জন্ম তারিখ: ১৬ জানুয়ারি, ২০০৫
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: বরিশাল
পেশা : পপুলার হাসপাতালে চাকুরী. শাহাদাতের স্থান : এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল,সাভার
আরিফুল ইসলাম ছিলেন এক সাহসী মানুষ। ২০০৫ সালে বরিশালের বাকেরগঞ্জের মেঠো পথে বেড়ে ওঠা আরিফুলের জীবন ছিল সংগ্রাম ও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে গড়া। পিতা খলিলুর রহমান ও মাতা রিনা খানের দরিদ্র সংসারে জন্ম নেওয়া আরিফুল সবুজ শ্যামল পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। তার অন্তরে ছিল অপরিসীম সাহস, যা তাকে একদিন ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে দেয়। গ্রামে সরু মেঠো পথে শৈশব কাটিয়ে আরিফুল ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন একজন প্রতিবাদী যোদ্ধা। দরিদ্রতার বাঁধা পেরিয়ে, তার চোখে ছিল দেশের জন্য কিছু করার দৃঢ় সংকল্প। পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য, নিজের সন্তান রাইসা রহমানের জন্য, যার বয়স মাত্র ১৬ মাস। আরিফুলের স্বপ্ন ছিল একটি সুষ্ঠু, ন্যায়ের সমাজ গড়ে তোলার। ২০২৪ সালের কোটা আন্দোলন সেই সুযোগ এনে দেয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর যে প্রতিজ্ঞা তার ছিল, তা যেন বাস্তবায়িত হওয়ার মুহূর্ত পেয়ে যায় এই আন্দোলনে। আরিফুল রাস্তায় নেমে এলেন, বুক ভরা সাহস নিয়ে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হয়ে উঠলেন। কিন্তু, সেই লড়াইয়ে তার জীবন শেষ হয়ে যায়। ২০২৪ সালের সেই আন্দোলনে আরিফুল ইসলাম শহীদ হন। রেখে যান তার ছোট্ট মেয়ে রাইসাক-একটি অনাগত ভবিষ্যতের প্রতীক। তার শাহাদাত শুধু একজন ব্যক্তির নয়, বরং একটি সংগ্রামের ইতিহাসের অংশ হয়ে রইলো। সেই সবুজে ঘেরা মেঠো পথ, দরিদ্রতার যন্ত্রণা এবং সাহসী এক সংগ্রামী চেতনা আজও জ্বলজ্বল করছে আরিফুলের আত্মত্যাগের মধ্যে। শহীদ পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা শহীদ আরিফুর রহমান জীবিত থাকাকালীন সময়ে তার পরিবার ভালোই ছিল। তার আয় দিয়ে পুরো পরিবার ভালোভাবে চলত। তার শ্রম আর ভালোবাসার মাধ্যমে পরিবারে কখনো অভাবের ছায়া পড়েনি। জীবন যেন এক ছন্দময় গানে মিশে ছিল। যেখানে প্রতিটি দিনই ছিল সমৃদ্ধির প্রতিচ্ছবি। শহীদ আরিফুর রহমানের কষ্টের ফসল ছিল পরিবারের হাসিখুশি জীবন, যা তার অনুপস্থিতিতে এখন শুধুই স্মৃতির অমলিন ধারা। শহীদ সম্পর্কে অনুভূতি শহীদ আরিফুর রহমানের জীবন ছিল পরিবার, বন্ধু ও রাজনীতির প্রতি অবিচল এক নিবেদন। তার চাচাতো ভাই সোহেল তালুকদার স্মরণ করেন, "আরিফুর ছিল আমার সমবয়সী, আমাদের বন্ধন ছিল গভীর। বাড়িতে আসলেই আমরা একসাথে রাজনীতির আলোচনা করতাম। সে ছিল আমার রাজনীতির গুরু, সর্বদা আমাকে সাহস দিতো। তার কণ্ঠে অদ্ভুত দৃঢ়তা ছিল, বলতো-'হাসিনার পতন নিশ্চিত, শুধু একটু শক্ত থাক। সব ঠিক হয়ে যাবে।' কিন্তু