জন্ম তারিখ: ৮ জানুয়ারি, ১৯৯৯
শহীদ হওয়ার তারিখ: ৫ আগস্ট, ২০২৪
বিভাগ: ঢাকা
পেশা :ছাত্র, শাহাদাতের স্থান :যাত্রাবাড়ী থানার সামনে।
অভাবী পরিবারের সুন্দর দিন ফেরানোর স্বপ্ন দেখতেন শহীদ মো: রাসেল মাহমুদ (২২), ৮ জানুয়ারি ১৯৯৯ সালে পটুয়াখালী জেলার, গলাচিপা উপজেলার, চরকাজল ইউনিয়নের, ছোট শিবা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। দরিদ্র পরিবারের সন্তান রাসেল ছোটবেলা থেকেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। পরিবারের সুন্দর দিন ফেরানোর স্বপ্ন দেখতেন। তার পিতা আবুল হাওলাদার, একজন কৃষক এবং মাতা রাশেদা বেগম গৃহিণী। তারা শহীদের আদর্শ অভিভাবক। রাসেলের শিক্ষাজীবন শুরু হয় '১৮৪ নং শিবারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে'; যেখানে তিনি ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি অর্জনসহ, জিপিএ ৫ পেয়ে সফলতা অর্জন করেন। পরবর্তীতে 'আব্দুস সালাম আকন আইডিয়াল স্কুল' থেকে এসএসসি এবং ঢাকার শ্যামপুর বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্সে ভর্তি হন। মেধা এবং মননশীলতার অধিকারী রাসেল ২০২৪ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলনে শুরু থেকেই ছিলেন সক্রিয়। ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে পুলিশের অতর্কিত হামলায় তিনি কপালে গুলিবিদ্ধ হন। মৃত্যুর পরে ৬ আগস্ট ঢাকা মেডিকেলে তার লাশ সনাক্ত হয়। রাসেলের মৃত্যুতে পটুয়াখালীতে এক শোকের ছায়া নেমে এসেছিলো। তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ছোট চর শিবার ঈদগাহ মাঠে ও তৎসংলগ্ন কবর স্থানেই তাকে সমাহিত করা হয়। শহীদ রাসেল মাহমুদ তার স্বপ্নের পথে অগ্রসর হতে পারেননি; কিন্তু তার সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ আমাদের স্মরণে থাকবে চিরকাল। তিনি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অনুপ্রেরণা। ঘটনা সংক্রান্ত বিবর শহীদ মো: রাসেল মাহমুদ ছিলেন মানবতার এক বিরল উদাহরণ, যিনি স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী জনগণের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের দিনটি, যা হতে পারতো একটি নতুন সূর্যোদয়ের সাক্ষী, সে দিনেই তার জীবন প্রদীপ নিভে গেল। সেদিন শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর পুরো দেশজুড়ে সাধারণ মানুষ বিজয়ের আনন্দে মেতে ওঠে। তাদের চিৎকারে মুখর হয়ে ওঠে ঢাকার রাস্তা, যেন নতুন সম্ভাবনার এক দুয়ার খুলে গিয়েছে সবার জন্য। কিন্তু এই বিজয়ের স্বাদ শহীদ রাসেল মাহমুদ এবং তার মতো অনেকের জন্য রক্তাক্ত অধ্যায়ে পরিণত হলো। সেই বিকালটা ছিল সাধারণ একটি বিকালের চেয়ে অনেক বেশি। দেশের মানুষের জন্য এক বিপ্লবী মুহূর্ত। বিকেল ৩ টার দিকে রাসেল মাহমুদ হাজারো মানুষের সাথে যাত্রাবাড়ীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। যাত্রাবাড়ী তখন পরিণত হয়েছে প্রতিবাদের এক প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে। সমবেত মানুষেরা তখন যাত্রাবাড়ী থানার সামনে জড়ো হয়ে নিজেদের অধিকার এবং অবিচারের প্রতিকার দাবি করছিল। হঠাৎ করেই পুলিশের একটি বড় দল ফিল্মি কায়দায় থানার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে