জন্ম তারিখ: ১ জানুয়ারি, ১৯৭৬
শহীদ হওয়ার তারিখ: ১৮ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: বরিশাল
পেশা :গাড়িচালক, শাহাদাতের স্থান :ফরাজী মেডিকেল হাসপাতাল, বনশ্রী, ঢাকা।
পটুয়াখালী জেলার সদর উপজেলাধীন হকতুল্লা গ্রামে ০১ জানুয়ারি ১৯৭৬ সালে হতদরিদ্র পরিবারে শহীদ মো: দুলাল সরদার (৪৮) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গ্রামে ছোটবেলা থেকেই অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি গাড়ি চালিয়ে যে আয় উপার্জন করতেন তা দিয়ে অসুস্থ বাবা-মা সহ ছেলে সন্তান এবং স্ত্রী পরিজনদের জীবিকা নির্বাহ করতেন। তার স্ত্রী তাসলিমা আক্তার দীর্ঘদিন ধরে হার্টের রোগে আক্রান্ত। তার পিতা বয়োবৃদ্ধ জনাব সুলতান সরদার (৭০) অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছেন। তার মা বয়োবৃদ্ধা হালিমা বেগম(৬৫) অসুস্থ অবস্থায় দিন পার করছেন। বড় ছেলে সাইদুল রহমান সোহান (২৬) তিতুমীর কলেজে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। দ্বিতীয় ছেলে সজীব সরদার (২১) এ কে এম রহমাতুল্লাহ কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। তৃতীয় ছেলে রাজিব সরদার (১৬) পড়ালেখা করেননি। আবদুল্লাহ বিন দুলাল (০৪) নামে তার একটি কনিষ্ঠ শিশু সন্তানও রয়েছে। পিতা-মাতা, স্ত্রী, সন্তানসহ মোট আট সদস্য নিয়ে তার পরিবার এবং তিনিই পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। পবিবারের সবাই গ্রামে বসবাস করেন। জীবিকার তাগিদে তিনি ঢাকার মেরুল বাড্ডা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। পেশায় দুলাল সরদার একজন গাড়ি চালক ছিলেন। মাসুম রেন্ট এ কার এর গাড়ি চালাতেন দুলাল সরদার। যেভাবে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরলেন দুলাল সরদার জুলাই-আগস্ট ২০২৪ গণঅভ্যুত্থানে অনেকেই স্বৈরাচারী সরকার বাহিনীর হাতে শাহাদাত বরণ করেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শুধু ছাত্রদেরকেই জীবন দিতে হয়নি বরং জীবন দিতে হয়েছে ভ্যানচালক, রিকশা চালক, ড্রাইভার, দিনমজুর এবং বিভিন্ন ধরনের পেশাজীবী মানুষের। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি বহাল রাখায় মেধাবী ছাত্ররা তাদের যোগ্য স্থান থেকে বঞ্চিত হয়। অযৌক্তিক কোটার বিরুদ্ধে ছাত্ররা আন্দোলন গড়ে তোলেন। এই আন্দোলনের বীজ বপন হয়েছিল ২০১৮ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে। একই সালে কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে অনেককেই নির্যাতনের শিকার হতে হয়। স্বৈরাচারী সরকার তখন চাপের মুখে পড়ে তাদের দাবি মেনে নেয়। ২০২৪ সালে এসে স্বৈরাচারী সরকার আবারো কোটাপ্রথা বহাল রেখে ছাত্রদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। যৌক্তিক দাবিতে গড়ে তোলা এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে ১৬ জুলাই ওবায়দুল কাদের এর কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের মাধ্যমে তার গুণ্ডাবাহিনী ছাত্রলীগ এবং যুবলীগেকে উস্কে দেয়। ১৭ জুলাই ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভাড়া করে ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং টোকাই লীগের মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপরে নির্যাতন চালানো হয় । ১৮ জুলাই শান্তিপূর্ণ ছাত্র-ছাত্রীদের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সহ সকল স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে পড়ে। সেদিন আন্দোলনে যাদের ভূমিকা না বললেই নয় তারা ছিলেন র্ব্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ। সেদিন তারা শিক্ষার্থী ভাই-বোনদের ওপর অমানবিক নির্যাতনের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন। কিন্তু