আল্লাহ তাকে নিয়ে গেলেন। আমার ভাই আজ আমাদের মাঝে নেই।" মা রিনা বেগম বলেন, "আমার ছেলে ছিল আমার চোখের মণি। ও আমার যত্ন নিত, আমি তাকে রাজনীতি করতে দিতাম না, তবুও সে দেশ ও মানুষের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ত। যারা আমার বাবাকে কেড়ে নিয়েছে, আল্লাহ তাদের বিচার করুক। আমি দোয়া করি, এরা যেন আর কখনও ক্ষমতায় আসতে না পারে।" ফুফাতো ভাই মাহফুজুর রহমানের কণ্ঠে কেবলই শোক, "আমার বড় ভাই আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। বাড়িতে এলেই আমাদের সঙ্গে খেলতেন, বাজারে নিয়ে যেতেন। তিনি ছিলেন আমাদের থেকে বয়সে বড়, কিন্তু আমাদের সমবয়সী বন্ধুর মতো আচরণ করতেন। আল্লাহ তাঁকে জান্নাত দান করুন।" তার স্ত্রী তানিয়া হৃদয়বিদারক স্মৃতিচারণ করেন, "পাঁচ তারিখ সকালে আমার স্বামী বাইরে যেতে চাইলে আমি তাকে যেতে দিইনি। দুপুর ১২টায় আবার যেতে চাইলে আবারো আমি তাঁকে থামাই। তখন তিনি বলেছিলেন, 'আমার যদি মৃত্যু হয়, তবে সেটা শহীদির মৃত্যু হবে। শুধু আমাদের মেয়েটা বাবাকে আর ডাকতে পারবে না।' পরে সেনাপ্রধানের ভাষণ শোনার পর তিনি বাসা থেকে বের হলেন। সাভার থানার সামনে পৌঁছালে পুলিশ গুলি চালায়। লোকজন তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমি যখন হাসপাতালে পৌঁছালাম, তখন ডাক্তার জানালেন-আরিফুর রহমান আর বেঁচে নেই।" শহীদ আরিফুর রহমানের এই হারানোর বেদনা তার পরিবার ও প্রিয়জনদের অন্তরে গভীর ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। তিনি শুধু একজন রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন না, ছিলেন এক নিবেদিত প্রাণ। যে তার পরিবার ও জাতির জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তার স্মৃতি আজও সবার হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবে। যেভাবে শহীদ হলেন ২০২৪ সালের জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে শুরু হওয়া কোটা বিরোধী আন্দোলন বাংলাদেশে একটি ঐতিহাসিক অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছিল। সারাদেশজুড়ে তরুণ প্রজন্মের এই গণজাগরণ নতুন করে স্বাধীনতার লড়াইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল। সেই আন্দোলনের এক সাহসী যোদ্ধা ছিলেন আরিফুর রহমান রাসেল। রাসেল, যিনি চাকরির ব্যস্ততার মধ্যেও দেশের মানুষকে মুক্তির পথে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতেন, ছিলেন সেই সময়ের এক সাহসী বিপ্লবী। যখনই এলাকায় কোনো কর্মসূচি থাকত, রাসেল সব বাধা অতিক্রম করে তাতে অংশ নিতে ছুটে যেত। নিজের প্রাণের ঝুঁকি জেনেও, দেশের প্রতি ভালোবাসার কাছে সবকিছু তুচ্ছ মনে করত সে। তার প্রিয়তমা স্ত্রী বারবার তাকে নিরুৎসাহিত করলেও, রাসেল বলত, "দেশের মানুষের মুক্তির জন্য যদি জীবন দিতে হয়, তবে আমি প্রস্তুত। যদি আমার কিছু হয়, আমাদের মেয়েটাকে আদর-যত্নে দেখে রাখবে।" জুলাইয়ের শুরু থেকেই