অতর্কিত গুলি চালাতে শুরু করে। নিরীহ, প্রতিবাদী মানুষদের উপর ঝরে পড়ে বুলেটের বৃষ্টি। রাসেল মাহমুদ ছিলেন সেই মুহূর্তে এক মিছিলের অগ্রভাগে। তার মাথায় পুলিশের ছোঁড়া একটি গুলি আঘাত হানে, মুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। যখন তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নেওয়া হলো, তখন সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার মাথায় গুলির যে আঘাত ছিল, তা ছিল এতটাই গুরুতর যে তার বেঁচে থাকার আর কোনো সম্ভাবনা ছিল না। অথচ, সেই দিনটি তার জন্য বিজয়ের মুহূর্ত হওয়ার কথা ছিল। তার স্বপ্ন ছিল একটি নতুন বাংলাদেশের, যেখানে স্বৈরাচারের কোনো স্থান নেই, যেখানে মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারবে, কথা বলতে পারবে, নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। যাত্রাবাড়ী ছিল সেদিন ঢাকার অন্যতম উত্তপ্ত প্রতিবাদকেন্দ্র। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ঢাকার এ এলাকাটি পরিণত হয়েছিল শত সহস্র প্রতিবাদীর সম্মিলনের স্থানে। সেদিন হাজার হাজার সাধারণ মানুষ এবং শিক্ষার্থী যাত্রাবাড়ী থানার সামনে ঘেরাও করে তাদের প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই পুলিশের বর্বর হামলায় আহত হন, কেউ কেউ নিহতও হন। পুলিশ কোনো রকম পূর্বসতর্কতা ছাড়াই নির্বিচারে গুলি চালাতে শুরু করে, যেন মানুষের জীবন তাদের কাছে কোনো অর্থবহ বিষয় নয়। প্রাণহানি এবং আহতদের সংখ্যা বাড়তে থাকে দ্রুত, যেন জীবন শুধুই একটি সংখ্যা। অধিকাংশ হতাহতকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং অন্যান্য হাসপাতালে। সেদিনের গুলিবর্ষণে তিন শতাধিক মানুষ আহত হন এবং তাদের মধ্যে বহু মানুষ নিহত হন। নিহতের লাশগুলি যখন হাসপাতালগুলোতে পৌঁছাতে থাকে; তখন সেখানকার পরিবেশ শোকের আবহে ছেয়ে যায়। শহীদ মো: রাসেল মাহমুদ ছিলেন সেই প্রতিবাদের এক অগ্নিসাক্ষী, যিনি শুধু নিজের জন্য নয়, পুরো জাতির জন্য নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। তিনি জানতেন যে, তার এই ত্যাগ একদিন ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা হবে। অথচ, যিনি দেশের মানুষের জন্য স্বপ্ন দেখতেন, নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন, তিনি সেদিন তার বিজয়ের মুহূর্তটি উপভোগ করার সুযোগই পেলেন না। তার রক্তে রঞ্জিত হলো মুক্তির পথে অগ্রসর হওয়া জনতার আন্দোলন। এই নির্মমতার পরেও স্বৈরাচারী শাসনের পতনের সেই বিকেলটি শুধু রাসেল মাহমুদের জন্য নয়; অসংখ্য অন্যায়-নিহতদের জন্য এক শোকাবহ দিন হয়ে থাকবেন। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয় ও বন্ধুর বক্তব্য/অনুভূতি শহীদের চাচা আবু সালহে বলেন, রাসলে ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে যাত্রাবাড়ীতে মারা যান। সে খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন। আশা করি বাংলার মানুষ শহীদদের চিরদিন স্মরণ করবে। সরকাররে কাছে আমার দাবি আমার ভাতিজাসহ সকল শহীদের হত্যার বিচার যেন দ্রুততম সময়ে সরকার করেন। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার বিবরণ শহীদ রাসেল মাহমুদের বাবা, আবুল হাওলাদার (৬৩), একজন দরিদ্র কৃষক, যিনি কষ্টার্জিত আয় দিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ করেন। তার বড় ছেলে মিরাজ (২৮) বিয়ে করে আলাদা হয়ে গিয়েছে। সেও কৃষিকাজের মাধ্যমে সে তার নিজস্ব পরিবার চালায়। ছোট ছেলে শাওন (১৬) এখন ৯ম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। আবুল হাওলাদার তার স্বল্প আয়ে শাওনের পড়াশোনা ও পরিবারের খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন, তবে দিন দিন এটি তাদের জন্য আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পরিবারটি নিজের কোনো জমি না থাকায় অন্যের জায়গায় ঘর তুলে বসবাস করছে, যা তাদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার দুর্বলতাকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। প্রস্তাবনা: পরিবারটির সহযোগিতা প্রয়োজন এই পরিবারের বর্তমান অবস্থান অত্যন্ত নাজুক। তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন অনেক কষ্টে চলে, আর ভবিষ্যতের কোনো নিশ্চয়তাও নেই। এই পরিবারটির পাশে দাঁড়ানো খুবই জরুরি, যাতে তারা কিছুটা স্বস্তি পেতে পারে এবং শাওন তার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে।তাদের বিভিন্ন কারণে সহযোগিতা প্রয়োজন যা উল্লেখ করা হলো- প্রস্তাবনা-১: মায়ের চিকিৎসা সহায়তা শহীদের মা নানা অসুস্থতায় জর্জরিত। তার নিয়মিত চিকিৎসার জন্য অর্থের প্রয়োজন। চিকিৎসা নিশ্চিত করা হলে সুস্থ হয়ে উঠতে পারবেন এবং পরিবারের সঙ্গে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন। প্রস্তাবনা-২: বাবার সাহায্য শহীদ রাসেলের বাবা একজন বৃদ্ধ কৃষক। তার জন্য আর্থিক সহযোগিতা জরুরি। একটি মুদি ব্যবসার মত ব্যবসা ধরিয়ে দিলে পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরবে আশা করা যায়। প্রস্তাবনা-৩: ছোট ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ ছোট ভাইয়ের লেখাপড়ার জন্য অর্থ সহায়তা প্রয়োজন, যাতে সে তার শিক্ষাজীবন অব্যাহত রাখতে পারে; পরিবারটির অবস্থার উন্নতি ঘটাতে সহায়ক হবে। এই সহযোগিতাগুলি নিশ্চিত করা হলে পরিবারের সদস্যরা একটি স্থিতিশীল জীবনযাপন করতে সক্ষম হবে এবং তাদের উন্নতির সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। এক নজরে শহীদের ব্যক্তিগত তথ্যাবলি শহীদের পূর্ণ নাম: মো: রাসেল মাহমুদ জন্ম তারিখ: ০৮ জানুয়ারি, ১৯৯৯ জন্মস্থান: পটুয়াখালী পেশা/পদবী: ছাত্র নিজ জেলা: পটুয়াখালী পেশাগত পরিচয়: ছাত্র রক্তের গ্রুপ: ও(+) ঠিকানা: গ্রাম: ছোট শিবা ইউনিয়ন: চরকাজল থানা: গলাচিপা জেলা: পটুয়াখালী পরিবার সংক্রান্ত তথ্য: পিতার নাম: আবুল হাওলাদার পিতার পেশা ও বয়স: কৃষক, ৬৩ বছর মায়ের নাম: রাশেদা বেগম মায়ের পেশা ও বয়স: গৃহিণী, ৫০ বছর মাসিক আয়: ৫,০০০ টাকা আয়ের উৎস: কৃষি কাজ ভাই-বোনদের তথ্য: ১. মো: মিরাজ মাহমুদ (বড় ভাই), বয়স ২৮ পেশা: কৃষক, বিবাহিত ২. মো: শাওন (ছোট ভাই), বয়স ১৬, শ্রেণি: ৯ম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: আব্দুস সালাম আকন আইডিয়াল স্কুল ঘটনার স্থান: যাত্রাবাড়ী আক্রমণকারী: পুলিশ আহত হওয়ার সময়: বিকাল ৩ টা মৃত্যুর তারিখ ও সময়: ৫ আগস্ট ২০২৪, বিকাল ৩টা মৃত্যুর স্থান: যাত্রাবাড়ী থানার সামনে শহীদের কবরের বর্তমান অবস্থান: নিজ গ্রাম ছোট চর শিবা