জন্ম তারিখ: ২৩ মে, ২০০৫
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৬ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: বরিশাল
পেশা : ছাত্র, শাহাদাতের স্থান : চট্টগ্রাম, মুরাদপুর
শহীদ মোঃ ফয়সাল আহমেদ শান্ত ২০০৫ সালে নিজ জেলা বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জনাব মো: জাকির হোসেন, পেশায় একজন ব্যবসায়ী এবং মাতা মোসা: কহিনুর আক্তার একজন স্কুল শিক্ষক। শহীদ মো: ফয়সাল আহমেদ শান্ত ২০২৪ সালে জুলাই বিপ্লব আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলায় আক্রান্ত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক জীবন শহীদ মো: ফয়সাল আহমেদ এর ডাক নাম ছিল শান্ত। সবাই তাঁকে শান্ত নামেই ডাকত। শান্ত চট্টগ্রামের ওমর গনি এম ই এস কলেজের একজন ছাত্র ছিলেন। শহীদ মো: ফয়সাল আহমেদ (শান্ত) স্বপ্ন দেখতেন একদিন এই দেশের আকাশে স্বাধীনভাবে কালেমার পতাকা উড়বে। দ্বীন কায়েমের আন্দোলনে শরীক হওয়ার জন্য তিনি সবসময় আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতেন। আল্লাহ তার চাওয়া কবুল করলেন । ছাত্র ভাইদের দাওয়াত পেয়ে যোগদান করলেন লাখো তরুণের মুক্তির কাফেলা বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্র শিবিরে। তিনি ছিলেনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক অকুতোভয় যুবক। বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছিলেন সবসময়। জুলাই বিপ্লবের আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছিলৈন, তাদের আত্মা তাঁকে সবসময় পীড়া দিত। তিনি শান্তিতে ঘুমাতে পারতেন না। শাহাদাতের তামান্না তাঁকে ঘরে বসে থাকতে দেয়নি। এই আন্দোলন যদি ব্যর্থ হয় তাহলে কিভাবে তার বন্ধুদের ঋণ পরিশোধ করবেন। অন্যায় ভাবে তার বন্ধুরা মারা যাচ্ছে সে কিভাবে ঘরে বসে থাকেন। তাই তো এই কৈশোর পেরিয়ে তরুনে পড়া উদ্যোমী ফয়সাল আহমেদ (শান্ত)। ছুটে চলে গিয়েছিলেন যুদ্ধের ময়দানে। নিজের জীবনকে সঁপে দিয়েছেন খোদার তরে। পারিবারিক অবস্থা বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল শহীদ মো: ফয়সাল আহমেদ (শান্ত)। তাঁর পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪ জন। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা মোটামোটি। বাবার একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। জাহাজের ব্যবহৃত ফার্নিচার বিক্রি করেন, আর মা চট্টগ্রামে একটা কিন্ডার গার্ডেন স্কুলে শিক্ষাকতা করেন। তা দিয়ে তাদের মোটামুটি চলে। ছেলে কে নিয়েই তাদের স্বপ্ন ছিল অনেক। তার ছোট বোন সুমাইয়া জান্নাত বৃষ্টি ৮ম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। শহীদ হওয়ার ঘটনা পরবিাররে বাঁধা উপেক্ষা করে আন্দোলনে যায় শহীদ মো: ফয়সাল আহমেদ (শান্ত)। অতঃপর তার বাবা বিষয়টি জানতে পারে। অনেক বুঝানোর পরও তিনি নাছোড়বান্দা। আল্লাহ তাআলার প্রতি অগাধ বিশ্বাস আর শাহাদাতের তামান্নার কাছে দুনিয়র সকল প্রেম ভালবাসাই তুচ্ছ মনে হয়েছে