Image of মো: মিজানুর রহমান

নাম: মো: মিজানুর রহমান

জন্ম তারিখ: ১০ আগস্ট, ১৯৯৫

শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৯ আগস্ট, ২০২৪

বিভাগ: বরিশাল

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা : মুদি দোকানদার, শাহাদাতের স্থান : পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায়

শহীদের জীবনী

মিজানুর রহমান একটি নাম, একটি আত্মত্যাগের প্রতীক। মো: মিজানুর রহমানের জীবন কেটেছে দারিদ্রতার সঙ্গে নিরন্তর সংগ্রাম করে। ১৯৯৫ সালের ১০ আগস্ট গ্রামীণ সবুজের মাঝে তার জন্ম। তিনি ছিলেন তার পরিবারে একমাত্র ভরসার নাম। জন্মের পর থেকে তিনি বড় হয়েছেন গ্রামের মেঠোপথ ধরে, যেখানে দারিদ্রতার ছায়া তার প্রতিদিনের সঙ্গী ছিল। পড়াশোনার সুযোগ তেমন পাননি, কিন্তু জীবন তাকে শিখিয়েছে টিকে থাকার কঠিন পাঠ।তাঁর বাবা কামাল হোসেন মোল্লা একজন সাধারণ মানুষ। যিনি প্রতিদিনের রোজগারে পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতেন। মিজানুর সেই দারির্দ্যকে মেনে নিয়ে নিজের হাতে এক ক্ষুদ্র মুদি দোকান চালাতেন। মাসিক প্রায় ১৫,০০০ টাকা উপার্জন করতেন। এ দিয়েই চলত পরিবারের জীবনসংগ্রাম মা মোসা: শাহনাজ পারভীন, স্ত্রী, আর তার ছোট্ট ৮ মাসের ছেলে বায়েজিদকে নিয়ে একটি ছোট কিন্তু গভীর ভালোবাসায় ঘেরা সংসার। মিজানের জীবনের প্রতিটি দিন ছিল সংগ্রামের। গ্রামের খোলা প্রান্তরের সবুজে বেড়ে ওঠা ছেলেটি, যাকে স্কুলের গণ্ডিতে ঠাঁই হয়নি। নিজের যোগ্যতায় পরিবারের হাল ধরেছিলেন। অভাব তাকে আটকাতে পারেনি, তার লক্ষ্য ছিল পরিবারকে একটু ভালো রাখার। ছোট দোকানটি ছিল তার জীবনের সব। কিন্তু সেই স্বপ্নগুলো বেশি দূর এগোতে পারেনি। মিজানের মৃত্যু শুধু তার পরিবারের জন্য নয়, সমগ্র জাতির জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতি। ছোট্ট বায়েজিদ, যার চোখে এখনো জীবনের প্রথম ছোঁয়া, আজ তার বাবাকে হারিয়ে বড় অসহায়। গ্রামের সেই মেঠোপথে যে ছেলে একদিন ছুটে বেড়াত, আজ তার আত্মত্যাগের গল্প হয়ে থাকবে আমাদের মাঝে। মিজানুর রহমানের সংগ্রামী জীবন, তার অকালমৃত্যু এবং তার পরিবারের নিদারুণ কষ্ট আমাদের মনে কেবল শোকের ছাপই নয়, বরং একটি জাতির হতাশা ও অবিচারের প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকবে। শহীদ পরিবারের দারিদ্রের ছাপ মিজানুর রহমান ছিলেন তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। যার ওপর পুরো পরিবারের অর্থনৈতিক ভার ছিল। তার বাবা, যিনি একসময় মুদি দোকান চালাতেন, বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ায় আর আগের মতো দোকানটি পরিচালনা করতে পারতেন না। পরিবারের দায়িত্ব বুঝে নিয়েছিলেন মিজান। ছোট্ট সেই মুদি দোকান থেকে যে সামান্য আয় হতো, সেটাই ছিল তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। মিজানের মৃত্যুতে পরিবারটি ভেঙে পড়ে। তার অনুপস্থিতিতে দোকান চালানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তার বাবা মাঝে মাঝে দোকানে বসেন। কিন্তু বয়সের কারণে পুরোপুরি দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। এমনকি তাদের ছোট মেয়ে, মিজানের বোনও এখন দোকানে বসে পরিবারের