Image of এম. ডি. ইলিয়াস হোসাইন

নাম: এম. ডি. ইলিয়াস হোসাইন

জন্ম তারিখ: ৮ মে, ১৯৯৭

শহীদ হওয়ার তারিখ: ৯ আগস্ট, ২০২৪

বিভাগ: বরিশাল

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা : শিক্ষার্থী, শাহাদাতের স্থান : নিউরোসাইন্স হাসপাতাল, আগারগাঁও

শহীদের জীবনী

শহীদ এম. ডি. ইলিয়াস ১৯৯৭ সালের ৮ মে বরিশাল জেলার গৌরনদী থানার চাঁদশী ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন। সাধারণ এক পরিবারে জন্ম নেওয়া ইলিয়াসের ছোটবেলা থেকেই ছিল হাজারো স্বপ্ন। পরিবারের প্রতি তার ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ ছিল অগাধ। শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি মনোযোগী ও পরিশ্রমী ছিলেন এবং তাঁর লক্ষ্য ছিল একদিন পরিবারের হাল ধরে তাদের জীবনে স্বচ্ছলতা আনা। তবে সেই স্বপ্ন পূরণের আগেই ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তার জীবন অকালে ঝরে যায়। এক সাধারণ ছেলে হিসেবে বেড়ে ওঠা ইলিয়াসের শাহাদাতে তার পরিবার এবং এলাকাবাসী গভীর শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েন। শহীদ সম্পর্কে অনুভূতি মোঃ মহসিন খান, ইলিয়াসের বড় ভাই, এক আবেগঘন সুরে বলেন, "আমাদের বাবা নেই, আমাদের মেঝ ভাই প্রবাসে থাকলেও সে তেমন খোঁজখবর রাখে না। সে আলাদা থাকছে, আর আমি নিজেও হার্টের রোগী, কাজ করতে পারি না। অটো চালিয়ে যতটুকু সম্ভব সংসারের খরচ চালাই। আমাদের ছোট ভাই ইলিয়াসই ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা, আমাদের আশার প্রদীপ। ভাইটি অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছিল এবং পাশাপাশি ছোটখাটো একটি কাজও করত। এখন তাকে হারিয়ে আমাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো আর কেউ নেই। যারা আমার ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, আমি তাদের ফাঁসি চাই। সরকারের কাছে আমার একমাত্র আবেদন, আমাদের পাশে দাঁড়ান এবং আমাদের এই দুর্দশার সময়ে সাহায্য করুন।" রেশমা বেগম, ইলিয়াসের বড় ভাবি, কাঁদতে কাঁদতে বলেন, "সে ছিল আমার ছোট ভাইয়ের মতো, আমাদের পরিবারের সবার প্রিয় মানুষ। আমাদের এলাকার এমন একজন সাহসী তরুণ, যাকে সবাই বীরপুরুষ হিসেবে জানত। কখনো কারো বিপদে সে পাশে না দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। যখনই কারো বিপদের কথা শুনেছে, সঙ্গে সঙ্গে সাহায্য নিয়ে ছুটে গেছে। নিজের সাধ্যমত সাহায্য করত, আবার কখনো অন্যদের কাছ থেকেও সংগ্রহ করে অসহায়দের পাশে দাঁড়াতো। আর আজ সেই পরিবারগুলোরই সাহায্যের দাবিদার। সবচেয়ে বড় কথা, সে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার চেষ্টা করত এবং বড়দের সম্মান করত, ছোটদের কাছে ছিল তাদের নয়নের মণি।" শহীদ সম্পর্কে বিশেষ কথা ইলিয়াস হোসেন ছিলেন মানুষের সেবায় নিবেদিতপ্রাণ, একজন অমায়িক মানুষ। মানবসেবা যেন তার নেশায় পরিণত হয়েছিল- যে নেশা তাঁকে কখনো পিছু ফিরে তাকাতে দেয়নি। যখনই কোনো অসহায় মানুষের খবর পেতেন, সেখানে ছুটে যেতেন, এক মুহূর্ত দেরি করতেন না। ছোটদের সঙ্গে খুনসুটি করা, বড়দের শ্রদ্ধা করা যেন তার দৈনন্দিন অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। নামাজের ব্যাপারে তিনি খুবই যত্নবান ছিলেন, সবসময় নিয়ম মেনে নামাজ পড়তেন। তার