তাঁর কাছে। বারবার মাকে জানায়- আমি একটু বিস্কুট পানি খাওয়াতে যাই, মা। মা রাজী হয় না। বল প্রয়োগ করে ঘরবন্দী করে রাখার চেষ্টা করে। তার বাবা বার বার ফোন করে তাকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করে। কোন কিছুই তাকে থামিয়ে রাখতে পারে না। এদিকে চট্টগ্রাম, মুরাদপুর এলাকায় কয়েকদিন ধরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সংঘাত চলতে থাকে। সেদিন ১৬ জুলাই, মঙ্গলবার পুলিশের ও ছাত্রলীগ হেলমেট বাহিনীর গোলাগুলি আরো বেড়ে যায়। চারদিকে পুলিশি ও ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনীর এলোপাতাড়ি ভাবে গুলি ছুড়তে থাকে বলে। তাদের সাথে যুক্ত হয় বিজিবি, র্যাব ও আনসার বাহিনীর সদস্যরাও। বিকেল নাগাদ তা আরও তীব্র আকার ধারণ করে। বন্ধুদের সাথে শহীদ মো: ফয়সাল আন্দোলনে যোগ দেন। আচমকা ঘাতকের কয়কেটি গুলি শহীদ মো: ফয়সালের শরীরে এসে বিদ্ধ হয়। একটি গুলি বুকের বাম পাঁশে এবং দুইটি গুলি পেট ভদে করে। পেটের নাড়িভুড়ি বের হয়ে যায়। পিচ ঢালা কালো রাস্তা রক্তে লাল হয়ে যায়। মুর্হূতইে ছটফট করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পরে শান্তর নিথর দেহ। পাশে থাকা শহীদ মো: ফয়সালের বন্ধুরা এমন দৃশ্য দেখে ভয়ে কেঁপে উঠে। রক্তমাখা দেহকে কুলে তুলে নেয়। গাড়িও নেই আশেপাশে যে তাকে হসপিটালে নিয়ে যাবে। অবশেষে কয়েকজন মিলে আহত শান্তকে ধরে হসপিটালে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করে। তবে লাশ বাসায় আনতে বাঁধে ব্যাপক বিপত্তি। পুলিশের রোষানলে পড়ে তারা। পুলিশ জানায়, যে আমাদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে তার লাশ আমরা দেব না। অনেক অনুনয় বিনয় আর মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে অবশেষে শহীদ মো: ফয়সালের লাশ বাড়িতে আনতে পারে তার পরিবার ও তার বন্ধুরা। সেখানেও স্থানীয় আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগেরা ব্যাপক বাধা সৃষ্টি করে। বিয়োগান্ত এ-অধ্যায় কিভাবে ভুলবে পরিবারটি। মায়ের মুখে শহীদ মো: ফয়সাল আহমেদ কে নিয়ে হৃদয়বিদারক অভিব্যক্তি সেদিন ১৬ জুলাই বিকেল তিনটায় আমি স্কুল থেকে বাসায় ফিরছিলাম। বাসার কাছাকাছি প্রায়, ওর ছোট বোন সুমাইয়াও আমার সাথে ছিল। পেছন থেকে সুমাইয়া সুমাইয়া বলে ডাক দিল। পিছনে তাকিয়ে দেখি শান্ত মনি ডাকছে। ব্যাগ থেকে চাবিটা বের করে আমাকে দিল। আমি বললাম: চাবি তো আমার কাছে আছে। শান্ত মনি বলল : তারপরও নিয়ে যাও। জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যাচ্ছ? বলল :আম্মু! আমি একটু ২ নং গেটের দিকে যাচ্ছি, আবার বললাম তোমার যে টিউশনি আছে? বলল: আম্মু আমি মাগরিবের আগে চলে আসব। ওকে কল দিলে ও বাসায় এসে পড়বে। আমি বাসায় ফিরে দুপুরে খাবার খেলাম। টিউশনি ছিল তাদের পড়ানো শেষ করলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে তার সাথে সাথে আমার জীবনেও যে আধার ঘনিয়ে আসছে সেটা তো আমি জানতাম না। মেয়েকে বললাম তোমার ভাইয়া