জন্ম তারিখ: ১ জানুয়ারি, ২০০৩
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৮ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: রাজশাহী
পেশা :অটো চালক, শাহাদাতের স্থান :এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
তরুণদের রক্তে অর্জিত হয়েছে নতুন বাংলাদেশ। তরুণদের ছিল একটাই দাবী মেধার মূল্যায়ন। কোটা নয় মেধা। যৌক্তিক অধিকারের লড়াইয়ে এ দেশের তরুণেরা বুঝিয়েছে তারা ভদ্রভাবে চলতে জানে। গুরুজনদের মানতে জানে। তাদের শরীরে আঘাত হলে সহ্য করতে জানে। কিন্তু তাদের কটাক্ষ করলে তা তারা গ্রহণ করে না। ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা তাদের যৌক্তিক দাবীকে মূল্যায়ন না করে তাদের বুকের ভেতরের আগুনকে প্রজ্জ্বলিত করেছে। তারা দেখিয়ে দিয়েছে কেমন করে জ্বলে উঠতে হয়। প্রয়োজনে ক্ষমতা থেকে টেনে সরাতে হয়। মাত্র একটি কোটা আন্দোলনকে ঘিরে শেখ হাসিনার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ তাকে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোমলমতী ছাত্র-ছাত্রীদের সহযোগিতায় পুরো দেশ মাঠে নেমেছে। স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের এতোদিনের জুলুম অত্যাচারে নিষ্পেষিত জাতি যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। অধিকারের লড়াইয়ে যুক্ত হয় অগণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ। দেশকে দ্বিতীয়বার স্বাধীন করার দৃঢ় প্রত্যয়ে মাঠে নামে। বাঁচলে গাজী, মরলে শহীদ। জুলাই ২০২৪ বাংলাদেশের একটি ইতিহাস। বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা। শহীদ মো: হৃদয় আহমেদ। নাটোর জেলার সিংড়া থানার ছাতারদীঘি গ্রামে ১ জানুয়ারি ২০০৩ সালে নিতান্ত দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। বাবা মো: রাজু আহমেদ ও মা মোসা: ছপুরা বেগমের তিন কন্যা ও এক পুত্র সন্তান। হৃদয় তাদের একমাত্র পুত্র সন্তান। হৃদয় গ্রামের স্থানীয় একটি হাই স্কুল থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে অর্থাভাবে তার আর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তার তিন বোন যথাক্রমে মোসা: সুমনা আক্তার (১৮), মোসা: স¦প্না আক্তার (১৫) ও মোসা: সুমাইয়া খাতুন (৮)। হৃদয়ের ৫ সদস্যের পরিবার বর্তমানে অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করছেন। আন্দোলনের সময়ের বিস্তারিত বিবরণ জুলাই ২০২৪। দেশ জুড়ে শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। যা ধীরে ধীরে রূপ নেয় স্বৈরাচার সরকার বিরোধী গণমানুষের আন্দোলনে। হৃদয় আহমেদও নিয়মিত অংশগ্রহন করতেন এই আন্দোলনে। এর মধ্যে হৃদয়ের বাবা মো: রাজু আহমেদ ঢাকা চলে আসেন। বাবাও ছেলের সাথে আন্দোলনে যাওয়া শুরু করেন। ০৫ আগস্ট ২০২৪। বাবা ও ছেলে সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়েন স্বৈরাচারি সরকার বিরোধী গণমানুষের এই আন্দোলনে। আন্দোলনে বাবা ছেলে একইসাথে থাকলেও দুপুরে স্বৈরাচার সরকার হাসিনার পতন হলে বাবা