সরকারের সন্ত্রাসী বাহিনী ছিলেন তৎপর। দেশী-বিদেশী অস্ত্র হাতে নিয়ে পুলিশের সাথে হেলমেট পড়ে সন্ত্রাসী যুবলীগ বাহিনী রাস্তায় নেমে পড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপরে হামলার তীব্র আক্রোশ নিয়ে। তীব্র হামলার নিন্দার প্রতিবাদ নিয়ে ঘরে বসে থাকতে পারেননি অভিভাবকবৃন্দ। তারাও তাদের ছেলেমেয়ে এবং শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ায়। ক্রমে আপামর সাধারণ জনগনও শিক্ষার্থীদের পাশে অভিভাবক হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশ এবং সন্ত্রাসী যুবলীগের অস্ত্রের হাত থেকে রেহাই পায়নি সাধারণ জনগন। গাড়ি চালক থেকে শুরু করে সবজি বিক্রেতা এবং দিনমজুরও রেহাই পায়নি তাদের হাত থেকে। তাদেরই একজন গাড়িচালক ছিলেন শহীদ জনাব মো: দুলাল সরদার। তিনি মাসুম রেন্ট এ কারে গাড়ি চালাতেন। গাড়ি পার্কিং করে রাস্তা ক্রস করার পর তিনি দেখতে পান র্ব্যাক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশের গোলাগুলি চলছে। তিনি ছাত্রদের পাশে গিয়ে একাত্মতা প্রকাশ করেন। পুলিশ এবং আওয়ামী সন্ত্রাসী যুবলীগরা এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে। হঠাৎ একটি গুলি এসে তার বুক ঝাঁঝরা করে দেয়। তিনি দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। অবশেষে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। দুলাল সরদারের বুকের রক্তে রঞ্জিত হয় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁকা সড়ক। আহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে ছাত্ররা দ্রুত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিকটস্থ ফরাজী মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যান। অবশ্য ততক্ষণে তিনি দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে শাহাদাতের সুধা পান করেন। শহীদের লম্বা তালিকায় যুক্ত করে নেন নিজেকেও। বেলা তখন ১১ টা। গ্রামে থাকা স্ত্রী তাসলিমা আক্তারের মুঠোফোনে হঠাৎ রিং বেজে ওঠে স্বামী দুলাল সরদারের নাম্বার থেকে। স্ত্রী তাসলিমা চমকে ওঠে তড়িঘড়ি করে ফোনটি রিসিভ করেন। একজন অপরিচিত কণ্ঠস্বর তাকে জিজ্ঞেস করে এই ফোনটি কার। তখন তার স্ত্রী বলেন, ফোনটি তার স্বামী দুলাল সরদারের এবং তার কাছ থেকেই তিনি তার স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ শোনেন। সাথে সাথে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে তার পরিবার। শহীদের ব্যাপার নিকটাত্মীয়/প্রতিবেশীর অনুভূতি শহীদ দুলাল সরদারের প্রতিবেশী (চাচাত ভাই) মো: জসিম উদ্দিন (৩২) বলেন, দুলাল ভাই ব্যবহারে খুবই অমায়িক এবং ভালো মানুষ ছিলেন। তার সাথে কারো শত্রুতা ছিলোনা। তিনি সবার সাথে সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখতেন। তিনি কোন রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলতেন, তার মতো ভালো মানুষ দ্বিতীয়জন আমাদের এলাকায় হবেনা। সহোযোগিতা সংক্রান্ত প্রস্তাবনা প্রস্তাবনা-১: তার বড় ছেলের স্নাতক সম্পন্ন হয়েছে, তার চাকুরী প্রয়োজন। প্রস্তাবনা-২: তার মেঝো ছেলের পড়াশুনার খরচ বহন করা দরকার। প্রস্তাবনা-৩: ওনার স্ত্রী ও মায়ের চিকিৎসার ব্যায়ভার বহন করা দরকার। এক নজরে শহীদ দুলাল সরদার নাম : মো: দুলাল সরদার, পেশা: গাড়িচালক জন্ম : ০১ জানুয়ারি ১৯৭৬ পিতা : মো: সুলতান সরদার (বয়োবৃদ্ধ) মাতা : হালিমা বেগম স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: হকতুল্লা, ইউনিয়ন: বদরপুর থানা: পটুয়াখালী সদর, জেলা: পটুয়াখালী আহত হওয়ার তারিখ ও স্থান : ১৮ জুলাই, ২০২৪, মেরুল বাড্ডা, ঢাকা শহীদ হওয়ার তারিখ ও স্থান : ১৮ জুলাই, ২০২৪ ফরাজী মেডিকেল হাসপাতাল বনশ্রী, ঢাকা