আসবে নাস্তা রেডি কর। আর তোমার ভাইয়াকে কল দাও। মেয়ে কল দিয়ে বলে আম্মু ভাইয়ার মোবাইল বন্ধ, আমি তো বুঝতে পারলাম না যে আমার শান্ত মনির সাথে আমার যোগাযোগ সারা জীবনের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর ওর দুই বন্ধু এসে আমাকে বলে আন্টি একটু রেডি হতে হবে আমাদের সাথে একটু যেতে হবে। আমি বললাম কোথায় যাব? কেন যাব? নোমান বলল :আন্টি শান্ত ভাইয়ের একটু সমস্যা হয়েছে! কি সমস্যা হয়েছে! কি সমস্যা হয়েছে শান্ত মনির? ভেবেছিলাম হয়তো পুলিশে ধরেছে। না আন্টি শান্ত ভাইয়ের গায়ে গুলি লেগেছে, তারপরও বুঝতে পারিনি যে এত বড় সর্বনাশ আমার হয়ে গেছে। তারপর বের হয়ে সিএনজি নিয়ে মেডিকেলে যাওয়ার পথে ওর বাবা ওর টিচারকে কল দিয়ে বলি শান্ত মনির গায়ে গুলি লাগছে স্যার আপনি কোথায়? তাড়াতাড়ি মেডিকেলে আসেন। মেডিকেলে পৌঁছে শুনতেছি ওসি ডাকতেছে ফয়সালের আম্মু কোথায়? আমি দৌড়ে গিয়ে বলি এই যে আমি ফয়সালের আম্মু। আমাকে আমার শান্ত মনির কাছে যেতে দেন। আমি কাছে গেলে আমার শান্ত মনি সুস্থ হয়ে যাবে। সে যে অনেক আগেই চিরতরে অসুস্থ হয়ে গেছে সেটা তো আমি জানি না। পরে একজন লোক এসে বলতেছে আপনি একটু শান্ত হন। এখানে একজন লোক মারা গেছে যার জন্য একটু দেরি হবে শান্ত মনির কাছে যেতে। তখন আমি বুঝতে পারি আমার "মানিক" মনে হয় নাই। তোমরা কে? কি? বলতেছো মনে হল সারা দুনিয়া উল্টে গেছে আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি বাস্তবে, এমন তো হবার কথা না। তখন আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। একটু জ্ঞান ফিরলে ওসি এসে বলতেছে আমাকে থানায় নিয়ে যেতে। থানায় নিয়ে অনেক কাগজপত্রে আমার স্বাক্ষর নিলো। অতঃপর আমার মনে হলো আমার শান্ত মনিকে কি পোস্টমর্টেম করানো হবে। ওখানে যারা ছিল তাদেরকে বলি আমাকে পুলিশের যে বড় অফিসার আছে তার কাছে নিয়ে চলো। আমাকে তার কাছে নিয়ে গেল। তাকে আমি বললাম: স্যার আমার ছেলেকে যেন পোস্টমর্টেম করানো না হয়। আমার অনুনয় তারা কিছুতেই মানল না। যে ছেলে একটু হাত কাটলে রক্ত বের হতে দেখলে চিৎকার করতো। সে ছেলেকে তারা পোস্টমর্টেম করাতে নিয়ে গেল আমাদের না দেখিয়ে। আমার কথা কেউই শুনলো না। এতটাই নিষ্ঠুর পাষান্ড ছিল প্রশাসন তখন। আমার শান্ত ছেলেকে নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে রক্তাক্ত শরীর, ছেঁড়া কাটা দেহ খালি খোসাটা নিয়ে গেল সে। যে ছেলেকে আমি প্রজাপতির মত লালন পালন করেছি, আলগা করে ধরলে প্রজাপতি উড়ে যাবে,শক্ত করে ধরলে আমার প্রজাপতি ডানা ছিড়ে যাবে, সে প্রজাপতি আমার উড়েই গেল। রাখতে আর পারলাম না। ছেলের কষ্ট হবে ভেবে ওর কাপড় গুলো আমি ধুয়ে দিতাম। ভাত খাবার পর পানির গ্লাসে পানিটা দিয়েও ওর হাতে তুলে না দেওয়া পর্যন্ত খেত না। ধর্মের প্রতি সে খুবই যত্নশীল ছিল। সারাক্ষণ মোবাইলে হাদিস কোরআন পড়তো। অনেক সময় রাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখতাম সে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তো। কেউ কোন