পাশে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু এই অনিশ্চিত আয়ের উৎস থেকে পরিবারের চাহিদা পূরণ করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিকভাবে তারা আগে থেকেই সচ্ছল ছিল না। মিজান যখন দোকান চালাতেন। তখনও তারা খুব কষ্ট করে চলতেন। পরিবারের জন্য তিনি যে সামান্য আয় করতেন, তা দিয়ে কোনোভাবে সংসারের খরচ মিটাতেন। তবুও অনেক চাহিদা অপূর্ণ থেকে যেত। কিন্তু মিজানের অকালমৃত্যুতে সেই সামান্য আয়ের পথও বন্ধ হয়ে গেছে। মিজানের পরিবার এখন ভঙ্গুর অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। পরিবারের প্রতিটি সদস্য গভীর শোকের পাশাপাশি আর্থিক সংকটে পড়েছে। দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করা এখন তাদের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে ঘরে একদিন জীবনের স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, এখন সেই ঘরে শুধু হতাশা আর অসহায়ত্বের ছায়া। ঘটনার প্রেক্ষাপট বিগত আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে মিজানুর রহমান ছিলেন এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। সীমাহীন দুর্নীতি, খুন, গুম, ভোটবিহীন শাসনের অসন্তুষ্টি ছিল তার মনে প্রাণে। তারই অংশ হিসেবে গত ১৯ জুলাই ২০২৪, একটি সাধারণ দিন, কিন্তু ইতিহাসের পাতা জুড়ে জ্বলজ্বলে একটি নাম—মিজানুর রহমান। ঢাকা শহরের খিলগাঁও থানার বনশ্রী এলাকায় মুদির দোকানদার, পরিবারের পাশে থাকা একজন মানুষ যিনি নিজের জীবনে ছোট ছোট স্বপ্ন বুনে চলছিলেন। সেদিন জুমার নামাজ শেষে, তিনি যখন বাসা থেকে বের হন, তখন একটি ভিন্ন দৃশ্য তার চোখে পড়ে—প্রতিবাদের আওয়াজ, মানবতার জন্য সংগ্রাম, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। পুলিশ ও বিজিবির উপস্থিতি, উত্তেজনা যেন বাতাসে। মিজান এগিয়ে যেতে থাকেন, কিন্তু অজ্ঞাত বিপদের মুখোমুখি হন। এক মুহূর্তে হঠাৎ, তার বাঁ পায়ের উরুতে লাগে একটি গুলি। সে মুহূর্তে তার পুরো জীবন যেন থমকে যায়। মিজান দ্রুত ফোন করেন তার স্ত্রী, বোন, ভগ্নিপতিকে। শোকভরা কণ্ঠে জানান, "আমার গুলি লেগেছে।" তার পরিবার ছুটে আসে, মিজানকে অ্যাডভান্স হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু অবস্থার অবনতি ঘটে। তাকে পঙ্গু হাসপাতালে নিতে বলা হয়। রাস্তায় রক্তক্ষরণ বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসকরা তাকে বাঁচাতে পারেননি। বিকেল ৫:৪০ মিনিটে ঘোষণা আসে, তিনি মারা গেছেন। মিজানুর রহমানের মৃত্যু কেবল তার পরিবারের জন্য নয়, বরং একটি জাতির জন্য একটি হতাশার প্রতীক হয়ে উঠেছে। তিনি ছিলেন পরিবারের ভরসা, স্বপ্নের ধারক। তার এই অকালমৃত্যু দেশের মানুষের জন্য একটি প্রশ্নচিহ্ন হয়ে আছে। মিজানের জীবন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে সত্যের পথে চলতে হয় সাহসের সাথে। তার এই যাত্রা যেন একটি অনুপ্রেরণা হয়ে উঠুক—অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর। তার স্মৃতি আমাদের মনে রেখে দেবে যে, মিজানুর রহমানের মতো শহীদরা কখনোই আমাদের হৃদয়ে মরে না। শহীদ সম্পর্কে অনুভুতি মিজানুর রহমানের বড় বোনের চোখে ভাইয়ের স্মৃতি যেন এক গভীর শূন্যতার প্রতিচ্ছবি। ভাই ছিল তার জীবনের পূর্ণতা, যা