বাবা-মা ছিলেন অসুস্থ ও বৃদ্ধ, বড় ভাই নিজের সংসারে ব্যস্ত এবং হৃদরোগী হওয়ায় ভারী কোনো কাজ করতে পারতেন না। এই অবস্থায় ইলিয়াসই ছিলেন সংসারের সকল দায়িত্বের একমাত্র ভরসা। ভাইবোনদের দেখাশোনা থেকে শুরু করে বাবা-মায়ের ওষুধ এনে দেওয়া- সবকিছুতেই তার অবদান ছিল অপরিসীম। এলাকাবাসী তাকে জানতো একজন বিশ্বস্ত ও সহযোগী মানুষ হিসেবে। কেউ কোনো সমস্যায় পড়লে ইলিয়াসের সঙ্গে আলাপ করলেই তিনি যতটুকু সম্ভব সমাধানের পথ দেখাতেন। এলাকার ছোটরা চকলেটের আবদার করলে তিনি হাসিমুখে তা মেটাতেন। ছোটদের কাছে তিনি ছিলেন নয়নের মণি, তাদের প্রিয় ইলিয়াস ভাই। প্রত্যেক শহীদের মতো ইলিয়াসেরও অনেক গুণ ছিল যা তাকে সকলের জন্য অনুকরণীয় করে তুলেছিল। রাজনৈতিকভাবেও ইলিয়াস সক্রিয় ছিলেন, তবে এলাকার কিছু বিরোধী লোক তাকে প্রায়ই হয়রানি করত। এর ফলে তিনি এলাকাছাড়া হয়ে ঢাকায় চলে আসেন এবং মোহাম্মদপুর এলাকায় কাজ করতে শুরু করেন। পরিবারের অপর ভাই প্রবাসে থাকলেও তেমন খোঁজখবর রাখতেন না, ফলে সংসারের ভার ইলিয়াসের কাঁধেই এসে পড়েছিল। এই ভার তিনি সাগ্রহে পালন করতেন, তার পরিবারের কেউ কখনো তার কাজে অসন্তুষ্ট ছিল না। সবাই তাকে ভালোবাসত, তার প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখত। কিন্তু হঠাৎ করেই এই অমূল্য প্রাণটি আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেলো। স্বৈরাচারী সরকারের নির্মম বুলেট তার স্বপ্নগুলোকে চিরতরে নিভিয়ে দিল। তার বড় ভাইও জানতেন, ছোট ভাইটি একদিন ভালো একটি চাকরি করবে, পরিবারের সকল কাজগুলো সুন্দরভাবে পরিচালনা করবে। বোনটির আবদারগুলোও সে হাসিমুখে পূরণ করত। কিন্তু হঠাৎ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়ে গেলে ইলিয়াস অগ্রভাগে চলে আসে। মোহাম্মদপুর চৌরাস্তায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের গুলিতে তার জীবন শেষ হয়ে যায়। তার রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে হয়তো তিনি তাদের টার্গেট ছিলেন। বিজয়ের আগ মুহূর্তে এক দফা দাবিতে শাহবাগ অভিমুখে যাত্রার ডাক আসলে ইলিয়াস আর ঘরে বসে থাকতে পারেন নিই। তার মনে মানবসেবার যে নেশা ছিল, তা তাকে নামিয়ে আনে আন্দোলনের ময়দানে, ছাত্রদের সাহায্যের জন্য। শত বাধা-বিপত্তি তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। কিন্তু সেই অমায়িক মানুষটিকে শেষমেশ হারাতে হলো সন্ত্রাসীদের বুলেটের আঘাতে। ইলিয়াসের এই মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের নয়, একটি সমাজের ক্ষতি। ছোট শিশুরা হারাল তাদের চকলেট কিনে দেওয়ার মানুষ, বয়স্করা হারাল একজন সহানুভূতিশীল সাহায্যকারী, আর অসহায় মানুষগুলো হারালেন তাদের সহায়। ইলিয়াস ভাই, দেশ আজ স্বাধীন। নিশ্চিন্তে ঘুমান, আপনার অবদান আমরা ভুলব না। যেভাবে শহীদ হন ইলিয়াস হোসেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অগ্রপথিক ছিলেন, যিনি সারাজীবন ন্যায়ের পক্ষে সংগ্রাম করে গেছেন। ৪ আগস্ট ২০২৪, ঢাকার মোহাম্মদপুরে এক ভয়াবহ ঘটনার সাক্ষী হয় দেশ। সেই দিন ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার রাজীব ও বর্তমান কমিশনার মোহাম্মদ আসিফের নেতৃত্বে বর্বরোচিত এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণের শিকার হন