খাবার দিলে আগে জিজ্ঞেস করত কে দিয়েছে খাবারটা? যদি দেখতো সে নামাজ কালাম পড়ে না তাহলে তার দেওয়া খাবার শান্ত মনি খেত না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করত সে, সে যেই হোক না কেন। মোমের মতো শান্ত ছিল শান্ত মনে। সব দুঃখ ভুলে যেতাম ওর মুখের দিকে তাকিয়ে। কোথাও ও একা যেতে চাইতো না। মাকে সাথে না নিলে নাকি ভালো লাগেনা। আজ কতদিন যে হয়ে গেল মাকে ছেড়ে কিভাবে একা আছে আমার শান্ত মনি। আমিও যে ওকে ছাড়া একা থাকতে পারিনা। কখন হবে আমার মানিকের সাথে আমার দেখা? কত যে আশা ছিল শান্ত মনিকে নিয়ে আমার। লেখাপড়া শেষ করে ভালো চাকরি করবে। আমি শান্তি পাব। শান্ত মনি যেমন ছিল আমার গর্ব তেমনি আমিও ছিলাম ওর গর্ব। সবাইকে শুধু বলতো আমার মা আমার বাবার দায়িত্ব পালন করে। সবার কাছে মায়ের প্রশংসা করত এখন তো আর আমার প্রশংসা কেউ করছে না। ওর সবকিছুতেই আমার স্বাক্ষর। সব সময় বলতাম আমি শুধু তোমার ভালো রেজাল্টের সার্টিফিকেট চাই। বাবাটা-মাকে যে এত বড় সার্টিফিকেট দিয়ে গেল (ডেথ সার্টিফিকেট) এই সার্টিফিকেটের ভার আমি কিভাবে নিব? এই সার্টিফিকেট কি আমি চেয়েছিলাম? এই সার্টিফিকেটেও আমার স্বাক্ষর। আমি বাবার দায়িত্ব পালন করছি। সব সময় ভাবতাম আমার শান্ত মনিকে ভালোভাবে লেখাপড়া করার জন্য বিদেশে পাঠাবো। বিদেশ থেকে বড় অ্যাওয়ার্ড নিয়ে আসবে। আমি সেরা মা হব আমার শান্ত মনি এত বড় অ্যাওয়ার্ড নিয়ে গেল সেই স্মরণীয় দিনে ১৬/০৭/২০২৪ ইং। আমাকে 'সেরা মা' করে দিয়ে গেল। আমাকে এখন দেশের সব মানুষই "শহীদ ফয়সাল আহমেদ শান্তর" আম্মু হিসেবে চিনে। আমি সেই "সেরা মা"। আমি গর্বিত মা। আমার শান্ত মনি একজন সাহসী সন্তান। সে সবসময় সুন্নতি লেবাসে চলত। তার চলাফেরা কথা বার্তায় সবকিছুতেই শালীনতা ছিল। ফুলের যেমন কলঙ্ক থাকে না সেভাবেই চলতে চাইতো। সে তার প্রোফাইল পরিচিতিতে লিখেছিল। ফুলের মত ফুল হতে চাই ফুলের মত ফুল যেই ফুল পেল নবীর পরশ গন্ধ যার অতুল। সেই অতুল গন্ধে সুবাসিত করে চলে গেল না ফেরার দেশে। ভালো থেকো বাবা পরপারে। আল্লাহ তোমাকে জান্নাতের সূর্য মাকাম দান করুক। আল্লাহ তোমাকে শহীদ হিসেবে কবুল করুক। আল্লাহ যেন তোমার কবরকে তার নুরের আলোয় আলোকিত করে দেন। তোমার কবরকে প্রশস্ত করে দেন। তোমার সাথে যেন জান্নাতে আমার দেখা হয় বাবা। কাল হাশরের মাঠে আমার জন্য সুপারিশ করিও। আমার প্রতিটি মোনাজাতে তোমার জন্য দোয়া করি। আল্লাহ তোমাকে শহীদি মর্যাদা দান করুক। আমিন একনজরে শহীদ মো: ফয়সাল আহমেদ (শান্ত) নাম : মো: ফয়সাল আহমেদ (শান্ত) পেশা : ছাত্র জন্ম তারিখ : ২৩-০৫-২০০৫ বয়স : ১৯ বছর পিতা : মো: জাকির হোসেন মাতা : মোসা: কহিনুর আক্তার আহত হওয়ার তারিখ ও স্থান : ১৬-০৭-২০২৪, চট্টগ্রাম, মুরাদপুর বিকাল ৪টা ৩০ মিনিট শাহাদাতের তারিখ ও স্থান : ১৬-০৭-২০২৪, চট্টগ্রাম, মুরাদপুর বিকাল ৪টা ৩০ মিনিট ঘাতক : পুলিশ ও ছাএলীগ স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: মহিশাদি, ইউনিয়ন: রহমতপুর থানা: বিমানবন্দর থানা, জেলা: বরিশাল