০০১
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: রাজশাহী
পেশা : যাত্রাবাড়ী পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডাক্তারের সহকারী , শাহাদাতের স্থান : যাত্রাবাড়ী থানার সামনে
ভাইটা ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই। আল্লাহ গরিবের ঘরে একটা সোনা দিয়েছিল ” - শহীদের বড় বোন শহীদ মো: শাকিল হাসান (মানিক) বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামে ২৭শে মার্চ ২০০১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা: মোকলেসার রহমান (৫০) দিনমজুর, মাতা: মোছা: শাহিনুর বেগম (৪৫) গৃহিণী। দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণকারী শহীদ শাকিল হাসান অনেক কষ্টে এইচএসসি পাশ করে পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার জন্য ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডাক্তারের সহকারী হিসেবে চাকুরী নেন। চাকরির পাশাপাশি তিনি সরকারি শাহ সুলতান কলেজে ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়ন করতেন। ৫ আগস্ট তিনি যাত্রাবাড়ীতে শিক্ষার্থীদের সাথে আন্দোলনে যোগদান করেন। বিকাল তিনটার দিকে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়া শুরু করলে শাকিল হাসান ফ্লাইওভারের নিচে আশ্রয় গ্রহণ করেন। শাকিল হাসান যখন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আশ্রয়ের জন্য সরে যাচ্ছিলেন পুলিশ তখন সরাসরি তার মাথায় গুলি করে। গুলিতে শাকিল হাসানের মাথার মগজ বেরিয়ে আসে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান ঘটনাস্থলেই শাকিল শাহাদাত বরণ করেন। ওই দিন রাত দেড়টায় শহীদ শাকিল হাসানের লাশ গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয় এবং সেখানেই তাকে দাফন করা হয়। শাহাদতের প্রেক্ষাপট মাদার অফ মাফিয়া খ্যাত আওয়ামী হায়েনা গোষ্ঠীর মধ্যমনি খুনি স্বৈরাচার হাসিনা দেশটাকে তার বাপের সম্পত্তি মনে করত। দেশের সাধারণ জনগণকে সে দাসতুল্য প্রজা মনে করত। তাই খুনি হাসিনার বিরুদ্ধে মুক্তিকামী মানুষের স্লোগান ছিল "দেশটা কারো বাপের নয়"। কাগজে কলমে দেশটা গণতান্ত্রিক বলে মনে করা হলেও দেশটিতে গণতন্ত্রের কোনো ছিটে ফোঁটাও ছিল না। এদেশের মানুষ অধিকার আদায়ে বারবার রাজপথে নেমে এসেছে কিন্তু নৃশংস রক্তখেকো খুনি হাসিনা অস্ত্র দিয়ে সেসব আন্দোলন দমন করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তার মসনদ কেঁপে ওঠে। মুক্তি প্রত্যাশী জনসাধারণ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতৃবৃন্দের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। গদি রক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠে চরম ক্ষমতা লোভী পতিত স্বৈরাচার খুনি হাসিনা। জুলাইয়ের উত্তাল আন্দোলন আগস্টের শুরুতে পরিসমাপ্তির দিকে ধাবিত হয়। হাসিনার নিশ্চিত পতন মানুষ টের পাচ্ছিল। তাইতো ৬ আগস্টের গণভবন ঘেরাও কর্মসূচি ৫ আগস্টে এগিয়ে আনা হয়। 'হয় বিজয় না হয় শাহাদতের মৃত্যু এমন প্রত্যয়দীপ্ত শপথে হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ ছাত্র জনতা সকাল হতেই মিছিলে মিছিলে রাজপথ প্রকম্পিত করে তোলে। সকাল থেকেই রাজপথে সরব ছিলেন শহীদ শাকিল হাসান। দুপুর দুইটাই এদেশের মানুষের ঘৃণিত নাম খুনি হাসিনা দিল্লিতে পালিয়ে গেলে জনতার মাঝে বাঁধ ভাঙ্গা উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। এ যেন এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান, বহুকাঙ্ক্ষিত বিপ্লব। এ দিনেও পতিত স্বৈরাচার হাসিনার কেনা গোলাম অনুগত পেটুয়া বাহিনী যাত্রাবাড়ী থানার সামনে সমবেত হাজার হাজার ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। একের পর এক গুলিবিদ্ধ হতে থাকে মানুষ। পড়তে থাকে একের পর এক লাশও। এ যেন এক নারকীয় গণহত্যা। পাখির মত মানুষ মারার তান্ডবে মেতেছিল হাসিনার পুলিশ বাহিনী। তাদের ছোড়া একটি গুলি এসে লাগে শাকিল হাসানের মাথায়। ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় তার মাথা। পড়ে যান রাস্তায়। সাথে সাথে শাহাদাতবরণ করেন তিনি। অনেক শহীদের লাশের সাথে তার নিথর দেহ পড়েছিল রাস্তায়। শাহাদাতের পর বন্ধু ও আত্মীয়-স্বজনের প্রতিক্রিয়া ছেলে হারিয়ে ফিরে আয় মানিক ফিরে আয় মানিক' বলে বিলাপ করছিলেন শহীদের মা। কাঁদতে কাঁদতে শহীদের বড় বোন বলছিলেন, 'ভাইটা ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই। আল্লাহ গরিবের ঘরে একটা সোনা দিয়েছিল।' শহীদের বাবা বলেন, "আমার ছেলে যখন জন্ম নেয় তখন চাঁদের আলো ঝলমল করছিল। তখনই বুঝতে পেরেছিলাম আল্লাহ আমাকে একটি অনেক বড় উপহার দিয়েছেন। কিন্তু জানাযার সময় ওর মুখটা যখন দেখি তখন মনে হচ্ছিল তার মুখখানিতে যেন ঐদিন চাঁদের আলোর মত নুরের ঝলক দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার সন্তানকে কেন মারল? কি দোষ ছিল তার? অন্যায়ভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে। শত শত বাবাকে সন্তানহারা করেছে খুনী হাসিনা। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। যেন কোনো স্বৈরাচার আর কোনোদিন কোনো বাবাকে সন্তান হারা না করতে পারে। কোনো বাবা যেন আর সন্তান হারা না হয়। ছেলেহারা বাবার বুকের আর্তনাদ কোনো শব্দ দিয়েই বর্ণনা করা সম্ভব নয়। বুকের মধ্যে প্রতিনিয়তই রক্তক্ষরণ হতে থাকবে। ক্ষত নিয়ে সারাটা জীবন আমাকে কাটাতে হবে।" শহীদের চাচা মিজান বলেন, "শাকিল ছোট সময় থেকে খুব ভদ্র নম্র একজন ছেলে। গ্রামের সবার সাথে সে মিলেমিশে থাকতো। তার সাথে কেউ দুষ্টমি ঠাট্টা করলেও সে কিছু বলতো না চুপ করে থাকতো। আমার তো মনে হয় এই ছেলেটাকে আমার ভাই অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছে। আমরা আশা করি এই হত্যার সাথে জড়িত উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবার বিচার হতে হবে। এরকম যেন আর কারো বুকের ধন খালি না হারিয়ে যায়।" শহীদের বড় বোন মুক্তা খাতুন বলেন, "আমার সোনা ভাইরে ওরা এভাবে মেরে ফেলল? আমার ভাইয়ের মতো অনেক ভাই জীবন দিছে দেশের জন্য। আমরা এই খুনি হাসিনার ফাঁসি চাই।" শহীদ পরিবার সংক্রান্ত বিশেষ তথ্য শহীদ শাকিল হাসান মানিক বগুড়া শহরের গাবতলী উপজেলার একটি দরিদ্র পরিবারের জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মা-বাবার বোনকে নিয়ে ছোট্ট একটি টিনের ঘরে তারা বসবাস করত। ভাই বোন উভয়ে মেধাবী হলেও অভাবের তাড়নায় অল্প বয়সেই বোনকে বিয়ে দেয়া হয় এবং জীবিকার তাগিদে শহীদ শাকিল ঢাকায় চলে আসেন। স্বামী কর্তৃক নির্যাতিতা বোনের ঘরেও সুখ জোটেনি। দিনমজুর বাবার সংসার চালাতে তিনি প্রত্যেক মাসে চার /পাঁচ হাজার টাকা পাঠাতেন। জমিজমা না থাকায় শহীদের পিতা অন্যের জমিতে দিনমজুর হয়ে কাজ করেন। শহীদের পিতার ও তার বোনের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই শোচনীয়। ব্যক্তিগত প্রোফাইল নাম : মো: শাকিল হাসান পিতার নাম : মো: মোকলেছুর রহমান (৫০) মাতার নাম : মোসা: শাহিনুর বেগম (৪৫) বোনের নাম : মোসা: মুক্তা খাতুন (২৭) জন্ম তারিখ : ২৭ মার্চ, ২০০১ স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: বাহাদুরপুর, ইউনিয়ন: নাড়ুয়ামালা থানা: গাবতলী, জেলা: বগুড়া বর্তমান ঠিকানা : বাহাদুরপুর, ৪নং ওয়ার্ড, গাবতলী, বগুড়া আহত হওয়ার স্থান : যাত্রাবাড়ী থানার সামনে ফ্লাইওভারের নিচে আহত হওয়ার সময় কাল : ৫ আগস্ট, ২০২৪, বিকাল ৩টা নিহত হওয়ার সময় ও স্থান : ৫ আগস্ট, ২০২৪, বিকাল যাত্রাবাড়ী থানার সামনে যাদের আঘাতে শহীদ : যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশের গুলিতে কবরস্থান : বাড়ির পাশে শহীদ পরিবারের জন্য করণীয় ১. শহীদের বাবা মায়ের জন্য বাসস্থান তৈরি করে দেওয়া ২. শহীদ পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ। তাদের জন্য আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করা দরকার ৩. শহীদ পরিবার ও তার বোনের একটি স্থায়ী কর্মসংস্থান দরকার দেশ এখন স্বাধীন, মুক্ত। একদিন সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। দেশ চিরদিন মনে রাখবে শাকিল হাসানকে। কিন্তু শহীদের পরিবারে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তা হয়তো কোনোদিনও মুছবে না।