আন্দোলনের শিখা জ্বলে উঠতে থাকে। আর ১০ তারিখের পর তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। রাসেল অফিসের কাজ শেষ করে বা ছুটি নিয়ে আশেপাশের কর্মসূচিতে যোগ দিত। কয়েকবার আহত হয়েছে সে, পুলিশের টিয়ারশেলের আঘাতে তার চোখে প্রচণ্ড আঘাত লাগে। তবুও, দেশের স্বাধীনতার জন্য এই ব্যথা তার কাছে তুচ্ছ। স্ত্রী, মা-কারও কথাই সে শোনেনি, থামেনি। আগস্টের শুরুতে আন্দোলন সফলতার পথে এগিয়ে যায়। ৫ আগস্ট "লংমার্চ টু ঢাকা" কর্মসূচির ঘোষণার পর সরকার নড়বড়ে হয়ে পড়ে। দেশের চারপাশে বিজয় মিছিলের প্রস্তুতি শুরু হয়। সাভার এলাকায় মিছিল শুরু হলে, লক্ষ লক্ষ মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ে। বিজয়ের আনন্দের মুহূর্তে হঠাৎ ঘটে যায় এক নির্মম ঘটনা। সাভার থানার সামনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ এমপি ও মেয়র মিছিলে গুলি চালায়। পুলিশও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। অসংখ্য মানুষ আহত হয়, আর মিছিলের সামনের সারিতে থাকা রাসেলের বুকে এসে লাগে ঘাতক বুলেট। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রাসেল, মুহূর্তের মধ্যে তার জীবনের প্রদীপ নিভে যায়। আরিফুর রহমানের মৃত্যুর খবর তার পরিবারের কাছে পৌঁছে যায়। তার স্ত্রী, ১৬ মাসের ছোট শিশুকে নিয়ে ছুটে আসে। কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না। শহীদ আরিফুর রহমানের নিথর দেহ যখন তাঁর বন্ধুরা নিয়ে বরিশালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। গ্রামের বুকে যেন নেমে আসে শোকের কালো ছায়া। বৃদ্ধ বাবা-মা, যাদের কাছে আরিফই ছিল জীবনের একমাত্র সম্বল। তারা অপেক্ষা করছিলেন তাদের আদরের ধনের মরদেহ গ্রহণ করতে। গ্রামে পৌঁছে আরিফের জানাজার পর হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে তাকে সমাহিত করা হয়। তার বাবা-মায়ের চোখের অশ্রু থামানোর কোনো ভাষা তখন দুনিয়াতে ছিল না। আরিফুর রহমান রাসেল, এক শহীদ বীর যোদ্ধা, দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে গেলেন, আর তার স্মৃতি বয়ে বেড়াতে লাগল বাংলার প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের হৃদয়ে। এক নজরে শহীদ মো: আরিফুর রহমান রাসেল নাম : মো: আরিফুর রহমান রাসেল জন্ম তারিখ : ১৬/০১/২০০৫ পেশা : পপুলার হাসপাতালে কর্মরত স্থায়ী ঠিকানা : সুন্দরগঞ্জ, দুদাল, বাকেরগঞ্জ, বরিশাল পিতা : মো. খলিলুর রহমান, বয়স: ৭০ মাতা : রিনা আক্তার, বয়স: ৬০ বছর স্ত্রী : তানিয়া পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ০৩ জন রাইসা রহমান : বয়স: ১৬ মাস ঘটনার স্থান : সাভার আক্রমণকারী : আওয়ামী পুলিশলীগ আহত হওয়ার তারিখ : ০৫/০৮/২০২৪, দুপুর ২টা শহীদ হওয়ার তারিখ : ০৫/০৮/২০২৪, এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল,সাভার কবরস্থান : পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়