রাজু আহমেদ সাভার মেইন রোডে অবস্থান করেন। সে সময় হৃদয় বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিজয় মিছিলের সাথে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। বিজয় মিছিলটি সাভার থানার সামনে আসলে পুলিশ মিছিলের উপর গুলি বর্ষণ শুরু করে। সে সময় গুলিবিদ্ধ হন হৃদয় আহমেদও। বুকে ও পেটে মোট ৪টি গুলি বিদ্ধ হয়ে ঘটনা স্থলেই লুটিয়ে পড়েন তিনি। এ সময় উপস্থিত ছাত্র-জনতার সহায়তায় তাকে নিয়ে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তার খবর পেয়ে দ্রুত হাসপাতালে যান হৃদয়ের বাবা ও বোন সুমনা আক্তার। এ সময় হাসপাতালে উপস্থিত পরিবারের সদস্যদের সাথে কিছুটা কথাও হয়েছিল তার। অবশেষে হৃদয়কে রাত ১২:০০ টায় অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। অপারেশন সম্পন্ন হলে তাকে আইসিউতে স্থানান্তর করা হয়। আইসিউতে অবস্থান কালে ধীরে ধীরে অবস্থার অবনতি হতে থাকে তার। ০৮ আগস্ট ২০২৪, সকাল ০৮:৩০ মিনিটে আইসিউতে থাকা অবস্থায় সকল অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সবাইকে কান্নার সাগরে ভাসিয়ে চির বিদায় নেন মো: হৃদয় আহমেদ। সেদিনই বেলা ৩:৩০ টায় পরিবারের লোকজন মরদেহ নিয়ে তার নিজ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছান। বাদ মাগরিব জানাযার নামায সম্পন্ন করে ছাতারদীঘি কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় মোঃ হৃদয় আহমেদকে। একমাত্র পুত্র সন্তান হারিয়ে শোকে পাগল প্রায় বাবা-মা। তাদের কে বলার মতো নেই কোন সান্তনার ভাষা। মা মোসাঃ ছপুরা বেগম বলেন, গরীবের সংসারে খুব কষ্ট করে লালন পালন করে বড় করেছি আমার এই সন্তানকে, আর আজকে এভাবে আমাকে সন্তান হারা হতে হল। সারা জীবন কত কষ্ট করে করলাম, সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়েই আমার এই বেঁচে থাকা। ছোট্ট একটা ঘরের মধ্যে ছেলের বউসহ সন্তানদের নিয়ে থাকতে পারতাম না এই জন্য সে ঢাকা গেল। একটা ঘর যাতে বানাতে পারি, এই জন্য আমি নিজেও ঢাকা গেলাম কাজ করতে। কিন্তু আজকে সব কিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে আমি সন্তানের লাশ নিয়ে ঘরে ফিরলাম। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীর অনুভূতি শহীদ সম্পর্কে চাচা মোঃ জীবন সরদার বলেন, আপনজন হারানোর বেদনা কাউকে বলে বোঝানো যায় না। যার হারায় সেই বোঝে এটা কতটা কষ্টের। আমার ভাতিজা এত ভদ্র, এত অমায়িক স্বভাবের ছিল, কোনদিন আমাদের মুখের উপর তাকায়ে কোনো কথা বলতো না। শুধু আমরা কেন? আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে পাড়া প্রতিবেশী কেউই বলতে পারবে না হৃদয় কারো সাথে কোন কটু কথা বলেছে কিংবা বেয়াদবি করেছে কোনদিন। আমার যদি কোন দিন সন্তান হয় আমি আশা করি, আল্লাহ যেন হৃদয়ের মতো আমাকে একটা সন্তান দেন। ওর কথা মনে হলে রাতে ঘুম আসে না। কান্না করতে করতে বিছানার বালিশ ভিজে যায়। কিন্তু ওকে তো আর ফেরত পাবো না, আমি চাই এই হত্যার যেন একটা ন্যায় বিচার হয়। পারিবারিক অবস্থা