Image of লিটন হাসান লালু

নাম: লিটন হাসান লালু

জন্ম তারিখ: ২ জানুয়ারি, ২০১২

শহীদ হওয়ার তারিখ: ৭ আগস্ট, ২০২৪

বিভাগ: ঢাকা_সিটি

ব্যক্তিগত তথ্য:

পেশা: ফুলের দোকান কর্মচারী শাহাদাতের স্থান : মিরপুর - ১০, ঢাকা

শহীদের জীবনী

"ঘাতকের গুলি লালুর খুলি ভেদ করে বেরিয়ে যায়" শহীদ পরিচিতি ২০১২ সালের ২ জানুয়ারি ঢাকার মিরপুরে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জুলাই বিপ্লবের অন্যতম এক কিশোর শহিদ লিটন হাসান লালু। আদর করে তাকে লালু বলেই ডাকতো সবাই। পিতা মো: হাফিজ ও মাতা মোসাম্মৎ আসমা দম্পতির কোল উজ্জ্বল করে আসা ছয় সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ এবং অত্যন্ত আদরের সন্তান ছিলেন লালু। পারিবারিক আর্থিক অনটনের কারণে পড়ালেখাটা বেশিদূর করতে পারেননি লালু। উপায়ান্তর না পেয়ে মিরপুরে একটা ফুলের দোকানে চাকরি নেন। শহীদ লালুর পিতা মো: হাফিজ স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে একটু একটু করে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছেন, দারিদ্রতার সাথে লড়াই করছেন। নির্লজ্জ সরকারের লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের কাছে বারবার যেন তিনি পরাজিত হতে থাকেন। তাদের জীবনের অন্ধকার আর কষ্টপীড়িত আকাশে ছয় সন্তান যেন মিটিমিটি করে জ্বলা ছয়টি শুকতারা! আর সবার ছোট হওয়ায় লালু যেন ছিল অন্যদের তুলনায় একটু বেশি উজ্জ্বল; দীপ্তিময়! খুব অল্প বয়সেই সে পরিবারের সুবিধা অসুবিধা বুঝতে পেরেছিল। বাবার হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম আর মায়ের দুঃখ-কষ্টকে হৃদয়ে ধারণ করতে পেরেছিল। তাইতো যে বয়সে লেখাপড়া, খেলাধুলা আর বন্ধুদের সাথে হইহুল্লোড় করে সময় কাটানোর কথা, সে বয়সেই লালু তার বাবা আর ভাইদের সাথে পরিবারের হাল ধরতে প্রাণপন চেষ্টা করেছে এই কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের বাজারে। অথচ পরিবারের এই উদীয়মান উজ্জ্বল নক্ষত্রকেই চিরতরে থামিয়ে দিল স্বৈরাচারের বুলেট! শাহাদাতের সময় তার বয়স ছিল মাত্র বারো বছর সাত মাস দুই দিন। যেভাবে শহীদ হলো ২০২৪ সালের জুলাই মাসে শুরু হয় কোটাবিরোধী বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ওই মাসের শেষের দিকে সেই আন্দোলন গণমানুষের আন্দোলনে রূপ নেয়। স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের নানা রকম নাটক, মিথ্যাচার, অনাচার, অত্যাচার আর তাল বাহানার কারণেই ছাত্রদের আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছড়িয়ে পড়ে বিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল ও মাদ্রাসায়। বিভাগীয় শহর থেকে বিপ্লব ছড়িয়ে যায় জেলা, উপজেলা, থানা, পৌরসভা, ইউনিয়ন, গ্রামে-গ্রামে, মহল্লায় মহল্লায়। সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ে মাঠে-ঘাটে, হাটে-বাজারে, অফিস-আদালতে, ঘরে-বাইরে সবখানে। নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরী সকলের মাঝে যেন স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন, বিপ্লব আর সংগ্রাম। কোটাবিরোধী আন্দোলন এক দফা সরকার পতনের দাবিতে পরিণত হয়। সকলের মুখে একই স্লোগান- এক দফা এক দাবি হাসিনা তুই কবে যাবি? লালু দোকান থেকে বাসায় যেতে পারে না কারফিউ আর অঘোষিত অবরোধের কারণে। তার বাবা কাজে যেতে পারেন না, বলেন দেশের অবস্থা খারাপ। মা রান্না করতে পারেন না-ঘরে বাজার নেই। মানুষ দুই বেলা খেতে পারে না-ঘরে খাবার নেই। রিক্সাওয়ালা মামা বলেন-মানুষ ভালো নেই। লালুর মহাজন বলেন-ব্যবসা ধ্বংস। নাগরিক সুবিধা নেই। মোড়ে মোড়ে কেবল তল্লাশি আর গুলি। লালু ভাবে এসব কি? জীবনে আর কখনও এমন পরিস্থিতি দেখেনি সে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনে শুনে সে বড় হয়েছে। কিন্তু এখন তো একাত্তরের সেই শোনা ঘটনাগুলো যেন প্রতিদিন নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছে লালু। না! লালু আর সহ্য করতে পারছে না! চারদিক থেকে ভেসে আসা স্লোগানগুলো লালুর সারা শরীরে কিসের যেন জাগরণ তৈরি করে। বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারিত সংবাদগুলো তাকে কেমন যেন নাড়া দেয়। কোনো এক অদৃশ্য শক্তি যেন লালুকে রাজপথের দিকে টেনে নিয়ে যায়। লালু আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। বিবেক তাকে ঘরে বসে থাকতে দেয় না। এভাবেই সরকার পতনের গণআন্দোলনের উন্মাদনা বাসা বাধে জীবনের অধিকাংশ সময় ফুলের সাথে থাকা কুসুম-কমল ছেলে অকুতভয় কিশোর লিটন হাসান লালুর তেজদীপ্ত হৃদয়ে। আর কি ঘরে বসে থাকা যায়? এই বন্দী দশা আর কত? না। অনেক হয়েছে, আর না। অবশেষে লালুও বেরিয়ে পড়ে মুক্তির সন্ধানে। লালু সারাদেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অংশ হিসেবে মিরপুর-১০ এর ফলপট্টি মোড়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ৪ আগস্ট সকাল ১১ টার দিকে বাসা থেকে বের হয়। বন্ধুদের সাথে সেও আন্দোলনে যোগ দেয়। সেখানে অবস্থানরত পুলিশ বাহিনী বিক্ষোভকারীদের উপর অতর্কিতে গুলি চালায়। পূর্ণ করে বর্বরতার ষোল কলা। এই সময় দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে মিরপুর থানার ঘাতক পুলিশ বাহিনীর গুলিতে লালুর মাথার খুলি এফোড় ওফোড় হয়ে যায়। তার মাথার সামনের দিকে দুটি গুলি লাগে, যা পেছন দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। আহত লালুকে অন্যান্য আন্দোলনকারীরা দ্রুত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ নিউরো সাইন্স হাসপাতালে নিয়ে যায়। টানা তিন দিন হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে থেকে ৭ আগস্ট ২০২৪ সকাল ৯:৫০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে একটি পরিবারের আশা ও আকাঙ্ক্ষার সন্তান লিটন হাসান লালু। মহল্লার সকলের কণ্ঠে যেন বেরিয়ে আসে শোকের আর্তনাদ। মিরপুর পানির ট্যাংকি মসজিদে জানাজা শেষে বাদ আসর মিরপুর কালসি কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় কিশোর শহিদ লিটন হাসান লালুকে। হৃদয়ের প্রশান্তি হারালো পরিবার লালু ছিল পরিবারের সবচেয়ে ছোট এবং সবার আদরের। তার পরিচিতজনেরা জানান,ছোট বয়স থেকেই পড়াশোনা ছেড়ে পরিবারের জন্য উপার্জন করত লালু। শহীদ হওয়ার আগে তার মাসিক আয় ছিল ৯০০০ টাকা। পরিবারের যেকোনো সুবিধা-অসুবিধার কথা স্বতঃস্ফূর্তভাবে খোঁজ নিত সে। সেই আলোচিত লালু এখন পরিবার, মহল্লার গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও স্বীকৃত একটি নাম। দেশের জন্য; দেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, নিজের জীবন, বিলিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে জনগণের জন্য মুক্তি কিনে এনেছে ছোট্ট লালু। সে বুঝিয়ে দিয়েছে, শুধু শারীরিক কাঠামোতেই বড় হওয়া যায় না; ইচ্ছা, সাহস ও ত্যাগের বিনিময়েও জীবনে বড় হওয়া যায়। গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা যায় দেশ ও জাতির জন্য; মানুষের জন্য। লালুর প্রতি তার মায়ের ভালোবাসা