ইলিয়াস। বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে দ্রুত আগারগাঁওয়ের নিউরোসাইন্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে ৯ আগস্ট ২০২৪ তারিখে, হাসপাতালের শীতল বিছানায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ইলিয়াস শুধু একজন আন্দোলনকারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক। ন্যায়ের জন্য লড়াই করা ছিল তার রক্তে। সারা দেশ যখন উত্তাল, মানুষ যখন তাদের অধিকার ও মর্যাদার জন্য পথে নেমেছিল, ইলিয়াস কখনো ঘরে বসে থাকতে পারেননি। দেশের অসহায়, নিপীড়িত মানুষের কষ্ট তার হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে কখনো পিছু হটেন নিই। বৈষম্যের অমানবিক শৃঙ্খল ভেঙে দিয়ে সমতার আলোকবর্তিকা জ্বালাতে চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর এই আত্মত্যাগ শুধু তার পরিবারের জন্য নয়, গোটা জাতির জন্যই ছিল এক অপূরণীয় ক্ষতি। ইলিয়াস ছিলেন সেই সকল সাহসী মানুষের একজন, যাদের জীবন দিয়ে দেশকে আলোকিত করেন। আজ তার মৃত্যুতে একটি পরিবারের অভিভাবক হারানোর শোক যেমন রয়েছে, তেমনি দেশও হারিয়েছে একজন আদর্শ সৈনিককে, যিনি সত্যের পক্ষে লড়াই করতে কখনো ভয় পান নিই। তার এভাবে চলে যাওয়া আমাদের মনে গভীর শোকের ছায়া ফেলেছে, কিন্তু তার আত্মত্যাগ আমাদের মনে ন্যায়ের পক্ষে লড়াই করার শক্তি যুগিয়ে যাবে। ইলিয়াস হোসেনের মতো মানুষদের আত্মত্যাগ আমাদের জীবনের চলার পথে সাহস ও প্রেরণার আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে। এক নজরে শহীদ এম. ডি. ইলিয়াস পুরো নাম : এম. ডি. ইলিয়াস হোসাইন জন্মসাল : ০৮/০৫/১৯৯৭ পেশা : শিক্ষার্থী স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা : চাঁদশী, ইউনিয়ন: চাঁদশী, থানা: গৌরনদী, জেলা: বরিশাল পিতার নাম : ফারুক খান, পেশা: বয়স: ৬৫ বছর মাতার নাম : রেখা বেগম, বয়স: ৫২ বছর মাসিক আয় : ৭,৫০০/- আয়ের উৎস : বড় ভাইয়ের আয় পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ৬ জন ভাইবোনের সংখ্যা : ২ ভাই, ২ বোন : ১. মো: মহসিন খান, বয়স: ৩৪, পেশা: অটো চালক, সম্পর্ক: ভাই : ২. তুহিন খান, বয়স: ২৮, প্রবাসী (ব্রুনাই), সম্পর্ক: ভাই : ৩. সুমি আক্তার, বয়স: ১৮, সম্পর্ক: বোন : ৪. শান্তা আক্তার, বয়স: ১৭, সম্পর্ক: বোন ঘটনার স্থান : মোহাম্মদপুর চৌরাস্তা, ঢাকা আক্রমণকারী : সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ আহত হওয়ার সময়কাল : ০৪ আগস্ট, ২০২৪, বিকাল ৪:০০টা নিহত হওয়ার সময়কাল : ০৯ আগস্ট, ২০২৪, সন্ধ্যা ৬:০০টা কবরস্থান : পারিবারিক কবরস্থান

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of এম. ডি. ইলিয়াস হোসাইন
Image of এম. ডি. ইলিয়াস হোসাইন
Image of এম. ডি. ইলিয়াস হোসাইন
Image of এম. ডি. ইলিয়াস হোসাইন
Image of এম. ডি. ইলিয়াস হোসাইন
Image of এম. ডি. ইলিয়াস হোসাইন
Image of এম. ডি. ইলিয়াস হোসাইন

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

মো: দুলাল সরদার

মোঃ মামুন

মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন

মো: রাকিব

মো: সুজন

মো: ইমরান হোসেন

মো: আরিফ

মো: সাগর হাওলাদার

মো: লিটন

মো: আমিনুল ইসলাম আমিন

রুবেল হোসেন

শাকিল

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo