জন্ম তারিখ: ৩ এপ্রিল, ২০০৩
শহীদ হওয়ার তারিখ: ২৩ জুলাই, ২০২৪
বিভাগ: বরিশাল
পেশা :ছাত্র, শাহাদাতের স্থান :ঢাকা মেডিকেল কলেজ, আইসিইউ।
স্বপ্নের অসমাপ্ত যাত্রা ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একজন অকুতোভয় যোদ্ধা হিসেবে হৃদয় চন্দ্র তরুয়া আমাদের মনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কাঠমিস্ত্রী বাবা রতন তরুয়া ও মা অর্চনা রানীর কোল আলো করে ২০০৩ সালের ৩ এপ্রিল পটুয়াখালী জেলার চরপাড়া, নতুন বাজার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন হৃদয় চন্দ্র তরুয়া। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এই মেধাবী ছাত্রের স্বপ্ন ছিল একদিন বিসিএস ক্যাডার হয়ে দেশের সেবা করবেন। নিজের পরিবারের দরিদ্রতা দূর করে তাদের সুখী করাই ছিল তার একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করার স্বপ্ন দেখা এই তরুণের জীবন অকালে বিনষ্ট হয়ে গেল। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট ব্রিজের নিচে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে হৃদয় চন্দ্র তরুয়া আর সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। তার মৃত্যুতে গোটা দেশ শোকাহত হয়ে পড়ে। একজন মেধাবী ছাত্র, একজন দেশপ্রেমিক যুবক হৃদয়ের মৃত্যু শুধু তার পরিবারের জন্য নয়, গোটা দেশের জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতি। হৃদয় চন্দ্র তরুয়া ছিলেন একজন সাহসী ও নির্ভীক যুবক। দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও তিনি পিছপা হননি। তার এই ত্যাগ ও বলিদানকে কখনো ভুলতে দেওয়া যাবে না। হৃদয়ের মৃত্যু আমাদের সকলকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দেশের জন্য লড়াই করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আশা করি, হৃদয় চন্দ্র তরুয়ার আত্মা শান্তি পাবে এবং তার বলিদান সার্থক হবে। যেভাবে তিনি চির স্মরণীয় হলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র হৃদয় চন্দ্র তরুয়া একজন সক্রিয় ছাত্র সংগঠক ছিল। সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটাপ্রথা আদালত কর্তৃক পুনর্বহালের প্রতিবাদে সারা বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ কোটা প্রথা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নেমে আসে। সেই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে যোগ দিতে হৃদয় তার আরও কয়েকজন বন্ধু সহ বহদ্দারহাট এলাকায় ১৮ জুলাই দুপুর দেড়টার দিকে যান। শিক্ষার্থীদের স্লোগানে মিছিল এগিয়ে যেতে থাকে। ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার।’ ‘চাইলাম অধিকার হয়ে গেলাম রাজাকার’ ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা দেশটা কারো বাপের না।’ ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’ ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’ ‘আমার খায়, আমার পরে, আমার বুকেই গুলি করে’; ‘তোর কোটা তুই নে, আমার ভাই ফিরিয়ে দে’ ‘আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’ জালিমের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেওয়া এইসব বজ্রকণ্ঠ স্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে বীর চট্টলার রাজপথ। মিছিল সামনে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ ও ছাত্রলীগ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ছাত্রদের বাধা প্রদান করে। এসময় পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করলে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। হৃদয় চট্টগ্রামের স্থানীয় না হওয়ায় এলাকা খুব ভালো করে চিনত না। বহদ্দারহাট চার রাস্তার মোড়ে পুলিশ ও বিজিবি অবস্থান নিয়েছিল। বাম পাশের রাস্তার একটা অংশ থেকে ঢিল ছুড়ছিল শিক্ষার্থীরা। পুলিশ কিছুক্ষণ পরপর গুলি করছিল। প্রত্যক্ষদর্শী হৃদয়ের এক বন্ধু জানান "ধাওয়া খেয়ে আমরা তখন নিরাপদ স্থানের খোঁজে দৌড়াতে থাকি তখন বিকট শব্দ হয়। চারপাশে তাকিয়ে দেখি হৃদয় পড়ে আছে, হাত দিয়ে ডাকছে। আমি তখন তার দিকে তাকাতেও পারছিলাম না। প্রথমবার গুলিবিদ্ধ মানুষ দেখলাম। অনেককে সাহায্যের জন্য ডাকি। পরে অল্প বয়সী কয়েকজন ছেলের সহায়তায় হাসপাতালে নিয়ে যাই।" রিকশায় সে সময়ে বন্ধুর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘ও বারবার বলছিল—‘আমার পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। পা নড়াইতে পারছি না।’ আমি তার পা-টা ধরে ছিলাম। বারবার জিজ্ঞেস করছিল, ‘আর কতক্ষণ’।" পুলিশের গুলি সরাসরি হৃদয় তরুয়ার বুকে বিদ্ধ হয়। ফুটো করে দেয় ফুসফুস। আহত অবস্থায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে তাকে নেয়া হয়। ডাক্তাররা জানালেন, তার ওপেন হার্ট সার্জারি করে বুলেট বের করতে হবে। কিন্তু সে আন্দোলনকারী হওয়ায় তার সার্জারি করতে চাচ্ছিল না। এছাড়াও ওপেন হার্ট সার্জারি করতে কয়েক লাখ টাকা লাগে। ১৮ তারিখ রাতে উরমরঃধষ ঈৎধপশফড়হি শুরু হওয়ার পর সব মোবাইল ব্যাংকিং, অঞগ বন্ধ হয়ে যায়। হাসপাতালগুলো জানিয়েছিল, সার্জারির আগে ৬০-৭০% টাকা পরিশোধ করতে হবে। পরবর্তীতে ২০ তারিখ সকালে তাকে ঢাকা মেডিকেলে আনা হয়। ঢামেকে ওঈট ম্যানেজ করা সম্ভব হচ্ছিলো না। পরবর্তীতে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ওঈট ম্যানেজ করা হয় কিন্তু তখনো কোনো মেডিকেল সার্জারি করতে রাজি হয়নি। পরে হৃদয়কে পিজিতে নেয়া হয়, ওখানে 'আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী' জানার পরে ওকে ভর্তি নিতে রাজি হয়না কর্তৃপক্ষ। এরপর 'স্কয়ার হাসপাতালে' যোগাযোগ করা হয় সেখানেও একই পরিস্থিতি। তারা জানিয়ে দিল প্রায় ১০ লাখ টাকা আগাম পরিশোধ করতে হবে। নাহলে সার্জারি হবে না। তারপর বক্ষব্যাধি হাসপাতালে নেয়ার পর তারাও মানা করে দেয়। এভাবে ৫ দিন পর্যন্ত বুকে গুলি নিয়ে হৃদয় হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরতে থাকে। সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে পরবর্তীতে ২৩ জুলাই সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের আই সি ইউ তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। তার মতো অগণিত হৃদয় এভাবে আন্দোলনের সময় বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। প্রতিবাদী হৃদয় তরুয়া হৃদয় চন্দ্র তরুয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রথম থেকে অংশগ্রহণ করেন। ১৭ জুলাই ২০২৪ প্লাকার্ড হাতে তার একটি ছবি এখনো ফেইসবুকে ভেসে বেড়ায়। তাতে লেখা "কোটা রেখে কলম ধর, নিজের বীরত্ব প্রকাশ কর।" একই দিন এসএসসি ব্যাচ-১৮ তার বন্ধুদের উদ্দেশ্য করে ফেইসবুক পোস্টে যা লিখেন, তা হুবহু তুলেধরা হলো- "আমি পটুয়াখালী সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি-২০১৮ ব্যাচের পক্ষ থেকে ঘোষণা করছি যে, আমাদের ব্যাচ থেকে কেউ যদি সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর হামলার ঘটনায় প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকে তবে উপযুক্ত প্রমাণস্বরূপ উক্ত ব্যক্তিবর্গকে ব্যাচ থেকে বয়কট করার ঘোষণা করছি। ভবিষ্যতে ১৮ ব্যাচের কোনো কার্যক্রমে উক্ত ব্যক্তিবর্গকে ডাকা হবে না এবং তার সাথে কেউ সম্পর্ক রাখবে না। জুবিলীয়ান"- এমনই ছিলো তার প্রতিবাদী ভাষা। শহীদ সম্পর্কে নিকটাত্মীয় ও বন্ধুর বক্তব্য/অনুভূতি ১. নিহতের দুলাভাই, দ্বীপক মিস্ত্রি বলেন, খুবই ভালো মানুষ ছিলো। সে খুব কষ্ট করে করে লেখা পড়া করছে। আমার সাথে তার খুব ভালো সম্পর্কে ছিলো। ১৮ জুলাই হঠাৎ আমার কাছে কল আসে হৃদয় গুলিবিদ্ধ হয়ছে। পরে চট্টগ্রামে গিয়ে ওকে এনে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করাই। পরে ২৩ তারিখ মারা যায়। সে খুবই মিশুক ছিলো। ২. নিহতের বাবা রতন তরুয়া (৫০) বলেন, 'হৃদয় চন্দ্র তরুয়া আমার একমাত্র ছেলে। অনেক কষ্ট করে পড়া-লেখা করাইছি, খুব ভালো ছাত্র ছিলো আমার ছেলে, জুবলি স্কুল দিয়া এসএসসিতে এ+ পাইছে। পটুয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসিতেও এ+ পাইছে। আমার ছেলে খুব ভালো ছিলো। ভদ্র, নম্র। এলাকায় ওর মত এতো ভালো ছেলে নাই। অনেক কষ্ট কইরা পোলাডারে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি করছি। আমার বাবা হৃদয় কইছে পড়ালেখা শেষ করে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হইবো।' ৩. বড়বোন মিতু বলেন, 'ভাইটা খুবই মেধাবী ছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন চান্স পায়, মা-বাবা প্রতিবেশী সবাইকে মিষ্টি খাইয়েছিলেন। হৃদয়ও জানত, তার ওপর কত বড় দায়িত্ব। বাবাকে ফোন করলেই বলত, বাবা আর কয়েকটা বছর। তারপর আর কষ্ট করতে হবে না।' হৃদয় বিহীন পরিবার হৃদয়ের বাড়ি পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলায়। বাড়ি মির্জাগঞ্জে হলেও পটুয়াখালীর সদরে চরপাড়া, নতুন বাজার এলাকায় ভাড়া থাকে হৃদয়ের পরিবার। হৃদয়কে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা-বাবা। পরিবারের জীবনযুদ্ধের কথা তুলে ধরেন তাঁর বড় বোন মিতু। তিনি বলেন, মা বাসা-বাড়িতে কাজ করে জমানো টাকা হৃদয়ের জন্য পাঠাতেন। ও একদিন বড় হবে। চাকরি করবে, দুঃখ-দুর্দশা মুছবে; সেই আশায় ছিলাম সবাই। ছেলের মৃত্যুর খবরে কয়েকবার বেহুঁশ হয়েছেন অর্চনা রানী। হুঁশ ফিরলেই বিলাপ করছেন। কোনো কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না তাঁকে। মিতু বলেন, 'আমার ভাই তো কোনো অস্ত্র তুলে নেয়নি। কাউকে আঘাতও করেনি। হয়তো কোটা আন্দোলনে শরিক হয়েছিল। তাই তাকে এভাবে গুলি করে মারতে হবে? আমরা এর বিচার চাই।' পরিবার অর্থনৈতিক অবস্থা বীর হৃদয় চন্দ্র তরুয়ার বাবা রতন তরুয়া (৫০) পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রি। পটুয়াখালী শহরের ভাড়া বাসায় থেকে বিভিন্ন বাসা বাড়িতে গিয়ে আসবাবপত্র নির্মানের কাজ করেন তিনি। মা অর্চনা রানী(৪৫) হৃদরোগী হয়েও অন্যের বাসায় কাজের বুয়ার কাজ করেন। তার পরিবার খুব কষ্ট করে দিনাতিপাত করে। ছেলে টিউশন করে পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করতেন। অর্থনৈতিকভাবে পরিবারটি অসচ্ছল। তাদের একমাত্র ছেলে ছিলো হৃদয় চন্দ্র তরুয়া। নিজেদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের টাকায় এ দম্পতি মানুষ করতে চেয়েছিলেন একমাত্র ছেলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র তরুয়াকে। ছেলেও চেয়েছিলেন একদিন মা-বাবার সব কষ্ট দূর করবেন। তাঁদের মুখে হাসি ফোটাবেন। ফোন করলেই তাঁদের সেই স্বপ্নের কথা বলতেন; কিন্তু একটি বুলেট সব শেষ করে দিল। হৃদয় চন্দ্র তরুয়ার পরিবারের নেই কোন নিজস্ব বাসস্থান। বাবা-মা একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে এই পরিবারটি এখন একটি নিঃস্ব পরিবারে পরিণত হয়েছে। তাদের আশা আকাঙ্ক্ষা কিছুই নেই, একমাত্র মেয়ে বিবাহ দেওয়া তার জামাইও কাঠমিস্ত্রি কাজ করে। পরিবারে হালধরার মতন কেউ নেই। বাবা-মা দুজনেই ছেলে হারানোর শোকে কাতর এবং পাড়া প্রতিবেশীরাও যেনো বাকরুদ্ধ। এক নজরে শহীদ পরিচিতি নাম : হৃদয় চন্দ্র তরুয়া জন্ম তারিখ : ০৩-০৪-২০০৩ পিতা : রতন তরুয়া মাতা : অর্চনা রানী স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম: চরপাড়া নতুন বাজার, ইউনিয়ন: পটুয়াখালী পৌরসভা, থানা: সদর, জেলা: পটুয়াখালী পেশা : ছাত্র (স্নাতক ৩য় বর্ষ, ইতিহাস বিভাগ) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ঘটনার স্থান : বহদ্দারহাট ব্রিজের নিচে আহত হওয়ার সময়কাল : ১৮ জুলাই ২০২৪, দুপুর ২:৩০ (আনুমানিক), বহদ্দারহাট মোড়, চট্টগ্রাম শাহাদাতের সময়কাল : ২৩ জুলাই ২০২৪, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, আইসিইউ আঘাতের ধরন : বুকে গুলি আক্রমণকারী : পুলিশ শেষকৃত্য স্থান : গ্রামের বাড়িতে শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয় প্রস্তাবনা ১. তার মায়ের হৃদরোগের চিকিৎসা খরচ বহন করা যেতে পারে ২. পিতাকে ব্যবসার জন্য পুঁজি দেওয়া যেতে পারে ৩. স্থায়ী বাসস্থান প্রয়োজন