হৃদয়ের বাবা রাজু আহমেদ মানুষের জমি বর্গা চাষ করে যা উপার্জন করেন তা দিয়ে ৪ সন্তানের পরিবারের সকল খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে থাকেন। তার আনুমানিক মাসিক আয় মাত্র ৬০০০ টাকা। তাদের নিজস্ব কোন জমি নেই। একটি খাস জমিতে বর্তমানে তাদের বসবাস। হৃদয়ের বাবা চাচারা ৬ ভাই। তারা বর্তমানে প্রায় ১০ কাঠা একটি খাস জমিতে বাস করছেন। তাই পরিবারের হাল ধরতে ২০১৭ সালে ঢাকায় পাড়ি জমান হৃদয় আহমেদ। ঢাকার সাভারে হাইপয়েন্ট নামক একটি হোটেলে চাকরি নেন তিনি। সেখানে কিছুদিন চাকরি করার পর সাভারের মারহাবা স্পিনিং মিলসে যোগদান করেন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৯ তারিখে মোসাঃ লিমা আক্তারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন হৃদয় আহমেদ। ক্রমেই সংসারের খরচ বাড়তে থাকে। চরম দারির্দ্যের মুখোমুখী হয়ে হৃদয়ের মাও চাকরির সন্ধানে ঢাকা চলে আসেন। মা ও স্ত্রী মিলে পাকিজা গার্মেন্টসে কাজ শুরু করেন। ২০২৪ সালের শুরুতে মা ও স্ত্রীসহ সপরিবারে পুনরায় হৃদয় তাদের গ্রামে চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি অটো রিক্সা চালানো শুরু করেন। কিছুদিন অটো রিক্সা চালিয়ে সুবিধা করতে না পেরে চাকরির সন্ধানে আবার সাভার চলে আসেন। ইতিমধ্যে বোন সুমনা ও সপ্না আক্তারের বিবাহ হয়ে যায়। সুমনা আক্তার স্বামীসহ সাভারে বসবাস করা শুরু করেন। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি বাবা মোঃ রাজু আহমেদ। মাসিক আয় আনুমানিক ৬ হাজার টাকা। পরিবারটির আর্থিক সহযোগিতার প্রস্তাবনা এক নজরে শহীদ মো. হৃদয় আহমেদ নাম : মো: হৃদয় আহমেদ শিক্ষাগত যোগ্যতা : অষ্টম শ্রেণি পেশা : অটো চালক পিতা : পিতার নাম: মো: রাজু আহমেদ পিতার পেশা ও বয়স : বর্গাচাষি, বয়স: ৪৫ বছর মাতা : মোসা: ছপুরা বেগম মায়ের পেশা ও বয়স : গৃহিণী, বয়স: ৪২ বছর জন্ম তারিখ ও বয়স : ১ জানুয়ারি ২০০৩ জন্মস্থান সিংড়া, নাটোর স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: ছাতারদীঘি, ইউনিয়ন: ছাতারদীঘি, থানা: সিংড়া, জেলা: নাটোর বর্তমান ঠিকানা : ছাতারদীঘি, ইউনিয়ন: ছাতারদীঘি, থানা: সিংড়া, জেলা: নাটোর শহীদের স্ত্রীর নাম : মোসা: লিমা আক্তার আক্রমণকারী নাম ও তথ্য : পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আহত হওয়ার সময় : ০৫/০৮/২৪, সময়: বিকাল ৪:৩০ মিনিট মৃত্যুর তারিখ ও সময় : ০৮/০৮/২৪, সময়: সকাল ০৮:৩০ মিনিট মৃত্যুর স্থান : এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান : ছাতারদীঘি, সিংড়া, নাটোর বাড়ি-ঘরের অবস্থা : টিনের ঘর পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ৫ জন পিতার মাসিক আয় : ৬০০০/- পরামর্শ ১। শহীদ পরিবারের জন্য নিয়মিত ভাতার ব্যবস্থা করা ২। শহীদ মো: হৃদয় আহমেদের বাবা মোঃ রাজু আহমেদের জন্য কর্মসংস্থান এর ব্যবস্থা করা ৩। শহীদ পরিবারের বসবাসের জন্য একটি গৃহ নির্মাণ করে দেয়া ৪। শহীদের স্ত্রীর জন্য একটি চাকরির ব্যবস্থা করা ৫। ছোট বোনের