কেবল একজন বোনই বুঝতে পারে। ভাইয়ের সেই স্নেহময় কণ্ঠস্বর এখনো কানে বাজে—"বোন, কী লাগবে? যা কিছু আমার আছে সব নিয়ে যা, তোর সব আবদার পূরণ করব, শরীরের সব রক্ত দিয়ে হলেও তোকে সুখী দেখতে চাই।" এমন কথা একমাত্র ভাই ছাড়া আর কেউ বলতে পারে না। ভাই আল্লাহর দেওয়া সবচেয়ে বড় উপহার, যার মূল্য আজ তাকে হারিয়ে আরও বেশি অনুভব করছি। আজ ভাই নেই, জীবন যেন অসহায়তায় ভরপুর। যেদিকে তাকাই, সবকিছুই এক বিশাল অথই সাগরের মতো, যেখানে আমি সাঁতার জানি না কোনো এক সময় ডুবে যাবো হয়তো। আল্লাহ, তোমার রহমত আমাদের উপর বর্ষিত করো। আমার ভাইকে হাশরের ময়দানে হাসান-হোসাইনের সাথে দাঁড় করাও। তাকে বিনা হিসেবে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করো। প্রভু, জান্নাতে যেন তার সঙ্গে আমাদেরও মিলন হয়। জানিস ভাই, তোর স্ত্রী এখনো তোর অপেক্ষায়, তার প্রতিটি প্রয়োজনের কথা আজও তোকে মেসেজ করে জানায়। কিন্তু আজ আর কোনো রিপ্লাই আসে না। তবুও সে অপেক্ষায় থাকে, যেন তোর কোনো উত্তর আসবে। আমরা তাকে কীভাবে বুঝাই, কীভাবে শান্ত করি? আমাদের হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে, কিন্তু তোর সেই অন্তঃসত্ত¦া বউকে আমরা কীভাবে শান্ত করব রে ভাই? তোর সন্তানের দিকে তাকিয়ে আমরা এখনো তোকে খুঁজে ফিরি। তোর দেওয়া একমাত্র স্মৃতি, তোর ছেলে বায়েজিদ মোস্তাকিমের মাঝেই তোকে খুঁজে পাবো তোর হাসি, ভালোবাসা, ছায়া। আমাদের প্রাণের ভাই, তোকে ছাড়া সবকিছুই আজ শূন্য। প্রস্তাবনা: এতিম একমাত্র সন্তানের জন্য যাবতীয় সকল ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা। বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, যার সকল দেখাশোনা তার ছেলে করত, সেই দোকানটাকে আরও সমৃদ্ধ করে দেওয়া। এক নজরে শহীদের ব্যক্তিগত তথ্য পুরো নাম : মো: মিজানুর রহমান জন্ম : ১০/০৮/১৯৯৫ পেশা : মুদি দোকানদার স্থায়ী ঠিকানা : কেশবকাঠী (মোল্লাবাড়ী), ওটডা, থানা: উজিরপুর, জেলা: বরিশাল বর্তমান ঠিকানা : ব্লক জি, বাড়ি নং-৩০, রোড নং-৬, রামপুরা, বনশ্রী, ঢাকা পিতার নাম : কামাল হোসেন মোল্লা মাতার নাম : মোসা: শাহানাজ পারভীন মাসিক আয় : ১৫০০০/- আয়ের উৎস : বাবার আয় পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ৩ জন সন্তান : ১ ছেলে বায়েজিদ, বয়স: ৮ মাস ঘটনার স্থান : বনশ্রী, রামপুরা আক্রমণকারী : বিজিবি ও পুলিশের গুলিতে আহত হওয়ার সময়কাল : তারিখ: ১৯ জুলাই, বিকাল: ৩টায় নিহত হওয়ার সময়কাল : তারিখ: ১৯ জুলাই, ২০২৪ সময়: সন্ধ্যা ৫:৪০ মিনিটে কবরস্থান : পারিবারিক কবরস্থান

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of মো: মিজানুর রহমান
Image of মো: মিজানুর রহমান
Image of মো: মিজানুর রহমান
Image of মো: মিজানুর রহমান
Image of মো: মিজানুর রহমান
Image of মো: মিজানুর রহমান

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

মো: সিয়াম

মো: রাকিব হোসাইন

মো: সেলিম তালুকদার

মো: সিফাত হোসেন

মো: জাকির হোসেন

মো: নবীন তালুকদার

মো: সুজন

মো: ইমরান হোসেন

মো: রাব্বি মাতব্বর (গোলাম রাব্বি)

মো: আখতারুজ্জামান নাঈম

 মোঃ ফজলু

মো: বাবলু মৃধা

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo