জন্ম তারিখ: ১০ মে, ১৯৮৪
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: বরিশাল
পেশা : গার্মেন্টস কর্মী, শাহাদাতের স্থান : যাএাবাড়ী থানার সামনে, ঢাকা
বৃহত্তর বরিশালের ঝালকাঠি জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম দক্ষিন চেচরী। এই গ্রামে ১৯৯৪ সালের ১০ মে জন্ম নিয়েছিলো এক ফুটফুটে শিশু। পিতা-মাতা তার নাম দিয়েছিলেন সুজন খান। পরিবারের প্রথম সন্তানের আগমনে আনন্দে উদ্ভাসিত ছিলো পরিবারটি। পরিবারের আর্থিক অনটনের কারণে খুব অল্প বয়সেই পড়াশোনার পাশাপাশি গার্মেন্টস কর্মী হিসেবে কর্মরত ছিলেন সুজন শেখ। চাকরি পাওয়াটা তার মূল উদ্দেশ্য ছিল না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও স্বৈরাচার সরকারের অনৈতিক কার্যাবলী গুলো কোনভাবেই সে মেনে নিতে পারছিলনা। তাইতো তাকে জীবন দিতে হলো। অতি আদরের সন্তানকে হারিয়ে পরিবারটি যেনো বাকরুদ্ধ। আর্থিক টানাপোড়েনের কারনে মাত্র অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার সুযোগ হয়েছিলো সুজনের। এরপরেই দারিদ্র পরিবারের দুঃখ ঘোচাতে গার্মেন্টস কর্মী হিসেবে কাজে যোগদান করে। অর্থনৈতিক অবস্থা কৃষক পরিবারের সন্তান সুজন। পিতা কৃষক, মা গৃহিণী। সুজনের পরিবারের বৃদ্ধ পিতা-মাতা, দুই ভাই বোন, স্ত্রী, ও আড়াই বছরের একটা সন্তান রয়েছে। বাবা কৃষক ও মা গৃহিণী। থাকার মত পাঁচ শতাংশ জমির উপর টিনের চালাবিশিষ্ট ছোটো ২ রুমের ছোট একটা বিল্ডিং রয়েছে। ঘটনার প্রেক্ষাপট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দ্বারা শুরু হওয়া বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নিউজ সুজন প্রতিদিন দেখতেন নিজের মোবাইল ফোনে। তারও ইচ্ছে হতো আন্দোলনে শামিল হতে। মাঝে মাঝে গার্মেন্টসের অফিস টাইম শেষ করে ফেরার পথে শিক্ষার্থীদের সাথে শামিল হতেন আন্দোলনে। আন্দোলনে যেতে মায়ের বারণ ছিল, তাই মাকে না জানিয়েই আন্দোলনে যোগ দিতেন। অনেকটা বিবেকের টানে অনেকটা স্বৈরাচার সরকারের প্রতি অতিরিক্ত ক্ষোভের জায়গা থেকে। সর্বশেষ স্বৈরাচার পতনের দিন ৫ই আগস্ট দুপুরের দিকে পরিবারকে ফোন দিয়ে আন্দোলনে থাকার বিষয়ে জানিয়ে বিজয় মিছিলে যোগদান করে। বিজয় মিছিলে উল্লাসরত হাজার হাজার ছাত্র-জনতার সাথে যাত্রাবাড়ি থানার সামনে থেকে বিজয় মিছিলে যোগ দেন সুজন। বিজয় মিছিলে উল্লাসরত হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনতার কল্পনায়ও ছিল না যে স্বৈরাচারী সরকারের পদলেহনকারী পশুরূপ পুলিশবাহিনী বিজয় মিছিলেও অতর্কিত হামলা চালাতে পারে বা গুলি করতে পারে। বিজয় উল্লাসরত নিরস্ত্র ছাত্রজনতা ও শিক্ষার্থীদের কল্পনাকে ঠেলে দিয়ে অতি উৎসাহী পথভ্রষ্ট পুলিশ বাহিনী অতর্কিত হামলা চালায় আন্দোলনকারীদের উপর। মুহূর্তেই বিজয় মিছিল আর্তচিৎকারে রূপ নেয়। তখন যাত্রাবাড়ী এলাকাটি ভয়াবহ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। হঠাৎ করে পুলিশের একাধিক গুলি সুজনের বুকে এসে লাগে। মুহূর্তেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। গুলিতে বুক ঝাঝড়া হয়ে যায়। সুজনের রক্তে এদেশের মাটি রঞ্জিত হয়ে যায়। উদ্ধার ও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া আন্দোলনরত আশেপাশের লোকজন আহত সুজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে নেয়ার কিছুক্ষণ পরে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান বেশ কিছুক্ষন আগেই সুজনের মৃত্যু হয়েছে। পরিবারে জানানো ও লাশ হস্তান্তর আহত সুজনের পকেটে থাকা মোবাইল ফোন থেকে কল করে তার পরিবারকে আহত হওয়ার খবর জানানো হয়। খবর শুনে সুজনের ছোটো ভাইয়েরা ও বাবা হসপিটালে চলে আসেন। সুজনের মা ও স্ত্রী বারবার অজ্ঞান হয়ে যান। এসে দেখেন যে তার আদরের সন্তান আর নেই। সুজনের বাবা অজ্ঞান হওয়ার মতো অবস্থায় চলে যান। আশেপাশের লোকজন কোনো রকমে বুঝিয়ে শুনিয়ে পরিস্থিতি শামাল দেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকতা শেষে শহীদের লাশকে তার পিতা ও ভাইয়ের কাছে হস্তান্তর করেন। এম্বুলেন্স করে লাশ বরিশালের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে জানাজা শেষে দাফন করা হয়। শহীদের নিকট আত্মীয়ের স্মৃতিচারণ শহীদের পিতা বলেন, ‘’সুজন ছিল আমার প্রথম সন্তান। ছোটবেলা থেকে অত্যন্ত নম্র ভদ্র ও নামাজী ছিলো। ছেলেবেলা থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত যতদিন বাড়িতে ছিলো সব সময় আমার সাথে নামাজ পড়তে যেতো। পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ যে কতটা ভারী তা সন্তানহারা পিতা ছাড়া আর কেউই উপলব্ধি করতে পারবে না।‘’ শহীদের মা বলেন, ‘যে সন্তানকে জন্মদানের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো মা হয়েছি তার স্মৃতিগুলো ভুলবো কি করে। চোখের পানি শুকিয়ে গেছে তবুও সন্তান হারানোর ব্যথা ভুলতে পারিনি। সন্তান হলে ব্যথা প্রতি মুহূর্তে তাড়া করে বেড়ায়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যেনো আমার কলিজার টুকরো সন্তানকে শহীদ হিসেবে কবুল করে নিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসে উচ্চ মাকাম দান করেন এই দোয়া করি।‘’ শহীদের স্ত্রী বলেন, ৪ বছর চলছিলো আমাদের বিয়ের বয়স এরমধ্যে এমন একদিনও ছিল না যে আমার হাসবেন্ড আমাকে অসম্মান করেছে বা তারসাথে কোনো বিষয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছে।চমৎকার দাম্পত্ত জীবন ছিলো আমাদের। তিনি ছিলেন আমার উত্তম অভিভাবক। স্বামী ব্যাতীত ছোটো ১ টি সন্তান নিয়ে একটা মেয়ে কিভাবে পথ চলতে পারে? আমার চোখের পানি আর মনের ব্যথা কোনোটাই শেষ হয়নি। মৃত্যু পর্যন্ত আমাকে এ ব্যাথা বয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমার আড়াই বছরের ১ টি কন্যা সন্তান আছে। মৃত্যু কি জিনিস তা ও বোঝেনা। বাবা কখন ফিরবে এই প্রশ্নটি বারবার করতে থাকে, তখন আঁচলে মুখ লুকিয়ে কান্না করা ছাড়া আমার আর কিছুই করার থাকেনা। আমি চারিদিকে অন্ধকার দেখি। কি করবো কিভাবে আমার হাসবেন্ডের রেখে যাওয়া সন্তানের দায়িত্ব পালন করবো তা বুঝে আসেনা। আল্লাহু সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা আমাকে অতি উত্তম জীবনসঙ্গী দান করেছিলেন কিন্তু তার সাথে কাটানোর মতো অতি অল্প সময় দিয়েছেন। আমাদের সমাজে একজন বিধবা মহিলা যে কতোটা অবহেলার স্বীকার হন তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। শুধু এইটুকু বলবো যে প্রকৃত অপরাধীর সঠিক বিচার হোক। আর কোনো মেয়েকে যেনো এভাবে বিধবা হতে না হয়। শহীদের ফুপু বলেন, আমার ভাতিজা খুবই ভালো ছেলে ছিলো। আমাদেরকে খুব ভালোবাসতো ও সম্মান করতো। সবসময় ফোন দিয়ে খোঁজ-খবর রাখতো। শহীদের ফুপা মো: ইসহাকের মন্তব্য, প্রায়ই সে আমাদের খোঁজখবর নিতো। আমাকে সাবধানে চলার পরামর্শ দিতো। আল্লাহু সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা তাকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন। সহযোগিতা সংক্রান্ত প্রস্তাবনা: ১. শিশুটির ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়া ২. শহীদের স্ত্রীকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া ব্যক্তিগত প্রোফাইল পুরো নাম : মো: সুজন জন্মতারিখ : ১০/০৫/১৯৯৪ পেশা : গার্মেন্টস কর্মী ঠিকানা : গ্রাম: দক্ষিণ চেচরী, ইউনিয়ন: চেচরী রামপুর ইউনিয়ন, থানা: কাঠালিয়া, জেলা: ঝালকাঠি পিতার নাম : মো: বাবুল খান বয়স: ৬৭, পেশা: দিনমজুর মাতার নাম : জুনিয়া বেগম বয়স: ৫৪, পেশা: গৃহিণী পরিবারের সদস্য সংখ্যা : ৯ ভাই বোনের সংখ্যা : ৪ ঘটনাস্থান : যাএাবাড়ী থানার সামনে, ঢাকা আক্রমণকারী : পুলিশ আহত হওয়ার সময় ও তারিখ : ০৫/০৮/২০২৪, বিকাল ২.৩০ মৃত্যুর সময় ও তারিখ : ০৫/০৮/২০২৪, বিকাল ৪.০০ ( আনুমানিক ) শহীদের কবরের অবস্থান : গ্রামের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থান