ছিল অসীম। যখন লালু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অংশ হিসেবে পথে নামে তখন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে তার জীবন এতো দ্রুত শেষ হয়ে যাবে। তার মৃত্যু শুধু তার পরিবার নয়, পুরো এলাকাবাসীকেই যেন শোকের সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছে। লালুর পিতার জীবনের দীর্ঘ সংগ্রাম যেন এক মুহূর্তে অর্থহীন হয়ে যায়। মিরপুরের ফলপট্টি গলিতে যে পরিবারের আলো এক সময় জ্বলজ্বল করতো, সেই আলো আজ নিভে গিয়েছে। শহিদ লিটন হাসান লালুর শোকে তার মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কেননা সে ছিল মায়ের আদরের ছোট ছেলে। শহীদ লালুর মৃত্যু তার পরিবারের জন্য যেমন অপূরণীয় ক্ষতি, তেমনি এই মৃত্যুর শোক যেন আজও কেঁদে কেঁদে ভেসে বেড়ায় মিরপুরের আকাশে বাতাসে। পাশে দাঁড়াতে হবে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম কিশোর শহীদ লিটন হাসান লালুর বাবা মো: হাফিজ। ৬০ বছর বয়সেও বেঁচে থাকার জন্য অটো চালাচ্ছেন জনাব হাফিজ। মা মোসা: আসমা একজন গৃহিণী। তার বয়স ৫০ বছর। বড়ো ভাই মো: মিলন (৩৩) এবং মেজ ভাই মো: নয়ন (৩০) দুজনেই ফুটপাতে ভ্যানে ক্ষুদ্র ব্যবসা করেন। সেজো ভাই মো: রতন (২২) এখনও বেকার আছেন। একমাত্র বোন মোসা: রতনা (১৯) ৯ম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী। ছোট ভাই লালু শহীদ হওয়ার পরে বোনের পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আর লালুর ইমিডিয়েট বড় ভাই মো: রিদয় (১৪) একজন বেকার কিশোর। নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন একটি পরিবারের অতি আদরের এবং উপার্জনক্ষম সন্তান লালুর মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছে পুরো পরিবার। লালুর মায়ের চিকিৎসা খরচ আর সাংসারিক খরচ কিভাবে হবে তা কেউ জানে না। এই সময়ে মাসিক বা এককালীন সহযোগিতা পেলে হয়তো বা আরো একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারবে ঢাকার মিরপুরে পল্লবী ই ব্লক-এর ৭০ নং বাসায় ভাড়া থাকা কিশোর শহীদ লিটন হাসান লালুর পরিবারটি। এক নজরে শহীদ লিটন হাসান লালু শহীদের পূর্ণ নাম : লিটন হাসান লালু জন্ম তারিখ : ০২-০১-২০১২ জন্মস্থান : মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ পেশাগত পরিচয় : ফুলের দোকানের কর্মচারী মাসিক আয় ছিলো : ৯০০০ টাকা স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা : ৭০ নং, ই-ব্লক, পল্লবী, মিরপুর, ঢাকা পিতার নাম : মো: হাফিজ মাতার নাম : মোসা: আসমা ভাইয়ের সংখ্যা : ০৪ বোনের সংখ্যা : ০১ ঘটনার স্থান : মিরপুর-১০, ঢাকা আক্রমণকারী : মিরপুর থানার ঘাতক পুলিশ বাহিনী আহত হওয়ার সময়কাল : ৪ আগস্ট ২০২৪, দুপুর ১:৩০ মৃত্যুর তারিখ সময় ও স্থান : ৭ আগস্ট ২০২৪, সকাল ৯:৫০ ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরো সাইন্স হাসপাতাল, ঢাকা কবরস্থান : মিরপুর-১২, ঢাকা

শহীদের তথ্য সম্বলিত ছবি

Image of লিটন হাসান লালু
Image of লিটন হাসান লালু
Image of লিটন হাসান লালু
Image of লিটন হাসান লালু
Image of লিটন হাসান লালু
Image of লিটন হাসান লালু
Image of লিটন হাসান লালু

একই বিভাগ অন্যান্য শহীদদের তথ্য

নাসির হোসেন

মো: লেবু শেখ

আব্দুল জব্বার

মো: আসিব মিয়া

মো: ইমন

 হান্নান

মো: মাসুদ

মো: শাহজাহান মিয়া

শেখ মেহেদী হাসান জুনায়েদ

জহিরুল ইসলাম শুভ

গঙ্গা চরন রাজবংশী

মো: হোসেন

শেয়ার করুন Facebook Logo Twitter Logo WhatsApp Logo